যে বাঙালি কন্যা দেখছেন কোরীয় স্বপ্ন
এ যেন সিনেমার গল্প! দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ ক্যাং সাং হি জাপানের একটি ক্লাবে মেয়েদের গলফ শেখাতেন। জাপানে তখন জমিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করেন বাংলাদেশি যুবক ফজলুল কাদের। টোকিওর সেই রেস্তোরাঁর নিয়মিত খরিদ্দার ছিলেন ক্যাং। সেখানেই পরিচয় কাদেরের সঙ্গে। পরিচয় থেকে ভালো লাগা। এরপর বিয়ে। বাঙালি আর কোরীয় দম্পতির ঘর আলো করে আসা কন্যা ফাহি কাদের এখন বাংলাদেশে জুডো কোর্ট মাতাচ্ছেন।
মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোরে চলমান ৩৫তম জাতীয় জুডো চ্যাম্পিয়নশিপে ফাহি পরশু ৭৮ কেজি ওজন শ্রেণিতে জিতেছেন রুপা। কাল অল্পের জন্য সোনার পদক হাতছাড়া হয়েছে; ৫৭ কেজি ওজন শ্রেণির ফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হেরে গেছেন বিকেএসপির জুডোকা অবনিকা হাসানের কাছে।
ফাহির পরিবারটা ক্রীড়াপ্রেমী। বাবা ফজলুল কাদের বাংলাদেশ বিমান দলের হয়ে হ্যান্ডবল খেলেছেন প্রথম বিভাগে। মা গলফার। ফাহির ১০ বছর বয়সী ভাই কাদের কেকেও জুডো খেলছে। শুধু জুডো নয়, কারাতে এবং জিজুজুৎসুতেও জাতীয় প্রতিযোগিতায় পদক জিতেছেন ফাহি। কারাতেতে এ বছর ৬২ কেজিতে ব্রোঞ্জ, জিজুজুৎসুতে ৩টি সোনা জিতেছেন।
এত খেলা থাকতে কেন আত্মরক্ষামূলক শারীরিক খেলা বেছে নেওয়া? প্রশ্নটা করতেই কাল মিরপুরের ইনডোরে বসে হাসতে হাসতে ফাহি বলছিলেন, ‘আমার ওজন হঠাৎ করেই বেড়ে যাচ্ছিল। ফিটনেস ধরে রাখতে আম্মু ভাবলেন এই খেলাটা আমার জন্য ঠিক। আম্মু তাই জুডো খেলতে পাঠালেন। এখন আমি খেলাটা ভীষণ উপভোগ করছি।’
আর আট-দশজন বাবার মতো মেয়েকে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী বানাতে চান না ফজলুল কাদের। তাই একাডেমিক পড়াশোনার ধার ধারেন না তিনি। মেয়েকে অনলাইনে ‘এ’ লেভেলে পড়াচ্ছেন। ফজলুল কাদেরের লক্ষ্য একটাই, অলিম্পিকের পদক মঞ্চে উঠবে বাংলাদেশের মেয়ে, ‘আমি একাডেমিক সার্টিফিকেটের জন্য পড়াচ্ছি না। দুনিয়াটা জানার জন্য, জ্ঞানের জন্য পড়াচ্ছি। অন্যদের মতো সন্তানদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর কোনো শখ নেই আমার। আমার মেয়ে অলিম্পিকে অন্তত একটা পদক জেতার জন্য যেন চেষ্টা করে।’
বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের জন্য অলিম্পিকে খেলতে পারাটাই যেখানে স্বপ্ন, সেখানে এই বাবার চিন্তাটা ব্যতিক্রম, ‘আমি ২৫ বছর ধরে জাপানে ছিলাম। মেয়েকে ব্ল্যাক বেল্টধারী বানাতে এবং উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য জাপান বা কোরিয়ায় পাঠাতে চাই।’ পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা ফজলুল কাদের বর্তমানে শ্যামলীতে থাকেন। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে মিরপুর ইনডোরে মেয়েকে অনুশীলন করাতে নিয়ে আসেন। চ্যালেঞ্জটা তিনি নিয়েছেন স্বেচ্ছায়, একটা স্বপ্ন থেকে, ‘আমি যখন ১৯৮৬ সালে জাপান যাই, তখন ভিসা লাগত না । সেখানে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। হোটেলে থালাবাসন ধুয়েছি। এরপর ধীরে ধীরে অন্য চাকরি করে নিজে ব্যবসা করেছি জাপানে। পরিশ্রম করলে যে ফল পাওয়া যায়, সেটা আমি জানি। মেয়েকে অলিম্পিকে খেলিয়েই ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’
ফেডারেশন বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে সহযোগিতা তেমন পান না বলে অনুযোগ আছে ফজলুলের। মেয়ের পারফরম্যান্স দেখে বাংলাদেশ আনসার ও সেনাবাহিনী এরই মধ্যে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে ফাহিকে। কিন্তু ফজলুল কাদের মেয়েকে কোনো সংস্থার হাতে দিতে চান না, ‘সিভিলিয়ান থেকেই ও যেন ভালো করে। তাহলে আমার মেয়েকে দেখে আরও অনেকে জুডোতে আসবে।’
নেপালে আগামী বছর অনুষ্ঠেয় এসএ গেমসের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন ফাহি। তাঁর আপাতত লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়া থেকে সোনার পদক জেতা, ‘নেপালে জুডো, কারাতে আছে। আমি যেকোনো একটা খেলায় সোনা জিততে চাই।’ কোরীয় রক্ত ফাহির শরীরে। কোরীয় জাতি আত্মরক্ষামূলক খেলায় শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে চলেছে বিশ্বে। ফাহির বাবা তাই মেয়েকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতেই পারেন।