যে মহামারির শিকার মুমিনুলরা
‘মহামারি’ শব্দটার সঙ্গে বাংলাদেশ টেস্ট দলের ব্যাটসম্যানদের হালের অবস্থার খুব মিল। রান নেই। উইকেটে কেউই লম্বা সময় টিকছেন না। এক-দুই-তিন নয়, আউট হতে শুরু করলে চার-পাঁচজন এক সঙ্গে আউট হচ্ছেন। গ্যালারির চেয়ার ছেড়ে চা-কফি এনে নিজের চেয়ারে ফিরতে না ফিরতেই দেখা যায় যে টপ অর্ডার গায়েব। স্কোরবোর্ডে তাকিয়ে দেখবেন ৫ উইকেটে ২০ রান!
ঘটনাটা যে একবার-দুইবার ঘটছে, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের সর্বশেষ ছয় টেস্টের মধ্যে দুই শ’র নিচে অলআউট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে চারবার। টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের জন্য ২২ গজ যেন শ্বাসরোধী বদ্ধ গুমোট কক্ষ। যেখানে টিকে থাকাই মুশকিল।
কিন্তু বাংলাদেশ টেস্ট দলের টপ অর্ডারে খেলছেন তামিম ইকবালের মানের একজন ওপেনার। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে তো বটেই, বর্তমান ক্রিকেটেরই অন্যতম সেরা ওপেনার এই বাঁহাতি। মুমিনুল হক বাংলাদেশের সফলতম টেস্ট ব্যাটসম্যান। নয় বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। এ সময় টেস্ট গড়টা ৪০ এর ওপরেই ছিল।
নাজমুল হোসেন, মাহমুদুল হাসান তুলনামূলকভাবে কম অভিজ্ঞ হলেও রান করার সামর্থ্য যে আছে, দুজনই তা প্রমাণ করেছেন। মাহমুদুলের টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছে মাউন্ট মঙ্গানুইতে ৭৮ রানের ইনিংস খেলে। এরপর ডারবানে করেছেন ১৩৭। নাজমুলের নামের পাশেও ২টি টেস্ট সেঞ্চুরি আছে।
মূল কথা, সামর্থ্য আছে প্রত্যেকেরই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? একেবারে টাটকা উদাহরণই দেওয়া যাক। অ্যান্টিগা টেস্টে বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় ইনিংসে নাজমুলের আউটটি মনে আছে তো? ওয়েস্ট ইন্ডিজ অলরাউন্ডার কাইল মেয়ার্সের মিডিয়াম পেস ডেলিভারিতে কট বিহাইন্ড...আপাত দৃষ্টিতে এটাই সবার চোখে পড়বে।
কিন্তু ওই একটি বলই আধুনিক ক্রিকেটের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ছোট্ট একটি উদাহরণ। কথাটা অনেকের কাছে ধাক্কার মতো লাগতে পারে। তবে গত কয়েক বছর পেস বোলিংয়ে, বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে যা ঘটছে, তা ক্রিকেটকেই চিরতরে বদলে দিচ্ছে। নাজমুলের আউটটি সেই বদলে যাওয়া ক্রিকেটেরই ফল। সেটা কীভাবে? নিচের ছবি দুটিতে আছে সে ব্যাখ্যা।
মেয়ার্স বলটি করেছিলেন রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে। বলের সিম পজিশন বলছে বাঁহাতি নাজমুলকে রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আউট সুইং করানোর চেষ্টা করছেন মেয়ার্স। রিলিজ পয়েন্ট থেকে বল বেরিয়ে যাওয়ার পরও সিম পজিশন প্রথম স্লিপের দিকে তাক করা। তার মানে বলটি পিচ করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। লাইন-লেংথ ও সিম পজিশন দেখে ওই মুহূর্তে নাজমুলের সিদ্ধান্ত...ছেড়ে দেব।
কিন্তু মেয়ার্স বলটা করেছেন রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে। গ্রিপ, সিম আউট সুইংয়ের হলেও রাউন্ড দ্য উইকেটের অ্যাঙ্গেলের কারণে বলটি পিচ করে বলটি ভেতরে এসে নাজমুলকে ভড়কে দেয়। শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তহীনতায় নাজমুলও ব্যাট ছুঁইয়ে কট বিহাইন্ড হন।
গত কয়েক বছর ধরেই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের এই অ্যাঙ্গেলের ভোগান্তি সহ্য করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ দলের টপ অর্ডার বাঁহাতিতে ঠাসা। তাই ভোগান্তিটা বাংলাদেশেরই বেশি। ২০১৯ সালের পর ১৪ ইনিংসে খেলে ৮ বার এভাবে আউট হয়েছেন নাজমুল। ২২ ইনিংসে ৭ বার রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা ডানহাতি পেসারের বলে আউট হয়েছেন মুমিনুল। তামিম ইকবাল ১৪ ইনিংস খেলে ৩ বার আউট হয়েছেন একই ধাঁচে। এ তালিকায় সবার ওপরে সাদমান ইসলাম, ১৬ ইনিংস খেলে যিনি আউট হয়েছেন ৭ বার। একই সমস্যা আছে সাকিবেরও। ৬ ইনিংসে সাকিব আউট হয়েছেন তিনবার।
আর এ সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশের, সেটিও নয়। টেস্ট ক্রিকেটে সব বাঁহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্ন এখন ডানহাতি বোলারদের রাউন্ড দ্য উইকেট বোলিং। এলবিডব্লিউ, বোল্ড ও কট বিহাইন্ড—টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে সাধারণ তিনটি ডিসমিসালের সুযোগ তৈরি হয় তখন। বেড়ে যায় সাফল্যের হারও।
ডিআরএস এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে। বাঁহাতিদের বিপক্ষে ডানহাতি পেসারদের ওভার দ্য উইকেট থেকে বোলিং করেই অভ্যস্ত। কিন্তু ওভার দ্য উইকেট বোলিং করে এলবিডব্লিউ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ওই অ্যাঙ্গেল থেকে ডানহাতি পেসারের বেশির ভাগ পিচ করবে লেগ স্টাম্পের বাইরে।
এসব কারণে গত পাঁচ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে ডানহাতি বোলারদের রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে বোলিং করার হার ৪০ শতাংশ। এর আগের ১০ বছরে যা ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা বোলারদের উইকেট নেওয়ার গড়ও ঈর্ষনীয় (২৭), ওভার দ্য উইকেটে যা ১০ বেশি। এর আগের ১০ বছর রাউন্ড দ্য উইকেটে গড় ছিল ৩৮, ওভার দ্য উইকেটে ৩৭।
পরিসংখ্যান বলছে, বাঁহাতিদের বিপক্ষে ডানহাতি বোলারদের রাউন্ড দ্য উইকেটে যাওয়াটা ক্রিকেটে নতুন কোনো কৌশল নয়। ২০০৫ অ্যাশেজে বাঁহাতি অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে থামাতে ইংলিশ অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ পুরো সিরিজেই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে বল করেছেন। সেটি কাজেও লেগেছে। পুরো অ্যাশেজে রান খরায় ভুগেছেন গিলক্রিস্ট। কিন্তু এ ধরনের বোলিং আগে মূলত রান থামানোর চিন্তা থেকেই করা হতো। অথবা যখন কোনো কৌশল কাজ করছে না, তখন। ততক্ষণে আবার ব্যাটসম্যান ক্রিজে থিতু, বল পুরোনো। আজকাল একেবারে নতুন বলেও বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ক্রিজে আসার পরই বোলাররা রাউন্ড দ্য উইকেট চলে যাচ্ছেন।
আগে বোলাররাও এ ধরনের বোলিংয়ের জন্য দক্ষ ছিলেন না। ‘এই বোলিং আমি করি না’ – এখন অ্যানালাইসিসের যুগে বোলারদের এই কথা বলারও সুযোগ নেই। স্টুয়ার্ট ব্রডের কথাই ধরুন। ক্যারিয়ারের শুরুর ৭-৮ বছর বাঁহাতিদের বিপক্ষে তাঁর গড় ছিল ৪০ ছুঁই ছুঁই। ব্রডকে তাঁর কাউন্টি দল নটিংহামশায়ারের কোচ পিটার মুরস কাউন্টির অ্যানালিস্টকে সঙ্গে নিয়ে এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে ভদ্র ভাষায় এই জায়গায় উন্নতি আনতে বলেন। এরপর ব্রড রীতিমতো বাঁহাতিদের ঘাতকে পরিণত হন। ভারতের ইশান্ত শর্মা, ওয়েস্ট ইন্ডিজে কেমার রোচও নিজের ক্যারিয়ারে নতুন মাত্রা যোগ করেন শুধু পাশ বদলে বোলিং করে।
এ তো গেল শুধু অ্যাঙ্গেলের কথা। এবার আসি ওবল সিম বোলিংয়ে। অ্যান্টিগা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ফিরে যাই। নাজমুলের বিদায়ে ক্রিজে আসেন মুমিনুল। আরেক বাঁহাতির জন্যও বোলার মেয়ার্সই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকেই বল শুরু করলেন। মুমিনুল তখনো রানের খাতা খোলেননি। বল খেলে ফেলেছেন ৯টি। দশম বলে এসে ইনসাইড এজ থেকে একটি বাউন্ডারি পেয়ে যান মুমিনুল। বল মুমিনুলের ব্যাটের কানায় লেগে ঠিক স্টাম্পের পাশ ঘেঁষে বাউন্ডারিতে যায়। অল্পের জন্য রক্ষা যাকে বলে! বলটি মেয়ার্স প্রথাগত আউটসুইং বা ইনসুইংয়ের গ্রিপে করেননি। করেছিলেন ওবল সিমে।
ওপরের ছবিতে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, মেয়ার্স বলটা পেসারদের স্বাভাবিক গ্রিপে ধরেননি। এমনভাবে ধরেছেন, যেমন বলটা হাত থেকে বেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে উইকেটে আঘাত করে। এতে সুবিধাটা কী? বল উইকেটে পড়ে কোন দিকে যাবে সেটি মেয়ার্স, অর্থাৎ বোলার নিজেও জানেন না। ব্যাটসম্যানের তো আঁচ করার প্রশ্নই আসে না।
এই ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন, মেয়ার্সের হাত থেকে বল বেরোনোর পর মনে হচ্ছিল বলটি আউটসুইং করবে।
কিন্তু এই ছবিতে দেখুন, বলটি ওবল করতে করতে উইকেটে যখন আঘাত করে, তখন সিম মুমিনুলের লেগ স্টাম্পের দিকে তাক করা। তার মানে বলটি ভেতরে আসবে। কিন্তু কম্পমান সিমের কারণে মুমিনুল তখন বিশাল ধন্দে। বল ভেতরে আসবে না বাইরে… এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে না খুঁজতেই পরের ঘটনাটা ঘটে। ইনসাইড এজ, এরপর অল্পের জন্য বেঁচে যান মুমিনুল, বল যায় বাউন্ডারিতে।
কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। মুমিনুলকে ওই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে কখনো ওবল সিম, কখনো আউট সুইং, কখনো ইন সুইংয়ের গ্রিপে বল করে রাজ্যের দ্বিধায় ফেলে দেন মেয়ার্স। কিছুক্ষণ পর আরেকটি আউট সুইংয়ের গ্রিপে করা বল আচমকা ভেতরে এসে মুমিনুলের প্যাডে আঘাত করে, তাতেই এই বাঁহাতির বিদায়ঘন্টা
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে, এই ওবল সিম আর নতুন কি! আসলেই নতুন। যতদূর জানা যায়, মোহাম্মদ আসিফ প্রথম এ ধরনের বোলিং করেন। এরপর জিমি অ্যান্ডারসন তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন। এখন প্রায় সব দেশেরই পেসারদের কাছে পৌঁছে গেছে ওবল সিম ডেলিভারি। বাংলাদেশ দলের খালেদ আহমেদও এতে পটু। প্যাট কামিন্স, জস হ্যাজেলউড, মিচেল স্টার্ক, কাগিসো রাবাদা, স্টুয়ার্ট ব্রড, কাইল জেমিসন, কেমার রোচ – বিশ্বের প্রায় সব বোলারই আজকাল নতুন এই দক্ষতা কাজে লাগাচ্ছেন। নব্বইর দশকে পাকিস্তানি পেসারদের রিভার্স সুইং যদি পেস বোলিংয়ের চেহারা পাল্টে দিয়ে থাকে, তাহলে ওবল সিম সে রকমই প্রভাব ফেলছে বিশ্ব ক্রিকেটে।
বাংলাদেশ দলের কম্পিউটার অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন ওবল সিম নিয়ে বলছিলেন, ‘দক্ষতাটা দারুণ। রপ্ত করতে পারলে যে কোনো পেসারদের জন্য বড় হাতিয়ার এটি। কারণ বলের সিম রোটেশনের কারণে বোলার নিজেও জানে না, বল পিচ করে কোন দিকে যাবে। ব্যাটসম্যানের তো জানার প্রশ্নই আসে না।’
রাউন্ড দ্য উইকেট অ্যাঙ্গেল, ওবল সিমের সঙ্গে যদি ডিউক বলের চ্যালেঞ্জ জুড়ে দেন, তাহলে রান করা একটু কঠিনই। উইকেটের সাহায্যও আজকাল কম না। ২০১৭-১৮ অ্যাশেজের মেলবোর্ন টেস্টের উইকেট আইসিসির ডিমেরিট পয়েন্ট পাওয়ার পর থেকেও প্রতিটি ক্রিকেট বোর্ড বোলিং সহায়ক উইকেটের দিকে ঝুঁকছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজও মরা উইকেট, কুকাবুরা বল থেকে সরে এসেছে ২০১৮ সালে। গত চার বছর তাঁরা ঘরের মাঠে টেস্ট খেলছে ডিউক বলে, যা বোলারদেরই বন্ধু। কুকাবুরাও গত বছর তাদের লাল বলের সিম পাল্টেছে। আগের তুলনায় কুকাবুরা লাল বলের সিমও এখন যথেষ্ট উঁচু। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয় গ্রীষ্মে বড় রানের খরার কারণও নতুন কুকাবুরা।
এসবের সঙ্গে যদি বোলিং মেশিনের মতো নিখুঁত নিশানার পেসার জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে ব্যাটসম্যানের লুকানোর জায়গা থাকে না। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডের বেধড়ক মারের কারণে বোলাররা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অ্যাকুরেট। বাজে বলের সংখ্যা এতটাই কম যে আধুনিক ক্রিকেট থেকে কাট শট প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে। পেসারদের শর্ট ও ওয়াইড বলে কাট খেলে থাকেন ব্যাটসম্যানরা। এত বন্ধুত্বপূর্ণ ডেলিভারি এখনকার বোলাররা দেন না বললেই চলে। ২০১৫ সালের দিকেও টেস্ট ক্রিকেটের ৩.৫ শতাংশ রান আসত কাট শটে। এখন সেটি কমে নেমে এসেছে তিনের নিচে (২.৯০ শতাংশ)।
মুমিনুলের কথাই ধরুন, সেরা সময়ের মুমিনুলের রান আসতই কাট ও ফ্লিক শটে। বোলার বাইরে বল করলে কাট, পায়ে করলে ফ্লিক। এখন মুমিনুল শট দুটি খেলার বলই পান না! সম্প্রতি কেউ যদি ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস, ঋষভ পন্তের টেস্ট ব্যাটিং দেখে থাকেন, তাহলে বিষয়টি বুঝতে পারবেন। দুজনই আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। কিন্তু মারার মতো বল না পেয়ে আজকাল দুজনই শট তৈরি করার চেষ্টা করছেন। কারণ ড্রাইভ, কাট, পুল করার মতো বাজে বল এখন পাওয়া যায় কালেভদ্রে। আগে অধিনায়করা বল পুরোনো হলে অনিয়মিত বোলার দিয়ে ৫-৬ ওভার বল করাত। এখন ওই সহজ রানও কোনো অধিনায়ক ছাড় দেন না। মূল বোলারদের ফিটনেসে উন্নতিও এর আগের কারণ। তাঁরা এখন লম্বা সময় বোলিং করতে পারেন।
বোলিং মেশিনের মতো এমন নিয়ন্ত্রিত বোলিংটা হচ্ছে দ্রুতগতিতে। বোলারদের গতির দিকে তাকিয়ে দেখুন। ১০ বছর আগেও ধারাবাহিকভাবে গড়ে ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার বেগে বল করার বোলার ছিল হাতে গোনা কয়েকটি দেশে। এখন বাংলাদেশেও তাসকিন আহমেদ ও ইবাদত হোসেন ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটারের আশেপাশে বোলিং করেন। বাকি দলগুলোর অবস্থা কী, সেটা তো বুঝতেই পারছেন।
আর বোলারদের আরেক বড় সঙ্গী ক্রিকেট বিশ্লেষণ তো আছেই। গত পাঁচ বছরে ক্রিকেট বিশ্লেষণ ভিন্ন মাত্রা স্পর্শ করেছে। বিশ্লেষণে উন্নতি এলে সাধারণত শুরুর দিকে ধাক্কাটা খায় ব্যাটসম্যানরা। বেসবলেও যখন ‘মানিবল’ প্রযুক্তি আসে, তখন সুবিধাটা হয়েছে বেসবল পিচারদেরই।
টেস্ট ব্যাটসম্যানরা এত পরিবর্তনের সঙ্গে পর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারছে না। হিটিং অ্যাগেইন্সট দ্য স্পিন বইয়ের লেখক ও ইংল্যান্ডের অ্যানালিস্ট নাথান লিমন সবসময় এই উদাহরণ দিয়ে এর ব্যাখ্যা করেন। ধরুন, ক্লাব ক্রিকেটের একজন ব্যাটসম্যান এক নেটে, আর পাশের নেটে কোনো টেস্ট ব্যাটসম্যান...দুজনকেই যদি বোলিং মেশিনে ৮০ মাইল বেগে বল করা হয়, তাহলে দুজনের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ এইটুক সামলাতে মোটামুটি টেকনিক আর হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিনেশন লাগে। যা কমবেশি সবারই আছে।
কিন্তু দুজনকেই যদি একজন টেস্ট বোলার বোলিং করেন, তাহলে দেখবেন পার্থক্যটা আকাশ–পাতাল। ক্লাব ক্রিকেটার দেখবেন ব্যাটে বল লাগাতে পারছে না। কিন্তু টেস্ট ব্যাটসম্যানের জন্য সহজ না হলেও দেখবেন যে সে ঠিকই মানিয়ে নেবে। কারণ হলো, টেস্ট ব্যাটসম্যানদের অনুমান-দক্ষতা। বোলাররা বল ছাড়ার আগেই টেস্ট মানের ব্যাটসম্যানরা আঁচ করতে পারে কী হতে যাচ্ছে। লাইন-লেংথ কী হবে রিলিজ পয়েন্ট দেখে অনেকেই ধরে ফেলেন। কোন দিকে বল সুইং কিংবা সিম করবে, সেটি সিম পজিশন দেখেই পড়তে পারেন।
কারণ ওই গতিতে বল দেখে শুনে বুঝে খেলার মতো সময় বৈজ্ঞানিকভাবে সম্ভব না। ওই রিফ্লেক্স, ওই অ্যান্টিসিপেশনের দক্ষতা একজন টেস্ট ব্যাটসম্যান অর্জন করে বছরের পর বছর অনুশীলনের মাধ্যমে। এ ধরনের বোলিং একদমই নতুন হওয়ায় সামলানোর যে অনুশীলন দরকার, সেটি আগে কখনো করেনি ব্যাটসম্যানরা। বাংলাদেশের জন্য সমস্যাটা আরও প্রকট। এ বছরের ছয় মাস যেতে না যেতেই বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ৭টি। এত অল্প সময়ে এত টেস্ট আর আগে বাংলাদেশ খেলেছে কি না, সেটি গবেষণার বিষয়। ব্যাটসম্যানরা এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনুশীলনে কাজ করার যথেষ্ট সময় পাচ্ছেন কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন।
সমস্যাটা যে শুধু বাংলাদেশের, সেটাও না। বিরাট কোহলির কথাই ধরুন। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর টেস্ট ক্রিকেটে কোহলি রান করেছেন এক হাজারের ওপরে (১২১৫, ১০৫৯, ১৩২২)। কিন্তু ২০১৮ সালের পর কী যেন হলো এই ভারতীয় তারকার! ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোহলি ১০৬ ইনিংসে ৫৩.৭৫ গড়ে ৫২৬৮ রান করেছেন, ২০ শতক ও ১৫ অর্ধশতক। ২০১৮ সালের পর কোহলি ৬৫ ইনিংস খেলে ফেলেছেন। ৪৪.০৪ গড়ে ৭ শতক ও ১৩ অর্ধশতকে করেছেন ২৭৭৫ রান । তাঁর সর্বশেষ শতক এসেছে ২০১৯ সালে, সেটিও বাংলাদেশের অনভিজ্ঞ বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে।
উড়তে থাকা কোহলির হঠাৎই কী এমন হলো যে তিনি আগের মতো বড় রান পাচ্ছেন না? টেস্ট ক্রিকেটে তিনি থিতু হচ্ছেন ঠিকই। ভালো শুরুও পাচ্ছেন। কিন্তু ইনিংস লম্বা হচ্ছে না। শুধু কোহলিই যে এই রোগে আক্রান্ত, তা কিন্তু নয়। গত চার বছরে ব্যক্তিগত রেকর্ডে ভাটার টান লেগেছে আরেক বিশ্বসেরা স্টিভ স্মিথের। ২০১৭ সাল পর্যন্ত যে স্মিথ ৬৩ গড়ে রান করছিলেন, তাঁর গড় গত চার বছরে কমে এসেছে ৫০-এ।
২০১৪ সালে বৈশ্বিক টেস্ট ব্যাটিং গড় ছিল ১৯৫০ সালের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ (৩৭.২১)। ২০০০ সালের পর বৈশ্বিক গড় কখনো ৩০ এর নিচে নামেনি। টেস্ট ক্রিকেট ছিল ব্যাটসম্যানদের স্বর্গ, বোলারদের নরক। ২০১৮ সাল থেকে ব্যাটিং দাপটের এই ছবিটা বদলাতে থাকে। বৈশ্বিক ব্যাটিং গড় কমতে কমতে এ বছর ২৫.৮১ রানে এসে ঠেকেছে!
হঠাৎই এমন ব্যাটিং ভরাডুবির কারণ নিশ্চয়ই এতক্ষনে ধরতে পারছেন। পেস বোলিংয়ের এই অবিশ্বাস্য উত্থানই এর কারণ। যা গত কয়েক বছর ধরেই টেস্ট ব্যাটসম্যানদের পাত থেকে রান কেড়ে নিচ্ছে। প্রায় প্রতিটি টেস্ট খেলুড়ে দেশে পেস বোলিংয়ের এই অবিশ্বাস্য উত্থান ব্যাটসম্যানদের জন্য মহামারী নয় তো কী!