'মেসি' হয়েই থাকলেন মার্তা
তাঁকে ডাকা হয় ‘স্কার্ট পরা পেলে’ বলে। মার্তা ভিয়েরা ডা সিলভার খেলা দেখে স্বয়ং পেলেও যাতে কোনো আপত্তি করেননি। বরং সানন্দেই মেনে নিয়েছিলেন তুলনাটা। কিন্তু মার্তা ‘পেলে’ হতে পারলেন কই, তিনি তো সেই ‘মেসি’-ই হয়ে রইলেন!
সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে পেলের স্বীকৃতিতে তাঁর অবিশ্বাস্য ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের অবশ্যই বড় ভূমিকা। তবে দলগত সাফল্যের কিছুটা অবদান তো তাতে আছেই। তিন-তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন। পেলের পরিচয় দিতে গেলে সবার আগে চলে আসে এই কীর্তির কথাই।
লিওনেল মেসির কথা বললে যেমন সব পেয়েও কিছু না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। ক্লাবের হয়ে সব জিতেছেন, ভরে গেছে ব্যক্তিগত অর্জনের ডালাও, কিন্তু আর্জেন্টিনাকে কিছুই জেতাতে পারেননি।
এখানেই মেসির সঙ্গে মিলে যাচ্ছেন মার্তা। সমকালীন ফুটবলের তো বটেই, মেয়েদের ফুটবলে সর্বকালের সেরা বলেও তাঁকে একরকম মেনে নিয়েছেন সবাই। একটা জায়গায় মেসির চেয়েও এগিয়ে। মেসি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি ফিফা ব্যালন ডি’অর জিতেছেন টানা চারবার। মার্তা টানা পাঁচবারের বিশ্বসেরা। অথচ সেই মার্তা দেশের হয়ে কিছুই জিততে পারলেন না। ‘স্কার্ট পরা পেলে’ এখানেই ‘মেসি’ হয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত অর্জনের দিক থেকে পরিপূর্ণ, কিন্তু দেশের জার্সি গায়ে শুধুই শূন্যতা—লিওনেল মেসি ছাড়া এর চেয়ে সবচেয়ে বড় উদাহরণ আর কে!
কাকতালীয়ই বলতে হবে, যে দেশের বিপক্ষে ফাইনাল জিতে ১৭ বছরের পেলের প্রথম বিশ্বকাপ, সেই সুইডেনই হয়ে রইল মার্তার শেষ দীর্ঘশ্বাস! গত পরশু মারাকানায় অলিম্পিক ফুটবলের সেমিফাইনালে সুইডেনের কাছে টাইব্রেকারে হারার পর ভেঙে পড়লেন কান্নায়। শুধু সতীর্থ ব্রাজিলিয়ানরাই নয়, সুইডিশরাও এসে সান্ত্বনা দিলেন মার্তাকে। এঁদের অনেকেই যে তাঁর পরিচিত, গত চার বছর ধরে তো সুইডিশ লিগেই খেলে আসছেন মার্তা।
ছেলেদের বিশ্বকাপে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের কাছে অলিম্পিক ফুটবলে সোনা মরীচিকা হয়ে আছে এখনো। ব্রাজিলের মেয়েদের কাছেও। পার্থক্য হলো, মেয়েরা কখনো বিশ্বকাপও জিততে পারেনি। পরের বিশ্বকাপের সময় মার্তার বয়স হবে ৩৩, টোকিও অলিম্পিকের সময় আরও এক বছর বেশি। মার্তা পারবেন বলে মনে হয় না। ব্রাজিলের প্রথম জার্সি হলুদ রঙের, দ্বিতীয় জার্সি নীল। মার্তার জন্য দ্বিতীয়টাই প্রতীকী হয়ে গেল। ব্রাজিলের মার্তা মানে না পাওয়ার বেদনায় নীল!
গত তিনটি অলিম্পিকের দুটিরই ফাইনালে ছিল মার্তার ব্রাজিল। এথেন্স ও বেইজিংয়ে পরপর দুটি ফাইনালে হারতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এই দুই অলিম্পিকের মাঝখানেই খেলেছেন ২০০৭ বিশ্বকাপের ফাইনাল। সেটিতেও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। যাতে মার্তার নিজেরও বড় দায়। দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি মিস করেছিলেন, যেটিতে গোল করলেই স্কোর হয়ে যেত ১-১। শেষ পর্যন্ত ২-০ গোলে হেরে যায় ব্রাজিল।
অথচ সেটি ছিল মার্তারই বিশ্বকাপ। সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি ‘গোল্ডেন বল’ তাঁর, সর্বোচ্চ স্কোরারের ‘গোল্ডেন বুট’-ও। মেয়েদের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডও মার্তারই। সেটি আবার ছেলেদের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রোনালদোর সমান (১৫)। রোনালদো আর মার্তা একই সময়ে খেলেছেন ছেলে আর মেয়েদের দলে। তবে ব্রাজিলের ৯ ও ১০ নম্বরের তুলনা হয়নি কখনো। এই অলিম্পিকে যা হয়েছে ব্রাজিলের দুই ১০ নম্বরের মধ্যে।
সেমিফাইনালে আটকে দিল যে সুইডেন, গ্রুপ ম্যাচে তাদেরই ৫-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল ব্রাজিল। মার্তা করেছিলেন দুই গোল। সেই ম্যাচে মার্তার পায়ে বল যেতেই গ্যালারি থেকে স্লোগান উঠেছে, ‘নেইমারের চেয়েও ভালো।’ ইরাকের বিপক্ষে নেইমারের ব্রাজিলের গোলশূন্য ড্র ম্যাচে ‘মার্তা, মার্তা’ ধ্বনি। প্রথম দুই ম্যাচে ড্র করার পর এমন আলোচনাও হয়েছে, ছেলেদের দলে মার্তাকে নিয়ে নিলে কেমন হয়!
নেইমারের সঙ্গে এই তুলনার প্রসঙ্গটা মার্তার কাছেও তোলা হয়েছিল। তিনি হেসে উড়িয়ে না দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা বিচার করবেন সমর্থকেরা।’ সমর্থকেরা যদি নেইমারের চেয়ে মার্তাকে এগিয়েও রাখেন, তাতে আর লাভ কী!
মার্তার তো আর ‘পেলে’ হওয়া হলো না, তিনি সেই ‘মেসি’ হয়েই থাকলেন!