হেঁটেছি অনেকটা পথ
বহুপ্রতীক্ষিত ক্ষণ দরজায় টোকা মারছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্যালকুলেটরগুলোয় খটাখট ধ্বনি উঠছে প্রারম্ভিক সম্ভাবনার অঙ্ক সাজানোর তাগিদে। ক্রিকেট-বিশ্বের চোখে কতটা উজ্জ্বলতায় আমরা এ মুহূর্তে শোভামান। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের এবারের বিশ্বকাপ আমাদের কতটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে। সম্ভাবনার যে মায়াঞ্জন আমরা এযাবত্কাল সবার চোখে মাখিয়েছি, তার সঙ্গে সমতা রেখে আমাদের ক্রিকেটাররা কি পারবে বিশ্বকাপের মহামঞ্চ মাতাতে? এমন ভাবনায় সময় কাটাতে কাটাতে আমরা দেখলাম অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বহমান প্রস্তুতিপর্বের গা-ঘামানো খেলাগুলো। স্বাগতিকেরা সেসব খেলায় প্রবল প্রভাবে দীপ্যমান। আবহাওয়া সয়ে, উইকেটের ধরন-ধারণ বুঝে নিয়ে আমরা ধাতস্থ হচ্ছি ঢিমেতালে। চারদিকের যা সমীকরণ তা আমাদের ন্যূনতম প্রত্যাশার পালে বাতাস লাগানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা তো ছার, আমাদের প্রবল শক্তিধর বিশ্বকাপজয়ী উপমহাদেশীয় প্রতিবেশীরাও খাবি খাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মাটির দাবি মেটাতে। চলতি ধারাবাহিক সবাই দেখছেন, বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, ত্রিদেশীয় সিরিজটার কথাই ধরুন অথবা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের খেলাগুলো আমাদের প্রস্তুতি ম্যাচ দুটোর কথা নাই-বা বললাম। উচ্চতর মানের দ্রুতগতির বল ব্যবধান রচনা করে দিচ্ছে। গতির কৌশলগত জারিজুরির কথা বাদই দিন, স্রেফ বুনো গতিই বেসামাল করে দিচ্ছে প্রতিপক্ষকে। প্রাচ্য ব্যাটের ডাউন সুইং তাল সামলাতে পারছে না। আর ওই গতির পাল্লা পশ্চিমাদের দিকেই বেশি ঝুঁকে আছে। ওদের ব্যাট পেস বোলিংয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি সাবলীল। অন্যদিকে আমাদের যা প্রবলতর, সেই স্পিনের কুহেলিকা ঝাঁপি খুলতে পারছে না উইকেটের চরিত্রগত কারণে। বল হিলছে না তেমন। মাঝে মাঝে বল লাফানো ছবি ভেসেছে বটে, তবে ও দিয়ে কি আর ধারাবাহিক জাদু দেখানো যায়?
এসব দেখেশুনে তাই প্রত্যাশাগত প্রাপ্তির চিন্তায় কতটা ওপরে যাব ভাবতে ভালো লাগছে না। প্রতিকূলতাসমূহ তো আমাদের জানাই ছিল। সে হিসেবে আমরা কতটা প্রস্তুত হতে পেরেছি সেটাই দেখার বিষয়। তার পরও কথা থাকে। ক্রিকেটে এ মুহূর্তের ভাবমূর্তিই শেষ কথা নয়। গৌরবময় অনিশ্চয়তার কথা বলছি না। বলছি অর্জনই ভাবমূর্তি তৈরি করে আর সে অর্জনের জন্য প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন। এবারের বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জন্য সেই প্রেক্ষাপটই রচনা করতেই পারে যা আমাদের ক্রিকেটীয় ভাবমূর্তিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। আর সেটার জন্য যে দ্বিতীয় পর্ব বা কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যায়ে যাওয়া জরুরি তেমন নয়। ভাবমূর্তির কথা বলছিলাম, সে ভাবমূর্তির সহজ শর্তেই আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে হারাতে পারব বলা যায় অক্লেশে। গ্রুপ পর্বে বাকি রইল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা। স্থান গুণে বা দোষে স্বাগতিক দুদলকে বাস্তবতার নিরিখে হারানোর ইচ্ছা ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংযত রাখতে হচ্ছে। তাই বলে ইংল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কাকে পরাভূত করার বাসনাকে উচ্চকণ্ঠে জানান দিতে অসুবিধা বোধ করছি না। এটুকু স্বপ্নের ছোঁয়া প্রত্যাশায় জড়িয়ে রাখতে চাই। খুব কি বেসুরো শোনাচ্ছে? ওই চার দলের বিরুদ্ধে আমরা কখনো জিতিনি, এমন তো নয়। এ পালায়ও পেয়ে যেতে পারি। মাশরাফির দল যদি নিরেট ঐক্যে যূথবদ্ধ থাকে, যদি আমাদের সাজঘরে পারিবারিক সংহতির আবহ বিদ্যমান থাকে, যদি স্নেহ-শ্রদ্ধার রসায়নে সেই অলৌকিক প্রণোদনা সঞ্চারিত হয় জনে জনে যা মানুষকে সাধ্যসীমা ডিঙিয়ে যেতে সহায়তা করে তবে যা কিছু আপাতত কষ্টচিন্তা তা বাস্তবতার শাপলা ফোটাবে। উপাদেয় ক্রিকেটীয় উপকরণ আমরা ইতিমধ্যে অর্জন করেছি। অনুকূল পারিপার্শ্বে আমাদের পেসাররা ফসল তুলতে পারলে সহযোগের জন্য বাকি অনুষঙ্গ নিয়ে আমরা বসে আছি। ভালো কিছু আমরা ঘটাতেই পারি। তবে দ্বিতীয় পর্বে যেতে পারি বা না-ই পারি ভাবমূর্তি উন্নয়নে সেটাই মুখ্য নয়। আমাদের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আছেন তার কাছাকাছি আরও দু-চারটি মুখ ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ক্রিকেট-বিশ্বের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠে বাংলাদেশ যে আগামীতে, আসন্ন আগামীতে শিরোপাপ্রত্যাশীদের দলে নাম লেখাতে যাচ্ছে সেটুকুর আভাস রেখে আসুক অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। দলটি যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম, তার প্রস্তুতি সব সময় বিজয় অভিসারী, এ রকম সুপ্ত চেহারাটা বেঁধে দিয়ে আসুক এবার বিশ্বকাপের ফ্রেমে। বয়সের গড়ে আমরা এবার বিশ্বকাপের তরুণতম দল। জয়-পরাজয়ের হিসাবে না গিয়েও চোখধাঁধানো ফিল্ডিং দিয়ে, হরিণক্ষিপ্র রানিং বিটুইন দ্য উইকেট দিয়ে, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে পার্টনারশিপ গড়ে, দল উজ্জীবিত করার সম্মিলিত তাড়নায় উজ্জ্বল একটি দলের চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরুক বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা, বৈরী পরিবেশের আওতার নিরিখে কোনো অযৌক্তিক ব্যর্থতা যেন আমাদের দলীয় শক্তি প্রদর্শনের পথে বাধা না হয়, সেটাই চাইব।
বিশ্বকাপ থেকে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবকিছু নয়। বিশ্বকাপটাকে উপভোগের অন্য অনুষঙ্গও আমাদের আছে। আমরা বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলছি, খেলে কিছু একটা উল্লেখযোগ্য করতে চাইছি, এটাও বড় মাপের এক আনন্দ উপভোগ। এ রকম কথায় আজকের প্রজন্মের ক্রিকেটানুরাগীরা উপহাস করার খোরাক অবশ্যই পেতে পারেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পুরোনো দিনের সহযাত্রীরা জানেন এই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণটাই একদিন আমাদের জন্য পদ্মভুক-স্বপ্নের শামিল ছিল। কিন্তু স্বপ্নটা আমরা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়েও দেখেছিলাম এবং আমাদের ছেলেরা সে স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করবে বলে ব্যাট-বল হাতে ঘাম ঝরানো শুরু করেছিল। আজ সে চাওয়া এক চরম বাস্তবতা। পেছনে ফিরে দেখলে তাই কী পাব না-পাব ভেবে কাতর না হয়ে কী পেয়েছি সেটাই বড় হয়ে ওঠে। স্বপ্ন ছোঁয়ার আনন্দটা আরও বড় স্বপ্নের দিকে তাড়িত করে বটে তবে প্রাথমিক প্রাপ্তির আনন্দের রেশটা চলমান থাকে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট এলেই তাই উঠে আসার রোমাঞ্চটা ফিরে ফিরে আসে। সামনে আরও বড় প্রাপ্তিযোগ আছে, ভরসা পাই।
এক দিবসী বিশ্বকাপটা যখন শুরু হয় সেই ১৯৭৫ সালে তখন আমরা আইসিসির সহযোগী সদস্যও নই। আমাদের ক্রিকেট তখন একেবারে আঁতুড়ঘরে। বিশ্বকাপ তখন, যারা এ দেশে ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে সাহস পেতেন তাঁদের কাছে অনেক সুদূরের বিষয়। কিন্তু তাঁরা সুদূরের পিয়াসী ছিলেন। দীর্ঘশ্বাসে শক্তি খুঁজেছিলেন স্বপ্ন ছোঁবেন বলে। প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে লর্ডসে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের সুনীল গাভাস্কারের করা ৬০ ওভারে অপরাজিত ৩৬ রানের ইনিংসের মতোই ছিল তখনকার বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবস্থা। ধীরগতি, আপাত-অকার্যকর কিন্তু টিকে থাকার মতো গুণাগুণে সবল। গাভাস্কারের ঊর্ধ্বমার্গে স্থায়ী অবস্থানের আদলেই সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়েছে বিশ্বকাপে, বলা ভালো বিশ্ব ক্রিকেটে স্থায়ী অবস্থানের দিকে। বিশ্বকাপ এলেই তাই বিশ্বকাপের যাত্রাপথের আনন্দ-বেদনা নতুন করে আনন্দ শিহরণে পুলক জাগায়। আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে প্রথম আইসিসি ট্রফি খেলি ১৯৭৯-তে। আমাদের পিছে ফেলে জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা পৌঁছে যায় কুলীন সমাজে। আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হয় প্রায় দুই দশক। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জেতার পর সুযোগ আসে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার, সেই সূত্রে বিশ্বকাপের পরপরই অর্জিত হয় টেস্ট স্ট্যাটাস। তত দিনে অনেক চড়াই পার হতে হয়েছে। অনেক বিদ্রূপ-কটাক্ষের ফাঁক গলে উত্সাহের ঢল বয়ছে। ছয়-ছয়টি বিশ্বকাপের প্রবাহ কেটেছে দীর্ঘশ্বাসের প্রহর গুনে। তারপর ১৯৯৯। সপ্তম বিশ্বকাপে আমাদের প্রথম পা রাখা। স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর নর্দাম্পটনে পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকে জানান দেওয়া আমরা এসেছি। পরের তিন বিশ্বকাপে দেখলাম একটা খারাপ যায় তো একটা ভালো। আফ্রিকার মাটিতে সুবিধা হয়নি, পরেরবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে পুষিয়ে নিয়েছি ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। ২০১১-তে স্বাগতিক ছিলাম, সুবিধা করতে পারিনি। সেই কাকতালীয় সংস্কারের আওতায় সব প্রতিকূলতা মাথায় নিয়েই আশা করছি ভালো কিছু করব। এ লাইনটি যখন লিখছি তখন প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৫ রানে ২ উইকেট হারিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। তামিম ও রিয়াদ ১৯০-তে নিয়ে গেছে। এই মাত্র তৃতীয় উইকেটের পতন ঘটল, রিয়াদ ৮৩ রানে রানআউট হওয়ায়। ফলাফল যা-ই হোক এ রকম হলেই আমাদের মন ভরবে। এ রকম লড়াকু চেহারার বাংলাদেশকে দেখে দেখে বিশ্বকাপটা উপভোগ করতে চাই। পেছনে দেখলেই ভালো লাগে। বহুদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ জেতার আগ্রহ শিগগিরই আসবে। তার আগে দু-একটা যুব বিশ্বকাপ জিতে নিই। আপাতত সেই সাধনায় যত্নবান হয়ে আসুন বিশ্বকাপটা উপভোগ করি।