সামাজিক যোগাযোগামাধ্যম এখন যেন ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধকালীন দিনলিপি

মোতাজ আজাইজা ইনস্টাগ্রামে গাজার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেন নিয়মিতমোতাজ আজাইজার ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

মধ্যপ্রাচ্যে গত বছরের অক্টোবর থেকে নতুন করে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা সেই যুদ্ধের নানা ঘটনা ও পরিস্থিতি ইতিহাস লেখার মতো করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। গাজা থেকে সামাজিক যোগাযোগামাধ্যমে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তির ভিডিও ও ছবি প্রকাশ করছেন ফিলিস্তিনিরা। সেসব অ্যাকাউন্ট ব্যাপকভাবেই অনুসরণ করছেন ব্যবহারকারীরা।

মধ্য গাজার শহর দেইর আল-বালাহতে থাকেন মোতাজ আজাইজা। তিনি গত ২৫ ডিসেম্বর খুদে ব্লগ লেখার সাইট এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ করেন। একটি কোয়াডকপ্টার তাঁর বাড়ির দরজার ওপরে উড়ছিল। তিনি এক্সে নিজের ভয়ের কথা প্রকাশ করে আশঙ্কা করেন যে তিনি ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে চলেছেন। অনলাইনে বেশ পরিচিত ফিলিস্তিনি হিসেবে আগেও বেশ হুমকির মুখে পড়েছিলেন আজাইজা। ২৪ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি ফটোসাংবাদিকের টুইটে শত শত মানুষ নিজেদের ভাবনার কথা লেখেন।

তার আগে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক হামলার নানা ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেন আজাইজা। এক ব্যবহারকারী তাঁর টুইটে লিখেছেন, ‘আমি মোতাজের জন্য খুব ভয় পাচ্ছি।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘আমি আশা করি মোতাজ ঠিক আছেন।’ একজন লিখেছেন, ‘মোতাজের জন্য দোয়া করো।’

নুর নামের যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এক মেডিকেল শিক্ষার্থী মোতাজকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। কয়েক মাস ধরে নুরের মতো অসংখ্য মানুষ আজাইজার ভিডিও, ছবি অনুসরণ করছেন। আজাইজা তাঁর লাখ লাখ অনুসারীর কাছে যুদ্ধের চিত্র সম্প্রচার করছেন। একসময়ের প্রাণবন্ত গাজা যুদ্ধের কারণে কতটা ধূসর মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তা–ই আজাইজার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে। নুর বলেন, ‘আমাদের অনেকের কাছেই মনে হয়, সে আমার ভাই। সে একজন বন্ধু এবং আমরা বাস্তব সময়ে তাঁর কষ্ট দেখছি।’

নুরের মত অসংখ্য মানুষ যাঁরা ফিলিস্তিনি নন এবং কখনো গাজায় যাননি, তাঁরা আজাইজার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধের বাস্তবতা দেখছেন। আজাইজাকে তাঁর কাজের জন্য হত্যা করা হতে পারে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসারীরা বেশ দুশ্চিন্তায় থাকেন। নুর বলেন, ‘আজাইজা শুধু সাংবাদিকতা করছেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি যেন দিনপঞ্জি লিখছেন। তিনি আমাদের গাজার মানুষের জীবন দেখাচ্ছেন। মোতাজ আজাইজার এখন লাখ লাখ ইনস্টাগ্রাম অনুসারী (ফলোয়ার) রয়েছে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধের ভয়াবহতা সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন। সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ ইনস্টাগ্রাম ও এক্সের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজার যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছেন। এই সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজাবাসীরা নাগরিক সাংবাদিক (সিটিজেন জার্নালিস্ট) হিসেবে নিজেদের চিত্র তুলে ধরছেন। সারা বিশ্ব থেকে তাঁদের অনুসারীরা দৃঢ়ভাবে মানসিক সংযোগ গড়ে তুলেছেন।

যুক্তরাজ্যের ক্রীড়া সাংবাদিক লায়লা হামেদ বলেন, ‘আমি যখন সকালে জেগে উঠি, তখন প্রথমেই ইনস্টাগ্রাম খুলে ফিলিস্তিনিদের প্রোফাইল দেখি। তাঁদের গল্প দেখতে থাকি। একজন সাংবাদিক হিসেবে এসব নাগরিক সাংবাদিকের সহকর্মী হিসেবে নিজেকে দেখছি আমি। আমি তাঁদের জন্য সহানুভূতি বোধ করি। আমি মাঝেমধ্যে তাঁদের প্রোফাইল খুলতে ভয় পাই, যদি খারাপ কিছু ঘটে!’

কানাডার টরন্টোভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গল্পকার কানওয়াল আহমেদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যুদ্ধের খবর জানেন। তিনি বলেন, এই সব নাগরিক সাংবাদিকেরা সমগ্র বিশ্বে পরিবার তৈরি করেছেন। যদি আরেক পরিচিত মুখ বিসান আওদা কোনো কিছু শেয়ার করেন তাহলে টুইটে ‘বিসান কোথায়?’, ‘কেউ কি জানেন বিসান কোথায়?’, ‘সে কি ঠিক আছে?’ এমন সব বার্তা ছড়িয়ে যায়। আজাইজা ছবি দিলে সেখানে তাঁর বিষণ্নতার খোঁজ নেন সবাই। সবাই তাঁদের নিয়ে আলোচনা করছেন। ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণের নানা ভিডিও সরাসরি বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রচলিত গণমাধ্যমে দেরিতে ছবি ও ভিডিও প্রকাশের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ছবি দ্রুত গ্রহণ করছেন নেটিজেনরা। আজাইজাসহ ইনফ্লুয়েন্সার বিসান আওদা ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিন্দ খুদারির মতো তরুণ ফিলিস্তিনিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন আলোচিত মুখ। অনলাইনের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের মানুষকে নিয়ে আরেকটি পরিবার তৈরি করেছেন তাঁরা।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনের ফিলিস্তিনি–মার্কিন লেখক জাইনা আরাফাত বলেন, ‘যুদ্ধের বোমা হামলা ও বিস্ফোরণের ছবি সেলফি ধাঁচের ভিডিওর মাধ্যমে প্রকাশ করছেন গাজাবাসীরা। যুদ্ধের মানবিক বিষয়কে সরাসরি অনলাইন ব্যবহারকারীরা দেখতে পারছেন। আপনি যখন কাউকে ধ্বংসস্তূপে বসে থাকতে দেখেন কিংবা আপনি যদি দেখেন, একটি পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে তার বাবার মৃতদেহের পাশে কাঁদছে, তখন তা দেখা খুব কঠিন। এই সব চ্যানেলে মাধ্যমে সরাসরি যুদ্ধের খোঁজ পাই আমরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন ছবি দেখে আমরা ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত হই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সাংবাদিক ও দর্শকের মধ্যে তাত্ক্ষণিক সংযোগ তৈরি করছে।’

গাজায় স্বাধীন সাংবাদিকতা খুবই কঠিন কাজ। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স, এজেন্স ফ্রান্স-প্রেসসহ (এএফপি) বেশির ভাগ সংবাদ সংস্থা নিজস্ব সংবাদদাতাদের মাধ্যমে গাজা যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকেরা বেশ অবরুদ্ধ। কিছু বিদেশি সাংবাদিক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের অনুমতি পেলেও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে আছেন তাঁরা। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে যুদ্ধকালীন গাজার সংবাদ পাওয়ার অন্যতম প্রধান উৎস।’

সূত্র: সিএনএন