স্বপ্ন দেখতেও ভয় পান মাবিয়া!
>অযোগ্য কোচের অধীনে প্রস্তুতি, এশিয়ান গেমসে কোনো আশাই দিতে পারছেন না ২০১৬ সালে এসএ গেমসে সোনাজয়ী মাবিয়া
ভারতীয় ভারোত্তোলক রাখি হালদারের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব মাবিয়া আক্তার সীমান্তর। অবসরে দুজনের মধ্যে মুঠোফোনে আলাপ চলে। মাঝেমধ্যে অনুশীলনের ভিডিও পাঠান রাখি, যা দেখে শুধু আফসোস করেন দক্ষিণ এশিয়ান (এসএ) গেমসে সোনাজয়ী বাংলাদেশের ভারোত্তোলক। যে কমপ্যাক্ট মাল্টি জিমে রাখিদের অনুশীলন চলে সেটার তুলনায় মাবিয়াদের অনুশীলনঘর কত ছোট। পল্টনে আইভি রহমান সুইমিং কমপ্লেক্সের সামনে ছোট একটা গুদামঘরের মতো জায়গায় ঠাসাঠাসি করে অনুশীলন করেন মাবিয়ারা। সরঞ্জাম এতই কম যে একজনের অনুশীলন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয় আরেকজনকে। গত পরশু বিকেলে জিমনেসিয়ামে ঢুকতেই দেখা গেল নোংরা মেঝের একপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে গোটা কয়েক ডাম্বেল ও প্লেট। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নষ্ট দীর্ঘদিন। এমন পরিবেশেই ইন্দোনেশিয়ায় ১৮ আগস্ট শুরু হতে যাওয়া এশিয়ান গেমসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন মাবিয়া।
মাবিয়া এই প্রথম এশিয়ান গেমসে যাচ্ছেন। চার বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় (ইনচন) এশিয়ান গেমসে গিয়েছিলেন, কিন্তু অংশ নিতে পারেননি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) অনুমতি না মেলায়। মাবিয়াসহ আটজন ভারোত্তোলক গিয়েছিলেন গত এশিয়ান গেমসে। কিন্তু বিওএ কর্মকর্তারা এবার ভারোত্তোলন থেকে একজনকে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সবেধন নীলমণি সেই ভারোত্তোলক মাবিয়া এক মাস ধরে এশিয়াডের জন্য অনুশীলন করে চলেছেন।
এসএ গেমসে ৬৩ কেজিতে সোনা জিতে পদকমঞ্চে জাতীয় সংগীতের মূর্ছনায় কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন। তারপরই জীবনটা বদলে গেছে মাবিয়ার। খিলগাঁওয়ের বস্তিবাসিনী মেয়েটার স্বপ্নের সীমানাটা যায় বেড়ে। কিন্তু দুই বছর যেতে না-যেতেই সেই মাবিয়া যেন স্বপ্ন দেখতে আর সাহস পান না। এশিয়াডে কোনো পদক পাবেন না জানেন। কিন্তু নিজের সেরাটা দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিতে পারছেন না, ‘আমার পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। আগে যে স্বপ্ন দেখতাম, সেটা এখন আর নেই।’
মাবিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা অনুশীলন। পর্যাপ্ত অনুশীলনসুবিধা তো পাচ্ছেনই না, উল্টো যে কোচের অধীনে বর্তমানে অনুশীলন করছেন তাঁর সামর্থ্য নিয়েই প্রশ্ন আছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অভিজ্ঞ তিন কোচ ফারুক সরকার, মোতালেব হোসেন ও শাহরিয়ার সুলতানা শুচিকে বাদ দিয়ে ফেডারেশন এশিয়ান গেমসের জন্য কোচ করেছে ফিরোজা পারভীনকে। আনসারের বর্তমান খেলোয়াড় ফিরোজা মাবিয়ার সঙ্গে ভারতে গিয়ে গত এসএ গেমসে ৭৫ কেজিতে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কোচেস কোর্স করেননি ফিরোজা। শুধু বেসরকারি উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপিএড (ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন) শেষ করেছেন। এমন কোচ নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক পাওয়া যে সম্ভব নয় মাবিয়া সেটা জানেন, ‘বিদেশি কোচ এখন দিতে পারবে না ফেডারেশন, কিন্তু এনএসসির কোনো কোচ তো দিতে পারত। ওনারা অনুশীলনের আধুনিক টেকনিকগুলো জানেন। তাঁদের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি। এখন যিনি (ফিরোজা) আছেন তিনি বড়জোর জুনিয়রদের অনুশীলন করাতে পারবেন।’
দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের ওজন শ্রেণিতে মাবিয়া সেরা। গত দুই বছরে আজারবাইজানে ইসলামিক সলিডারিটি গেমস, তুর্কমেনিস্তানে এশিয়ান ইনডোর ও মার্শাল আর্ট গেমসে এবং কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নিয়েছেন। আজারবাইজানে তোলেন ১৭৯ কেজি, তুর্কমেনিস্তানে ১৭৪ কেজি এবং কমনওয়েলথ গেমসে ক্যারিয়ার-সেরা ১৮০ কেজি! গত বছর জাতীয় ভারোত্তোলনে রেকর্ড (১৭২ কেজি) গড়ে তুলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
পারফরম্যান্সে উন্নতি হলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে কতটা পিছিয়ে মাবিয়া, সেটা এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়। আজারবাইজানে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে সোনাজয়ী তুর্কমেনিস্তানের পলিনা গুরইয়েভা তোলেন ১৯৩ কেজি। এই ইভেন্টে এশিয়ান ইনডোরে সোনা জেতেন চীনের ইউয়ান গুয়াংজিয়ান ২২৩ কেজি ভার তুলে। আর গত কমনওয়েলথ গেমসে সোনাজয়ী কানাডার মাউদি শ্যারন তোলেন ২২০ কেজি। সেখানে মাবিয়ার সেরাই ১৮০ কেজি!
গত দুই বছরে ক্ষমতার পালাবদলে ভারোত্তোলন ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার বদলেছে তিনবার। কিন্তু বদলায়নি অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা। একটা আন্তর্জাতিক মানের জিমনেসিয়াম নেই, দক্ষ কোচ নেই, বেশি বেশি টুর্নামেন্ট খেলা হয় না। এই তিনটি চাওয়া পূরণ না করলে মাবিয়াদের দিয়ে পদক জয়ের আশা না করাই ভালো।