চোটের কারণে নেইমার বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ায় সেমিফাইনালের আবহটাই মিইয়ে গেল। এটা খুবই দুঃখের। স্বাগতিক দলের সেরা খেলোয়াড় ছিল সে। এর সঙ্গে আবার টুর্নামেন্টে দুই হলুদ কার্ড দেখায় থিয়াগো সিলভাও খেলতে পারবে না সেমিফাইনালে। তার মানে দলের দুই সেরা খেলোয়াড়কে ছাড়া জার্মানির বিপক্ষে মাঠে নামছে ব্রাজিল। স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা থাকা সত্ত্বেও টুর্নামেন্টে এই প্রথমবার ব্রাজিলকে কেমন ছন্নছাড়া দল মনে হচ্ছে।
এখন দেখার বিষয় এটা শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে কিনা। ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা এখন নিজেদের প্রত্যাশার বিশাল চাপ থেকে মুক্ত ভেবে স্বচ্ছন্দে খেলতে পারেন কি না। বিকল্প খেলোয়াড়দের সামনে এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ নিজেকে প্রমাণ করার। তারা সেটা পারে কি না দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
পরিসংখ্যান বলছে, ব্রাজিল-কলম্বিয়া ম্যাচে ৫৪টি ফাউল হয়েছে। অনেকেই পরিসংখ্যানটা দেখে খুব হতাশ। আমি একটু অন্যভাবে দেখি সবকিছু। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল তো আর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খোশগল্প করার আসর নয়। ট্যাকল হবে না, বলের জন্য কাড়াকাড়ি হবে না—তাহলে আর ফুটবল নাকি! নেইমারের মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়াটা যেমন দুঃখজনক, তেমনি দুঃখজনক এর জন্য কলম্বিয়ার হুয়ান জুনিগাকে দায়ী করাও। এটা ইচ্ছাকৃত নয় বরং আমার কাছে মনে হয়েছে আনাড়িপনার কারণে হয়েছে। হয়তো আমার দেখার ভুল হতে পারে। দেখা যাক ফিফা তদন্ত করে কী বলে।
কলম্বিয়ার সঙ্গে ২-১ গোলের জয়টা এ পর্যন্ত ব্রাজিলের সেরা ম্যাচ। এর আগে ব্রাজিলের খেলায় ছিল ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, বল নিয়ে তারা অনেক বেশি ছুটোছুটি করেছে। কিন্তু ওই ম্যাচে তারা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে খেলেছে এবং দল হিসেবে তারা অনেক পাসনির্ভর ফুটবল খেলেছে।
ফ্রান্সের বিপক্ষে জার্মানির ১-০ গোলের জয় দেখেও আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি। ব্যবধান সর্বনিম্ন হলেও জার্মানি জয়টাই প্রত্যাশিত ছিল। ম্যাচে ফরাসিদের সমতা ফেরানোর সুযোগ যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি সুযোগ ছিল জার্মানির ব্যবধান বাড়ানোর। জোয়াকিম লোর দল খুবই বুদ্ধিমত্তা ও চাতুর্যের সঙ্গে খেলেছে। সাফল্যের জন্য এটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
অনেক দিন ধরে একটা বিতর্ক চলছে। ফিলিপ লামকে তার আসল জায়গা রাইটব্যাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত নাকি মাঝমাঠেই খেলানো উচিত। আমি মনে করি না এ নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক হওয়া উচিত। লাম যখন রাইটব্যাকে খেলে তখনো সে বিশ্বসেরা, যখন সে মিডফিল্ডার হিসেবে খেলে তখনো বিশ্বসেরা। একই কথা বলা যায় ম্যানুয়েল নয়্যার সম্পর্কে। সে গোলবারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকুক কিংবা পেনাল্টি বক্সের বাইরে বেরিয়ে আসুক, এ মুহূর্তে সেই বিশ্বসেরা গোলরক্ষক।
লোর ভাগ্যটাও ভালো বলতে হবে। স্যামি খেদিরার উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। রিয়ালের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে যখন খেদিরা নামল, ওকে দেখে মনে হয়নি সেরা ছন্দে আছে। একটা কারণ হতে পারে সে অনেক দিন খেলার বাইরে ছিল। কিন্তু আলজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে তাকে দেখে মনে হলো হঠাৎ করেই যেন সে ছন্দ ফিরে পেয়েছে। মাঝমাঠে খেদিরা আর শোয়েনস্টাইগার—জার্মানির জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!
ব্রাজিল-জার্মানি ছাড়া অন্য সেমিফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা-হল্যান্ড । সেরা দলগুলোই উঠেছে সত্যি। তবে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা চমক হওয়ার খুব কাছে চলে গিয়েছিল কোস্টারিকা। ডাচরা পেনাল্টিতে উতরে গেছে। আমি ভবিষ্যদ্রষ্টা নই। তবে রোবেন যদি এভাবে খেলতে থাকে, সে অথবা ম্যানুয়েল নয়্যার হতে পারে এই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়।
আর্জেন্টিনার ব্যাপারে নতুন কিছু বলার নেই। বরাবরের মতোই তারা লিওনেল মেসির ওপর নির্ভর ছিল। বেলজিয়ামের বিপক্ষে একমাত্র গোলটা করে তাদের উদ্ধার করেছে গঞ্জালো হিগুয়েইন। আর গোল করার পরে তাদের একটাই দর্শন ছিল, সবাই রক্ষণ আগলে বসে থাকো। আর্জেন্টিনার ডাচদের হারাতে পারবে কি না এটা অনেকটা নির্ভর করছে চোট থেকে সময়মতো ডি মারিয়া ফিরতে পারে কি না তার ওপর। সে আর্জেন্টিনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
শেষ কথা হচ্ছে, ফুটবলের চার পরাশক্তি খেলছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। দুটি দক্ষিণ আমেরিকান, দুটি ইউরোপিয়ান। এদের যে কারও সামর্থ্য আছে যে কাউকে হারানোর। সুতরাং এখন আর কোনো চমক নেই।
তবে নাটকের অপেক্ষা তো থাকছেই।