রাঙিয়ে দিয়ে যাও...
>বিশ্বকাপ এবারই শেষবারের মতো দেখবে ধোনি, গেইল, মালিঙ্গা ও মাশরাফিকে। যাওয়ার আগে কি রাঙিয়ে দিয়ে যেতে পারবেন তাঁরা? আশায় আছেন আবিদুল ইসলাম
আগমনের ভৈরবী আর বিদায়ের বেহাগ—একই সময়ে আনন্দ–বিষাদের যুগপৎ এই অনুভূতি একজনেরই হতে পারে, সে কনের বাবা। বাদক দলের ভৈরবীর মূর্ছনায় কনের বাড়িতে হয় বরাগমন। কনের বাবার সেকি আনন্দ তখন! আর কনে বিদায়ের সময় সানাইয়ের সুরলতিকায় বাঁধা বেহাগের মালা কনের বাবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চাবুকের মতো লাগে!
লিখতে বসা বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে। সেখানে কনের বাবাকে টেনে আনা কেন? সেটা লেখার বিষয়ের কারণেই। মাশরাফি বিন মুর্তজা, মহেন্দ্র সিং ধোনি, ক্রিস গেইল আর লাসিথ মালিঙ্গা ইংল্যান্ডে পা রাখবেন ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে। সেই শেষের শুরুর ক্ষণে চারজনের মনের অবস্থা কনের বাবার মতোই তো হওয়ার কথা।
হৃদয়ের নহবতখানায় তাঁদের বেজে উঠবে আরেকটি বিশ্বকাপের আগমনের ভৈরবী। চারদিকে বইবে উদ্দাম আনন্দস্রোত। সেই আনন্দলহরির গভীরে মাশরাফি–গেইলদের মনে বেহাগের করুণ রাগিনীও কি বাজবে না! শেষের শুরু বলে কথা।
বেদনাতুর সেই মুহূর্তে দুচোখের কোণে দুফোঁটা জলও হয়তো জমবে! না, জাতীয় সংগীতের আবেগ, জাতীয় পতাকার পতপত আর গ্যালারির কোলাহলে সে জলকণা কারও চোখে পড়বে না। মাশরাফি, গেইল, ধোনি, মালিঙ্গারাও হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছবেন না। কিন্তু স্ফটিকস্বচ্ছ অদৃশ্য সে জলকণাকে যদি প্রেক্ষাগৃহের পর্দা ধরেন, সেখানে কী দেখা যাবে? খুব মনোযোগে চোখ রাখলে একে একে ভেসে ভেসে উঠবে এই চার ‘ক্রিকেট মহিরুহের’ বিশ্বমঞ্চের যত মায়াবী ছবি, কত কীর্তি।
বিশ্বমঞ্চে ধোনির আবির্ভাব ২০০৭ সালে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে। তরুণ ধোনি সেবার তাঁর দল ভারতকে ক্যারিবীয় উপকূলে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে দেখেছেন। তিনটি ম্যাচের দুটি হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই পত্রপাঠ বিদায়! কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরে চার বছর পেরিয়ে ধোনি যখন আবার বিশ্বমঞ্চে, তিনি তখন টগবগে এক তরুণ। ঘোড়ার খুরে খুরে টগবগ করে দলকে নিয়ে এগিয়ে চলছিলেন বীরদর্পে।
২০১১ বিশ্বকাপে বিশ্ব দেখেছে নেতা ধোনিকে। কখনো তিনি যোগ্য একজন অধিনায়ক, কখনো চৌকস উইকেটকিপার, কখনো আবার ‘দ্য ফিনিশার’। মুম্বাইয়ে ফাইনালের কথাই ধরুন। শচীন টেন্ডুলকারের ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়েতে ফাইনাল। ভারতের ‘ক্রিকেট ঈশ্বরের’ আবার শেষ বিশ্বকাপ! টেন্ডুলকারের সেই ফাইনালটা রাঙিয়ে নিলেন নিজের রঙে। ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে তুলে এনে খেলেছেন ৭৯ বলে ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংস।
ধোনির হাতে উঠেছে ম্যাচসেরার পুরস্কার। আর মাথায় স্বর্ণবিন্দুছটার মতো বিশ্বকাপের মুকুট।
এখানেই বাকি তিনজন পিছিয়ে ধোনির চেয়ে। গেইল আর মালিঙ্গার দলীয় সাফল্য বলতে বিশ্বকাপে তেমন কিছু নেই। গেইলের বিশ্বকাপ অভিষেক ২০০৩ সালে। খেলেছেন চারটি বিশ্বকাপ। প্রথম দুটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নকআউট পর্বেই উঠতে পারেনি। পরের দুবার ছিটকে গেছে শেষ আট থেকে। কিন্তু এরই মধ্যে গেইল বিশ্বকাপে খেলে ফেলেছেন ২৬টি ম্যাচ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২৫টি সেঞ্চুরির ২টি বিশ্বমঞ্চে। তবে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংসটি এখানেই, গত বিশ্বকাপে ক্যানবেরায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২১৫। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ডাবল সেঞ্চুরি দর্শন এটাই প্রথম।
স্বঘোষিত ‘ইউনিভার্স বস’ গেইলকে যদি বিশ্বকাপ মনে রাখে ডাবল সেঞ্চুরির জন্য, মালিঙ্গাকেও মনে রাখতে হবে আরেকটি ডাবলের জন্য। বিশ্বকাপকে ডাবল হ্যাটট্রিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রঙিন কোঁকড়ানো চুল আর ব্যতিক্রমী বোলিং অ্যাকশনের জন্য বিখ্যাত মালিঙ্গাই। আর সেটিও নিজের অভিষেক বিশ্বকাপে। ২০০৭ সালে সেই ‘ডাবল হ্যাটট্রিক’টি মালিঙ্গা করেছিলেন গায়নার প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে সুপার এইটের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।
রইল বাকি মাশরাফি। আগের তিনজনের ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে এমন ‘ব্যাটচিহ্ন’ বা ‘বলচিহ্ন’ রেখে যাওয়ারই কথা। তিনজনই এসেছেন ঋদ্ধ ক্রিকেট–সংস্কৃতি থেকে। ভারতে তো অনেক দিনই ক্রিকেট এক উন্মাদনার নাম। একটা সময়ে ক্রিকেটে রাজত্ব করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শ্রীলঙ্কার তেমন ঐতিহ্য না থাক, একটা বিশ্বকাপ ট্রফি তো ঘরে তুলতে পেরেছে! ফাইনাল খেলেছে আরও দুটি।
মাশরাফির তেমন কি ছিল? বাংলাদেশ অধিনায়ক নিজেই বরং ক্রিকেটে হোঁচট খেতে খেতে চলা একটি দলকে শক্ত–সামর্থ্য করে তুলেছেন! দেখতে দেখতে খেলে ফেলেছেন ৩টি বিশ্বকাপ। গেইলের সঙ্গে ২০০৩ সালেই বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাব মাশরাফির। তরুণ মাশরাফি সেবার ২ ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। এরপরই চোট পেয়ে ছিটকে পড়লেন। এরপর বিশ্বকাপে খেলে ফেলেছেন আরও ১৪টি ম্যাচ, পেয়েছেন আরও ১৬টি উইকেট। ২০১১ সালে দেশের মাটির বিশ্বকাপে তাঁকে খেলতে দেয়নি চোট। নইলে গেইলের মতো তাঁরও পঞ্চম বিশ্বকাপ হতো এবার।
মাশরাফির চোখের কোনায় স্ফটিকস্বচ্ছ জলকণায় তাকালে ২০১১ বিশ্বকাপ না খেলতে পারার আক্ষেপটা হয়তো দেখা যাবে। তবে ওই জলকণার আরেকটু গভীরে তাকালে স্পষ্ট করেই দেখা যাবে, কীভাবে একটা দলকে এক হাতে শিশু থেকে বড় করে তোলা যায়! ২০০৭ বিশ্বকাপের কথাই ধরুন, মাশরাফি তখন একেবারেই তরুণ। ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচের আগে কী মনে করে বলে দিয়েছিলেন, ‘ধরে দিবানি।’ তারকা সমৃদ্ধ ভারতকে সেই ম্যাচে ঠিকই ধরে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ভারতকে ১৯১ রানে অলআউট করে দিতে মাশরাফি করেছিলেন বিশ্বকাপে তাঁর সেরা বোলিং (৪/৩৮)। সেদিন থেকে ‘ধরে দিবানি’—এই বাক্যটি বাংলাদেশের ক্রিকেট উপকথারই অংশ হয়ে গেছে!
সেই মাশরাফি ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে পুরোদস্তুর এক যুবক। অনেক ঘাত–প্রতিঘাতে পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা! যোগ্য এক নেতা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল বিশ্বাস করতে শুরু করে, ‘আমরা করব জয়।’ সেই সাহস বুকে রেখেই সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে খেলেছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল। তাহলে এবার কি ফাইনাল? যাওয়ার আগে মাশরাফি বলে গেছেন, ‘কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।’ অমনি পুরো দল তাঁর কণ্ঠে সুর মিলিয়ে একই কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে।
বিশ্বকাপের এবার সময় এসেছে এই চারজনকে বিদায় জানানোর। চারজনের মধ্যে বিশ্বজয়ের মুকুট একজনেরই আছে। বিদায়বেলায় বাকি তিনজনকে তো আর একই সঙ্গে মুকুট পরিয়ে বিদায় দেওয়া যাবে না। হয়তো এঁদের কেউই পারবেন না মুকুট পরে বিদায় নিতে। বিদায়বেলায় তাঁদের কাছেই–বা কী চাওয়া থাকবে বিশ্বকাপ বা ক্রিকেট–বিশ্বের?
‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও, যাও গো এবার যাবার আগে’—মাশরাফি, ধোনি, গেইল আর মালিঙ্গার কাছে এ ছাড়া আর কীই–বা চাওয়ার থাকতে পারে!