যেভাবে ঈদ হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশে
>জনসংখ্যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। এশিয়ান গেমস দেখতে সেখানে আছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি মাসুদ আলম। ইন্দোনেশিয়ায় কীভাবে উদ্যাপিত হয় ঈদ, তা-ই উঠে এল তাঁর প্রতিবেদনে
তরুণ টিভি রিপোর্টার তাঁর স্টেশনের জন্য লাইভ করছেন সামনে অনেকগুলো গরু নিয়ে। পাশে আরও কয়েকটি টিভি ক্যামেরা। সবাই লাইভে ব্যস্ত। গরু কীভাবে জবাই হবে, কারা কী করছেন, ঈদ কেমন কাটছে, এসবই উঠে আসছে রিপোর্টারদের কথায়। জাকার্তায় এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইশগেতলাল মসজিদ প্রাঙ্গণের এই দিকটায় যা একটু মানুষজন। তাও সাধারণ মানুষ হাতে গোনা। কোথাও কোথাও টিভি ক্যামেরার সংখ্যা মানুষের চেয়ে বেশি।
সকালে এখানে ঈদের জামাত হয়েছে। কিন্তু বায়তুল মোকাররম মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মানুষের যে উচ্ছ্বাস, তা এখানে নেই। জামাত শেষে মসজিদ চত্বর প্রায় ফাঁকা। বেলা ১১টার দিকে দেখা গেল মসজিদের সামনের অংশে বেড়াতে আসা এক কুয়েতি নারী ছবি তেলায় ব্যস্ত। এক চীনা পরিবার এসে দল বেঁধে ঘুরছে। ছবি-টবি তুলছে। হকাররা নানা জিনিসপত্র ফেরি করছে। এ ছাড়া এলাকাটা ঘুরে বোঝার উপায় রইল না যে বাংলাদেশের চেয়ে ৫ গুণ বড় এবং ২৬ কোটি জনসংখ্যার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া রাজধানী জাকার্তায় ঈদ হচ্ছে!
বাংলাদেশে ঈদ বলতে আমরা যা বুঝি, ইন্দোনেশিয়ায় সেটির এক শ ভাগের এক ভাগও নেই। ঈদ নিয়ে আমাদের যে উচ্ছ্বাস, আবেগ; তার দেখা মিলল না এখানে। লোকজন ব্যস্ত যে যার প্রাত্যহিক কাজে। আজ কি ঈদ? প্রশ্ন করলে অনেকে বুঝতেও পারেন না। বুঝিয়ে বলার পর কেউ কেউ হয়তো বললেন, ‘ইয়েস ইয়েস, টু ডে ঈদুল আজহা।’
শহরে ঈদের কোনো আমেজই চোখে পড়ল না। শহর চলছে শহরের নিয়মেই। সেখানে ঈদ নামের কোনো কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া কঠিন। জাকার্তা শহর ঘুরে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় রইল না যে ঈদ মুসলিমদের সবচেয়ে বড় দুই উৎসবের একটি। বাসাবাড়িতে নিজেদের মধ্যে হয়তো উদ্যাপন করেন লোকজন। তবে ব্যানার-ফেস্টুন, ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে রাস্তাঘাট ভরিয়ে ফেলার বাংলাদেশি সংস্কৃতি থেকে ইন্দোনেশিয়ানরা অনেক দূরে!
পশু কোরবানি? বাংলাদেশের মতো নয় অবশ্যই। বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি কোরবানির ধুম পড়ে। মাংস পেতে গরিব মানুষদের ছোটাছুটি, জটলা। কিন্তু এ দেশে সেই দৃশ্য দেখা গেল না। এখানে গরু কিনে নিজের বাড়ির সামনে জবাই করার কোনো সুযোগ নেই। গরু পাঠিয়ে দিতে হবে মসজিদে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ একটা নিয়মের মাধ্যমে জবাইয়ের কাজটা শেষ করে। তাদের গরু জবাই করার প্রশিক্ষিত কর্মী আছে।
জবাই করার পর মাংস ভাগ হয় গরুর মালিক ও গরিব মানুষদের মধ্যে। মালিক অনেক সময় আসেনও না গরু জবাই দেখতে। গরু কিনে পাঠিয়ে দিয়েই তাঁর কাছ শেষ। মসজিদ কর্তৃপক্ষ যা করার করবে। এতেই শেষ কোরবানি। একদিক দিয়ে এটি অবশ্য ভালো। সঠিক ধর্মীয় বিধান মেনে কোরবানি হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে পারে মসজিদ কর্তৃপক্ষ।
আরও একটি ভালো দিক হলো, কোরবানির পশুর রক্তে এই শহর সয়লাব হয়ে যায় না। রক্ত দূরে থাক, কেউ তো টেরই পাবে না কোরবানির পশু জবাই হচ্ছে। জবাইয়ের জন্য মসজিদের পাশে আলাদা জায়গা আছে। সেখানে শুধু পশু জবাই হয়। পরিবেশদূষণ হয় না। রোগ-জীবাণু ছড়ানোর শঙ্কা কমে যায়। শহরের বাতাসও নির্মল থাকে।
এ কারণে শহর থাকে আগের মতো সাজানো গোছানো। জাকার্তার বেশির ভাগ এলাকা এত সুন্দর যে হঠাৎ করে এসে পড়লে মনে হতে পারে ইউরোপের কোথাও এসে পড়েছেন। রাস্তায় একটা দেশলাইয়ের কাঠিও নেই। এত পরিচ্ছন্ন। কোথাও কোনো আবর্জনা নেই। রাস্তাঘাট মসৃণ, চওড়া এবং আধুনিক। বাংলাদেশের মতো এক-দুই মাস পরই রাস্তায় ভাঙন শুরু হবে না এখানে।
এখন তো এই শহরে ১৮তম এশিয়ান গেমস চলছে। সে উপলক্ষে সবকিছু আরও পরিপাটি। প্রায় ১১ হাজার ক্রীড়াবিদের মিলনমেলার এই শহরের কারও কোনো সমস্যা যাতে না হয়, সেই দিকে বাড়তি নজর আছে নগরপিতার। শহরে বাস খুব একটা চোখে পড়ল না। ক্যাব ডাকলেই হাজির।
বাংলাদেশে ঈদের ছুটি তিন দিন। তবে এখানে ছুটি শুধু ঈদের দিনটাতেই। আবার ঈদের দিনেও সরকারি অফিস ছাড়া প্রায় সবই খোলা। সাপ্তাহিক ছুটি শনি ও সোমবার। এই দিনগুলোতেও শহর থাকে ব্যস্ত। কোনো কিছু নিয়ে উচ্ছ্বাস, আনন্দ প্রকাশে বাড়াবাড়ি নেই এখানকার মানুষদের। তবে আছে আতিথেয়তা, আন্তরিকতা। ১৯৬২ সালের পর আবার আরেকটি এশিয়ান গেমসের আয়োজনটা এরই মধ্যে মন কেড়েছে।
সব মিলিয়ে মুগ্ধ হতেই হবে। তবে ঈদ শব্দটার মানে যে আনন্দ, নিস্তরঙ্গ জাকার্তা দেখে তা বোঝার কোনো উপায় থাকল না!