ইন্টারনেট ছাড়া আইসিটি শিল্প কি বাঁচতে পারে?

ইন্টারনেটের প্রতীকী ছবিছবি: রয়টার্স

সরকারিতে চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট সেবা নিয়ে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়ে গেল আমাদের। ১১ দিন বন্ধ থাকার পর চালু হলো মোবাইল ইন্টারনেট, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা সাত–আট দিন পর। গত রোববার থেকে দেশে সব ধরনের ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে আবার। তবে এই ইন্টারনেট সেই ইন্টারনেট নয়। গতি কম, কখনো বন্ধ, কখনো খোলা—এভাবেই চলছে।

ইন্টারনেট এখন জীবনযাপনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েবের জনক স্যার টিম বার্নার্স–লি ইন্টারনেটকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ তো গেল সাধারণ ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার কথা। এ সময়ের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) শিল্পের কথা একবার ভাবুন। ইন্টারনেট ছাড়া এই শিল্প কি চলে? শুধু আইসিটি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় বা কর্মী ও পেশাজীবীদের কথা নয়, এই শিল্প যে পণ্য বা সেবা তৈরি করে, তা অন্য ব্যবসায় ও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অনেক কাজে লাগে। আর আইসিটি শিল্পের লাইফলাইন হলো এই ইন্টারনেট।  

দেশের আইসিটি ব্যবসায় উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। সেই গ্রুপে ১২ দিন ধরেই দেশের ইন্টারনেট পরিস্থিতি এবং এর ফলে আইসিটি শিল্পের ক্ষতির নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেই আলোচনায় ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা, অসহায়ত্ব ভালোই টের পাওয়া যায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়েও আলোচনা হয়। তবে পরিস্থিতি এমন যে কোনো কূলকিনারাই পান না অনেকে।

গতকাল বুধবার এই গ্রুপে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ও দেশের প্রথম সফল চাকরির ওয়েব পোর্টাল বিডিজবস ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর এক বার্তায় লিখেছেন, ‘আমরা কেন এই কথাটা মেনে নিচ্ছি যে ইন্টারনেট যখন–তখন চলে যেতে পারে? এত দিন তো যায়নি। যদি এটা মেনে নিই যে ইন্টারনেট চলে যেতে পারে যখন–তখন, তাহলে বাংলাদেশে আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিরই দরকার নেই। আমরা কৃষিকাজ করব, সেই ক্ষমতা বা স্কিল আমাদের আছে। পানি দেবেন না, মাটির ওপর পানি ছাড়া মাছ চাষ করতে বলবেন, এটা একধরনের প্রতারণা।’

আরও পড়ুন

এই বার্তায় কিছুটা ক্ষোভের প্রকাশ থাকলেও বাস্তবতা এমনই। গত কয়েক দিনে দেশের ইন্টারনেট নিয়ে যা করা হলো সরকারের তরফ থেকে তা আর যা–ই হোক গ্রহণ করার মতো না। ১৭ জুলাই দেশের প্রায় সব মুঠোফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেট ধীরগতিতে চলার পাশাপাশি ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছিল। এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ১৮ জুলাই এক অনুষ্ঠানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক সাংবাদিকদের বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে গুজব, মিথ্যা, অপপ্রচার করাটাকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে একটি গোষ্ঠী। তাই জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের দিক থেকেই ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার একটা ইঙ্গিত দেন প্রতিমন্ত্রী।

প্রয়াত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া জনপ্রিয় একটি গান—‘আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে।...’ আমাদের প্রতিমন্ত্রী জনাব পলক সংগীতপ্রেমী, নিজেও গাইতে পারেন। তরুণদের বিভিন্ন সমাবেশে আইয়ুব বাচ্চুর গান গাইতেও দেখা যায় তাঁকে। তাই হয়তো ইন্টারনেট না থাকার একটা বয়ান তিনি এই গানের মতো করেই দেন। তিনি বলেন, সরকার দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে। ‘ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে’ কথাটির ওপর তিনি বেশি জোর দেন। যেন এটি প্রেমের মতো আবেগীয় কিছু একটা। অথচ বৈশ্বিক ইন্টারনেট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি তথ্য বলছে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধের কারণ দৈব বা কারিগরি ত্রুটি নয়, এটা ‘গভর্নমেন্ট ডিরেক্টেড’, মানে সরকার নির্দেশিত। গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান টেলিনর এশিয়ার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৭ জুলাই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের (লাকাল অথোরিটিজ) নির্দেশে থ্রি-জি ও ফোর-জি নেটওয়ার্ক অর্থাৎ মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় তাদের অপারেটর গ্রামীণফোন। এই যুগে একটা কিছু বললেই যে হয় না, তা বোঝার কথা কিন্তু আমাদের আইসিটির দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রীর। আর পুরো বিশ্বের ইন্টারনেট যে ব্যবস্থায় চলে তাতে যেকোনো যোগাযোগ, যেকোনো ঘটনা–দুর্ঘটনার পদচিহ্ন রয়ে যায়।

আরও পড়ুন

এরপর যখন মোবাইল ফোর–জি ইন্টারনেট দেওয়া হলো, তখন প্রতিমন্ত্রী ফেসবুক, টিকটকসহ বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলেন প্রকাশ্যে। তাতে কি এগুলোর ব্যবহার ঠেকানো গেল? যদিও সবার জন্য বন্ধ ঘোষণা করে তিনি নিজেই ফেসবুক–টিকটক ব্যবহার করলেন ‘গুজব’ ঠেকাতে; কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সমাজে বিকল্প পথ কম নেই। মানুষ ভিপিএন দিয়ে ঠিকই বন্ধ রাখা মাধ্যমগুলো ব্যবহার করলেন। তখন তিনি ভিপিএনের নানা দুর্বলতা, সাইবার ঝুঁকির কথা বলতে থাকলেন। প্রযুক্তি সম্পর্কে জানাশোনা মানুষেরা নিজেদের মতো করেই তাঁর কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন।

যাহোক গতকাল বুধবার ফেসবুকসহ বন্ধ থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ বাংলাদেশে সাইবার হামলার আশঙ্কার কথা বলতে শুরু করেছেন। ভয়ংকর সাইবার হামলা নাকি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। তাই সরকারের প্রস্তুতি নেওয়ার ও সবাইকে সতর্ক থাকার কথা বলছেন তিনি। প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে আবার ইন্টারনেট বন্ধের একটা পাঁয়তারা হিসেবে মনে করছেন একাধিক তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী। তাঁদের মতে, এরপর ইন্টারনেট বন্ধ হলে সাইবার হামলার ঝুঁকিকে হয়তো সামনে আনা হবে। আর আমাদের তা–ই মেনে নিতে হবে।

ইন্টারনেট যে আইসিটি শিল্পের প্রাণভ্রমরা, তা এখন আর নতুন করে বলার দরকার নেই। আগে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ ছিল ডেস্কটপ কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক নির্ভর। এখন বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের কাজ, তথ্য, ফাইল রাখার জন্য, গ্রাহককের সেবা দেওয়ার জন্য ক্লাউড স্টোরেজ ব্যবহার করে। ক্লাউড মানেই ইন্টারনেটে সংযুক্ত।

ইন্টারনেট না থাকলে ৫০ শতাংশ উৎপাদনক্ষমতা কমে যায় প্রতিষ্ঠানগুলোর। আর কল সেন্টার, আউটসোর্সিং খাত পুরোটাই অনলাইননির্ভর, তাদের কাজকর্ম বন্ধ করে দিতে হয়। লাখ লাখ ফ্রিল্যান্সারের আয়রোজগারও ইন্টারনেটনির্ভর। ই–কমার্স, এফ–কমার্সের পুরো ব্যবসা ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল।

নানা সূত্রের তথ্যমতে বাংলাদেশে রপ্তানিমুখী সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাজার এখন বছরে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এই খাতের অভ্যন্তরীণ বাজার ১০০ কোটি ডলারের মতো। সব মিলিয়ে আইসিটি খাতে দেশে প্রায় চার লাখের মতো মানুষ এখন কাজ করেন। স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করা বর্তমান সরকারও এই খাত নিয়ে যথেষ্ট গর্ব করেন, প্রচারণা চালান। এই খাতে সরকারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫০০ কোটি ডলার। তবে ইন্টারনেট নিয়ে এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি করা হলো?
যেসব আইসিটি উদ্যোগ রপ্তানীমুখী সেগুলোর গ্রাহকেরা তো বিদেশের। এই কদিনে বেশির ভাগ গ্রাহকই অসন্তুষ্ট হয়েছেন, চলে গেছেন অন্য কোনো দেশের কোম্পানির কাছে। অভ্যন্তরীণ কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা হয়তো গ্রাহকদের বুঝিয়ে–শুনিয়ে রাখতে পারবেন; কিন্তু বিদেশি গ্রাহকেরা কি তা বুঝবেন? যে তরুণেরা দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ে বিদেশি গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছিলেন, সেই আস্থার জায়গা তো এই ক’দিনে শেষ হয়ে গেল ইন্টারনেট বন্ধ রাখার কারণে।  

১৯৯৬ সালে সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে বাংলাদেশে প্রথম অনলাইন ইন্টারনেট চালু করা হয়। তারপর থেকে এত লম্বা সময় ধরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার ঘটনা আর দেখা যায়নি। সাবমেরিন কেবল কাটা পড়ার কারণে বা অন্য কোনো ঘটনায় হয়তো কয়েক ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। কিন্তু এবারের মতো অবস্থা নজিরবিহীন। ১১ দিন পর যে ইন্টারনেট চালু করা হয়েছে, সেটাতেও কাঙ্ক্ষিত গতি পাওয়া যাচ্ছে না মাঝেমধ্যেই। দেশের আইসিটি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে অবশ্যই নিরবচ্ছিন্ন, গতিময় ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক ও প্রথম আলোর হেড অব নিউ ইনিশিয়েটিভ