ইকার ক্যাসিয়াসের কাছে মনে হয়েছিল, বিশ্বকাপ জেতার চেয়েও এই ট্রফি তাঁকে বেশি তৃপ্তি দিয়েছে। অস্বাভাবিক নয়। দুবারের চেষ্টাতেই বিশ্বকাপ জিতেছেন, যেখানে চ্যাম্পিয়নস লিগ ১২ বছর ধরে তাঁকে নাকানিচুবানি খাইয়েছে। ওদিকে পেপ গার্দিওলা বলছেন, চ্যাম্পিয়নস লিগের চেয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জেতা কঠিন। যদিও এতে আপত্তি তুলতে পারেন রোনালদো নাজারিও বা ইব্রাহিমোভিচ। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে দুজনেরই যে অপ্রাপ্তির নাম এই চ্যাম্পিয়নস লিগ। ২৮ মে প্যারিসে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। ভালোবাসার শহর কাকে বরমাল্য দেয়, সেটা জানতে এখন সবার অধীর অপেক্ষা। এই ফাইনাল উপলক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিদিন থাকছে বিশেষ আয়োজন। প্রথম দিনে চলুন আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক চ্যাম্পিয়নস লিগের স্মরণীয় পাঁচ ফাইনালের স্মৃতি। আজ প্রথম পর্বে দুই ফাইনাল—
১৯৯৪, এসি মিলান-বার্সেলোনা (৪–০)
প্রেক্ষাপট
বার্সেলোনা: লিগ চ্যাম্পিয়ন (টানা ৪ বার)
এসি মিলান: লিগ চ্যাম্পিয়ন (টানা ৩ বার)
ফেবারিট: বার্সেলোনা।
ইয়োহান ক্রুইফের ড্রিম টিম তখন উড়ছে। মৌসুমের শেষ অর্ধে প্রতিপক্ষকে ভাসিয়েছে গোলবন্যায়। অন্যদিকে লিগ জিতলেও সর্বশেষ ৬ ম্যাচে জেতেনি মিলান, হেরেছে দুটি। দীর্ঘমেয়াদি চোট মার্কো ফন বাস্তেনকে আগেই কেড়ে নিয়েছিল, সে সময়কার বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার জিয়ানলুইগি লেন্তিনিও চোটের কাছে হার মেনেছেন। তবে মিলানের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ ছিল রক্ষণ। ইউরোপের সেরা আক্রমণ বনাম সেরা রক্ষণের লড়াই। সে ম্যাচেই কিনা নিষেধাজ্ঞার কারণে নেই মিলানের রক্ষণজুটি ফ্রাঙ্কো বারেসি ও আলেসান্দ্রো কোস্তাকুর্তা! ম্যাচের আগে সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, এ ম্যাচটা শুধু আনুষ্ঠানিকতার। ট্রফিটা বার্সেলোনাতেই যাচ্ছে।
ম্যাচে যা হলো
ইউরোপিয়ান ফুটবলে তখন মাত্র তিন বিদেশি খেলোয়াড়কে নামানো যেত। তাই ব্রায়ান লাউড্রপ, জঁ পিয়েরে পাঁপাদের বসিয়ে রাখতে হয়েছিল মিলান কোচ ফ্যাবিও ক্যাপেলোকে। বার্সেলোনা কোচ তাঁর স্বপ্নের দল থেকে বসিয়ে রেখেছিলেন ডেনিশ তারকা মাইকেল লাউড্রপকে। যাতে খুবই খুশি হয়েছিলেন ক্যাপেলো। ম্যাচ শেষে তা প্রকাশও করেছিলেন এই বলে, ‘লাউড্রপকে নিয়েই ভয়ে ছিলাম আমি এবং ক্রুইফ ওকে বাদ দিয়েছে। বড় ভুল করেছে।’
ক্রুইফকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। রোনাল্ড কোমান আর মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা দুই ফুটবলার রোমারিও ও স্টইচকভের মধ্যে যেকোনো একজন বসিয়ে রাখার চেয়ে লাউড্রপকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটাই সবচেয়ে বেশি যৌক্তিক।
ম্যাচ–পূর্ব আলোচনায় পিছিয়ে থাকলেও ম্যাচের শুরু থেকেই দাপট ছিল মিলানের। সবাই বার্সেলোনাকে ফেবারিট ধরে নিয়েছে, তাঁদের কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না, এটা অহমে লেগেছিল মালদিনিদের। দুই উইঙ্গারের গতি ও দেয়ান সাভিসেভিচের ড্রিবলিং বার্সেলোনাকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। ২২ মিনিটে সাভিসেভিসের পাশ থেকে দানিয়েল মাসেরোর প্রথম গোল। বিরতির এক মিনিট আগে দোনাদোনির দুর্দান্ত এক দৌড়ের ফল তুলে দ্বিতীয় গোল মাসারোর।
বিরতির পরই নিজের কষ্টের ফসল তুলেছেন সাভিসেভিচ। ৪৭ মিনিটেই ৩ গোলে পিছিয়ে পড়া বার্সেলোনার কষ্টটা বাড়িয়েছেন মার্সেল দেশাই। ১১ মিনিট পর ৪-০ হয়ে গেল। স্বপ্নের দলের ভরাডুবির যন্ত্রণা আর বাড়ায়নি মিলান।
২০০৬, বার্সেলোনা-আর্সেনাল (২–১)
প্রেক্ষাপট
বার্সেলোনা: লিগ চ্যাম্পিয়ন (টানা ২ বার)
আর্সেনাল: চতুর্থ
ফেবারিট: বার্সেলোনা।
সেবার দুর্দান্ত খেলছিল আর্সেনালের রক্ষণভাগ। ফাইনালের আগে ১২ ম্যাচে গোল খেয়েছিল মাত্র দুটি। নকআউট পর্বে তিন প্রতিপক্ষ ছিল রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস ও ভিয়ারিয়াল। এমন তিন দলের বিপক্ষেও কোনো গোল হজম করেনি আর্সেনাল! ম্যাচের আগে এই প্রতিযোগিতায় টানা ৯১৯ মিনিট কোনো গোল খায়নি আর্সেনাল রক্ষণ। কিন্তু উল্টো দিকে বার্সেলোনার ছিল রোনালদিনিও, ডেকো ও স্যামুয়েল ইতোসমৃদ্ধ আক্রমণভাগ। মৌসুমে ১১৪ গোল করে ফাইনাল খেলতে নেমেছিল এই দল। লড়াইটা ছিল তাই বার্সার আক্রমণ আর আর্সেনালের রক্ষণের।
ম্যাচে যা হলো
ম্যাচ–পূর্ব আলোচনাটা ছিল ইতো ও রোনালদিনিওকে নিয়ে। ইতো গোল পেয়েছেন, হয়েছেন ম্যাচসেরাও। তবে ম্যাচের গতিপথ বদলে দেওয়ার কৃতিত্ব হেনরিক লারসেনের। ম্যাচ শেষে আর্সেনালের থিয়েরি অঁরি বলেছিলেন, ‘সবাই তো ইতো ও রোনালদিনিও, গিলিদের নিয়ে কথা বলে। আমি আজ তাদের কাউকে দেখিনি। আমি হেনরিক লারসেনকে দেখেছি।’ বার্সেলোনার জার্সিতে সেদিন শেষবারের মতো খেলতে নেমেছিলেন সুইডিশ কিংবদন্তি।
পার্ক দে প্রিন্সেসে ১৮ মিনিটেই লাল কার্ড দেখেছিলেন আর্সেনাল গোলকিপার ইয়েনস লেম্যান। তারপরও ৩৭ মিনিটে অ্যাশলি কোলের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল আর্সেনালই। একের পর এক আক্রমণের পরও গোল করতে পারছিল না বার্সা। ৬১ মিনিটে লারসেন মাঠে নামার পরই ম্যাচের চিত্র বদলে যায়।
৭৬ থেকে ৮০ মিনিট—৫ মিনিটের মধ্যে দুটি গোল করে ফেলেন ইতো ও লুদোভিচ গিলির। দুটিতেই অবদান ছিল লারসেনের। রক্ষণ বনাম আক্রমণের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়টা আক্রমণেরই হয়েছিল। যদিও ৭০ মিনিটের বেশি ১০ জন নিয়ে লড়ার আক্ষেপটা সারা জীবনের জন্য সঙ্গী হয়ে গেছে আর্সেন ওয়েঙ্গারের।