প্রাকৃতিক রং (ভেজিটেবলস ডাই) ও দেশি পোশাক নিয়ে কাজ করেন তিনি। গড়ে তুলেছেন একটি ফ্যাশন উদ্যোগ। সেখানকার কাপড়চোপড় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। রং, কাপড়, ব্লকপ্রিন্ট, বাটিকের কাজ নিয়ে তাঁর যে সংগ্রাম, তা যেন অনবদ্য এক গল্প। দীর্ঘদিন ধরে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত তিনি। ভুগছেন ক্যানসারে। নিয়মিত কেমো নিতে হয়। রোগশোক-জরা, এত প্রতিকূলতাও দমাতে পারেনি তাঁকে।
গত বছর দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা (এসএমই) খাতে পেয়েছেন সম্মাননা। তাঁর গড়া যারীনস ক্রিয়েশনে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েকজনের। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো উদ্যোক্তা এই মানুষটির নাম আফরোজা সুলতানা (৪৫)।
নিজের লক্ষ্যে অবিচল
গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর সফিউদ্দিন শিল্পালয়ে কথা হয় আফরোজার সঙ্গে। সেখানে তিনি একটি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সন্ধ্যায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ বকুলিয়ায় জন্ম তাঁর। ছোটবেলায় নানির কাছ থেকে সেলাই ও হাতের কাজ শিখেছিলেন। সে সময় আড়ংয়ের মতো প্রতিষ্ঠান দেখে, স্বপ্ন দেখতেন নিজে কিছু করার। ১৯৯৭ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তিনি এইচএসসি পরীক্ষার্থী। চিকিৎসক জানান, তিনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত।
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাধির কাছে হারেননি। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনকে অনুরোধ করেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি করে দিতে। মেয়ের আবদার রাখেন বাবা। ব্লকপ্রিন্ট, বাটিক ও প্রাকৃতিক রঙের ওপর ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নেন আফরোজা। প্রশিক্ষণ শেষে কাজ শুরু করেন। তখনো স্বপ্ন পূরণের পথে পুরোপুরি হাঁটা শুরু হয়নি। আত্মীয়স্বজনকে ব্লকপ্রিন্ট, বাটিকের কিছু কাজ করে দিতেন, ওই পর্যন্তই।
২০০০ সালে ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ওয়াহিদুর নবী চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় আফরোজার। বিয়ের পরের প্রথম ঈদেই ম্যাট ও কুশন কভার বানান। নতুন বউয়ের কাজ দেখে শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুব খুশি। সংসারের নানা ব্যস্ততায় টানা কাজ চালিয়ে যেতে পারেন না।
বিয়ের এক বছরের মাথায় সংসারে আসে ছেলে রাশিক, সাত বছরের মাথায় মেয়ে যারীন। ২০০৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন তাঁরা। স্বামী, সন্তান ও সংসার সামলানোর পাশাপাশি অবসরে ব্লকপ্রিন্ট, বাটিকের কাজ করতেন। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে বাইরে বসে নানা সূচিকর্ম ও বাটিকের কাজ করতেন। অনেক অভিভাবক সেগুলো কিনতেন। এভাবেই চলছিল। তখনো অনলাইন বাজারের প্রসার ঘটেনি দেশ। নিজের কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার কথাও ভাবেননি আফরোজা।
নতুন রোগের হানা
২০১৫ সালে আফরোজার দেবরের কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে ভারতের চেন্নাইয়ে যান। নিজেও চিকিৎসক দেখান। এ সময় পরীক্ষা করে দেখা গেল, থ্যালাসেমিয়ার পাশাপাশি আফরোজা মায়োলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোমে আক্রান্ত। এটি অস্থিমজ্জার একধরনের ক্যানসার। চিকিৎসকদের পরামর্শে কেমোথেরাপি নেওয়া শুরু হয় তখন থেকেই।
সেবার দেশে ফিরে এসে আফরোজা সিদ্ধান্ত নেন, নিজের স্বপ্ন পূরণ করবেনই। ব্যবসায় সময় দেবেন। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মনে অন্তত অসুখের প্রভাব কম পড়বে। সে বছরের ডিসেম্বরেই ব্যবসার জন্য স্বামী তাঁকে ৫০ হাজার টাকা দেন। এর সঙ্গে নিজের সঞ্চিত ২০ হাজার টাকা যুক্ত করে শুরু করেন নতুন উদ্যোগ যারীনস ক্রিয়েশন। ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন। আজ আফরোজার প্রতিষ্ঠানে ১৫-২০ লাখ টাকার পণ্য আছে। ছয়জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
ফেসবুক পেজ থেকে আফরোজার পোশাক মাসে ৭০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। তবে ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন মেলায় দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
যারীনস ক্রিয়েশনে আফরোজা শাড়ি, থ্রি–পিস, ওড়না, পাঞ্জাবি, শার্ট, বিছানার চাদর, পর্দাসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন। পণ্যে ব্যবহৃত রঙে কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করেন না তিনি। রং নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালো লাগে তাঁর।
পণ্য যায় নানা দেশে
আফরোজার তৈরি পণ্য যায় নানা দেশে। শুরুতে জাপান থেকে ২০টি ব্লকপ্রিন্টের চাদরের অর্ডার পেয়েছিলেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছে যারীনস ক্রিয়েশনের পণ্য। দেশেও আফরোজার তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা আছে।
যারীনস ক্রিয়েশনের নিয়মিত ক্রেতা ঢাকার ধানমন্ডির শিখা দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে আফরোজা যে পণ্য তৈরি করেন, এটা বিশেষ, ভেজিটেবল ডাই দিয়ে বানানো। কৃত্রিম কোনো উপকরণ ব্যবহার করেন না। কাপড়টাও বেশ ভালো।’
একটু শ্রমসাধ্য হলেও প্রাকৃতিক রং নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আফরোজা। নিজের করা নকশায় কাজ করেন তিনি। মসলিন, পিওর সিল্ক, বলাকা সিল্ক, এন্ডি সিল্কের শাড়ি ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয় বেশি। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে আফরোজা সুলতানা ওয়ান্ডারওম্যান বিভাগে ‘ট্যালি এমএসএমই সম্মাননা ২০২৪’ পেয়েছেন।
আলাপের শেষ পর্যায়ে আফরোজা জানান, এই দীর্ঘ যাত্রায় স্বামীর পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বড় সমর্থক তাঁর শ্বশুর। এখনো তিনি নিয়মিত পুত্রবধূর ব্যবসার খোঁজ নেন। নিজের সম্পর্কে আফরোজা বলেন, ‘ক্যানসারকে পাত্তা না দিয়ে আমি উদ্যোক্তা হতে পেরেছি। আসলে আমার কাছে “পারি না” বলে কিছু নেই।’
আফরোজা মনে করেন, দেশে মেয়েরা এখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। কোনো মেয়েরই এখন বসে থাকা উচিত নয়। তিনি এখন স্বপ্ন দেখেন, তাঁর একটি নিজস্ব দোকান হবে। সেই দোকান ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে।