তিনি এখন কর্মীদের বেতন দেন মাসে ৯০ লাখ টাকা
মনোয়ারের ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল বড় কিছু করার। ভাবতেন বড় কিছু করতে কম্পিউটার শিখতে হবে, জানতে হবে তথ্যপ্রযুক্তি।
মনোয়ার ইকবালের পেশাজীবন শুরু ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেতন ছিল ৬ হাজার টাকা। এখন নিজের প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের বেতন দেন মাসে প্রায় ৯০ লাখ টাকা।
১০ বছরের ব্যবধানে এখন দেশে-বিদেশে ১০টি অফিস। দেশের সফটওয়্যার শিল্প খাতে তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রাইডসিস আইটি লিমিটেডের অবস্থান প্রথম সারিতেই। প্রাইডসিস মূলত যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় (অটোমেশন) করার সফটওয়্যার তৈরি করে। কীভাবে গড়ে তুললেন প্রাইডসিস, এই প্রতিবেদককে সম্প্রতি সেই গল্প শোনালেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে নিজের অফিসে বসে।
পথ মসৃণ ছিল না
বাবা মির মোহাম্মাদ নুর ই আব্দুল হাই কৃষিকাজ করতেন। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায়। মনোয়ারের ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল বড় কিছু করার। ভাবতেন বড় কিছু করতে কম্পিউটার শিখতে হবে, জানতে হবে তথ্যপ্রযুক্তি।
২০০২ সালে লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির অধীনে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম (সিএসআইএস) বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন মনোয়ার ইকবাল। প্রথম কর্মস্থলে ছয় হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করার সুযোগ খুব একটা ছিল না। তাঁর আগ্রহ সফটওয়্যারে। কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দেন আরেকটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে। বেতন ছিল আট হাজার টাকা।
স্বপ্নপূরণ শুরু
মনোয়ার ইকবাল চাকরি করার চেয়ে নিজে কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। সেভাবে এগোতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘ভাগ্যক্রমে আমি কিছু সুযোগ পাই। একবার থাইল্যান্ডে গিয়ে কাজ করতে হলো। সেখানে বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, জাপান ও থাইল্যান্ড মিলে একটা যৌথ কাজ। সফটওয়্যার অংশের কাজ ছিল আমাদের প্রতিষ্ঠান এটিআই লিমিটেডের।’
থাইল্যান্ডে মনোয়ার বিভিন্ন দেশের তৈরি সফটওয়্যার দেখেন। সেগুলো সম্পর্কে জানেন। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল আমার জীবনের
মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘটনা।’ কাজ ছিল একটি থাই হাসপাতালের ইআরপি সফটওয়্যার তৈরির। এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং বা ইআরপি হলো একটা প্রতিষ্ঠানের মূল সফটওয়্যার, যা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের নানা রকম কাজ পরিচালনা করা হয়।
মনোয়ার বলেন, ‘থাইল্যান্ডের ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখি তারা যে সফটওয়্যার ব্যবহার করে, সে রকম বানানো তো দূরের কথা, আমরা চোখেও দেখিনি। কিন্তু চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। সত্যিই ওই হাসপাতালের জন্য আগের চেয়ে ভালো “হসপিটাল ইআরপি” বানিয়ে দিই আমরা।’
মনোয়ার সে দেশে আরও দুই বছর থাকেন। থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশের বড় বড় হাসপাতালে এটিআইয়ের সফটওয়্যার ব্যবহৃত হতে থাকে। মনোয়ার এই দলের একজন নির্ভরযোগ্য সদস্য হয়ে ওঠেন।
২০০৭ সালে মনোয়ার বিয়ে করেন। তখন তাঁর মাসিক বেতন ১৮ হাজার টাকা। ওই সময়ে দুবাই, পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরবে এটিআই কাজ পেতে থাকে। এরই মধ্যে থাইল্যান্ডের একটি কোম্পানির সঙ্গে এটিআইয়ের সম্পর্কে ভাটা পড়ে। থাই প্রতিষ্ঠানটি মনোয়ারকে চাকরি করার প্রস্তাব দেয়। গাড়ি-বাড়ি, তিন মাস পরপর বাংলাদেশে যাতায়াতের বিমান টিকিটসহ প্রস্তাবটা ছিল বেশ লোভনীয়। কিন্তু মনোয়ার সেটা গ্রহণ করেননি।
থাইল্যান্ড থেকে ২০১০ সালে দেশে ফিরে আসেন মনোয়ার। এর কিছুদিন পর এটিআই ছেড়ে দেন। এরপর দেশে সিনেসিস আইটি নামের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে কাজ করার সময় ২০১১ সালে কলকাতার একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের গবেষণাপত্র দেখে মনোয়ার জানতে পারেন, বাংলাদেশে ইআরপি সফটওয়্যারের এক হাজার কোটি টাকার মতো বাজার রয়েছে।
এই তথ্য মনোয়ারকে স্বপ্নপূরণের দিকে ঠেলে দেয়। সিনেসিস আইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সোহরাব হোসেন নিজেও মনোয়ারকে উৎসাহ দেন। ২০১৩ সালে শুরু হয় মনোয়ারের প্রাইডসিস আইটি লিমিটেডের পথচলা। একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার ও দুজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী নিয়ে ১০ বছর আগে নিজের প্রতিষ্ঠান চালু করেন তিনি।
বড় কিছুই করছেন মনোয়ার
মাত্র দুজন সফটওয়্যার প্রকৌশলীকে নিয়ে শুরু করা মনোয়ারের প্রতিষ্ঠানে এখন ২০০ জন কর্মী। এই প্রতিষ্ঠানের আছে নিজেদের তৈরি করা পূর্ণাঙ্গ ইআরপি সফটওয়্যার ‘প্রাইডসিস ইআরপি’। সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে প্রধান কার্যালয় প্রাইডসিসি আইটির। এটি ছাড়া দেশে ও দেশের বাইরে আছে আরও ১০টি অফিস।
প্রাইডসিস ইআরপি ছাড়া আরও কিছু সফটওয়্যার পণ্য তৈরি করে। এসব সফটওয়্যার বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, থাইল্যান্ড, ওমান, মালেশিয়া, মাদাগাস্কার, ফিজি, জাপানসহ ২৭টি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে ও বিদেশে ৩০০-এর বেশি তৈরি পোশাক কারখানায় প্রাইডসিস ইআরপি ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইআরপি সফটওয়্যারের একটি শূন্যতা রয়েছে বলে মনে করেন মনোয়ার ইকবাল। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবাদান সহজ করতে ‘প্রাইডগভ’ নামে ইআরপি সমাধান রয়েছে তাঁদের।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা ইআরপি সফটওয়্যার। এ ছাড়া রয়েছে প্রাইডভ্যাট (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অনুমোদিত), প্রাইডপস (বড় বড় দোকানের জন্য পিওএস সমাধান), নিরাপত্তার জন্য ‘প্রাইড ভিশন’, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ‘প্রাইড সিআরএম’ ইত্যাদি।
প্রাইডসিসের ‘প্রবাস বন্ধু’ অ্যাপ বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ড ২০২২-এ চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার পেয়েছে। প্রাইডসিস আইটির ঝুলিতে বেসিসের আরও ছয়টি পুরস্কার রয়েছে। এ ছাড়া দ্য ডেইলি স্টার আইসিটি অ্যাওয়ার্ড ২০২১, অ্যাপিকটা মেরিট অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড সামিট অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মনোয়ার ইকবাল বলেন, ‘এখন আমার স্বপ্ন বাংলাদেশের অফিসগুলো স্মার্ট করে তোলা। সফটওয়্যার ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাই স্মার্ট অফিস গড়ে তুলতে পারে। আমি ও আমাদের প্রতিষ্ঠান সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।’