২০৩টি দেশ আর ৮২০টি ম্যাচ! বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের এই মহাযজ্ঞ পেরিয়েই চূড়ান্ত পর্বের টিকিট পেয়েছে মাত্র ৩২টি দল। এই ৩২ দল নিয়ে আমাদের নতুন ধারাবাহিক। দ্বিতীয় পর্বে থাকছে জাপান।
ফুটবলবোদ্ধাদের কাছে ফুটবল মানেই ইউরোপের পাওয়ার ফুটবল কিংবা লাতিন ঘরানার শৈল্পিক সৌন্দর্য। এশিয়ার ফুটবলের খুব একটা কদর নেই। তাতে অবশ্য ফুটবলবোদ্ধাদের দোষ দেওয়া যাবে না, ইতিহাসও বলছে বিশ্বমঞ্চে এশিয়ার হতশ্রী দশার কথা। এই এশিয়ার ফুটবলের নিভু নিভু প্রদীপের আলো সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা-নাগাসাকির বিপর্যয় কিংবা কয়েক বছর আগে সুনামির তাণ্ডব সত্ত্বেও সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে পরিশ্রমী জাপানিরা। ফুটবলেও তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার এই ‘পাওয়ার হাউস’।
বাছাইপর্ব পেরিয়ে জাপানের মূল মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল। প্রথম দল হিসেবেই বিশ্বকাপে সুযোগ পায় এশিয়ার সেরারা। বাছাইপর্বের পর কনফেডারেশনস কাপে অংশ নেয় জাপান। সেখানে প্রথম ম্যাচেই স্বাগতিক ব্রাজিলের সঙ্গে ৩-০ গোলের পরাজয়। তবে পরের ম্যাচেই কিছুটা হলেও হারানো আত্মবিশ্বাস প্রাপ্তি; শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ইতালির সঙ্গে লড়াই করে ৪-৩ গোলের পরাজয়। জাপান অনেকবারই বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা সত্যিই সামুরাইদের মতো। আমৃত্যু লড়াই করে। জাপানকে বলাও হয় ‘ব্লু সামুরাই’।
আইভরি কোস্টের বিপক্ষে জুন ১৪-তে মাঠে নামবে জাপান। গ্রুপ সি তে অন্য দুই প্রতিপক্ষ গ্রিস ও কলম্বিয়া। জাপান দলটির কোচ হিসেবে আছেন আলবার্তো জাকেরনি। ৬১ বছর বয়সী এই কোচের ঝুলিতে আছে জুভেন্টাস, এসি মিলান ও ইন্টার মিলানের মতো দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে বিশ্বমঞ্চে চমক দিতে চায় জাপান।
বিশ্বকাপের আগে সাইপ্রাস, কোস্টারিকা ও জাম্বিয়ার বিপক্ষে তিনটা প্রীতি ম্যাচ খেলবে জাপান। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান জাপানের লড়াকু মানসিকতারই পরিচয় দিচ্ছে। সর্বশেষ ১০ ম্যাচের ৬টিতেই জিতেছে জাপান; যার মাঝে ঘানা ও বেলজিয়ামের মতো দলের সঙ্গেও জেতার অভিজ্ঞতা আছে। দলের সব চেয়ে বড় তারকা মিলানে খেলা কাইসোকি হোন্ডা। হোন্ডা মাঠে থাকলে জাপান দলটির চেহারাই যেন বদলে যায়।
শক্তিশালী গড়ন, নিখুঁত সব পাস, স্ট্যামিনা, ড্রিবলিং—সব মিলিয়ে প্রতিপক্ষের সীমানায় ত্রাস ছড়াতে পারেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। দলের হয়ে এখন পর্যন্ত ৫৪ ম্যাচে ২০ গোল করেছেন, বাছাইপর্বেও ৬ ম্যাচে ৫ গোল করে প্রতিপক্ষদের জন্য বার্তাটা দিয়েই রেখেছেন।
প্রতিপক্ষ দলগুলো অবশ্যই হোন্ডাকে বোতলবন্দী করে রাখতে চাইবে। দলে আছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলা শিনঝি কাগাওয়ার মতো সৃজনশীল খেলোয়াড়ও। ২৫ বছর বয়সী কাগাওয়া দিনকে দিন যেন আরও পরিপক্ব হচ্ছেন। এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের মাঝ মাঠের দক্ষতা ও গোল-ক্ষুধা জাপান দলটিকে করেছে আরও শানিত।
বুন্দেসলিগার মেইঞ্জ ক্লাবের হয়ে খেলা শিনজি ওকাজাকির দিকেও চোখ রাখতে হবে সবার, হোন্ডার নিখুঁত পাসকে গোল বানাতে যার কোন জুড়ি নেই। সঙ্গে দুর্দান্ত সব ক্রস তো আছেই। হোন্ডা-কাগাওয়া-ওকাঝাকি—এই তিন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারই জাপানের তুরুপের তাস। মাঝ মাঠের দক্ষ নাবিকের মতোই অধিনায়কত্ব সামলাবেন নুরেমবার্গের হয়ে খেলা মাকোতো হাসেবে। শালকের হয়ে খেলা রাইটব্যাক উচিদা কিংবা ইন্টার মিলানের হয়ে খেলা লেফটব্যাক নাগাতোমোর দিকেও নজর রাখতে হবে সবার।
বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতা: ১৯৯৮ থেকে ২০১৪—এ পর্যন্ত টানা ৫ বার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে জাপান। এর মাঝে ২০০২ এবং ২০১০ সালের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠার কৃতিত্ব দেখিয়েছে দলটি। বাকি দুবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় বর্তমান এশিয়ান চ্যাম্পিয়নদের। সর্বশেষ বিশ্বকাপের স্মৃতি কিন্তু জাপানকে বাড়তি উদ্দীপনাই জোগাবে। শক্তিশালী পর্তুগালের সঙ্গে ১২০ মিনিট লড়াই করেও টাইব্রেকারে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছিল জাপান।
শক্তি: বিশ্বকাপের মত বড় আসরে ‘নার্ভ’ ঠিক রাখাটাই যেখানে কঠিন, সেখানে জাপানের অধিকাংশ খেলোয়াড়েরই রয়েছে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোতে খেলার অভিজ্ঞতা, নিশ্চিতভাবেই তা দলটিকে আরও শক্তিশালী করেছে। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে টানা পাঁচবার খেলতে যাচ্ছে, এটাও তাদের বাড়তি শক্তি। গ্রুপ-পর্বে দলগুলোর শক্ত পরীক্ষাই নেবে জাপানের আক্রমণ-ভাগ। ছোট ছোট পাস থেকে হঠাত্ দ্রুত আক্রমণে উঠে যাওয়ার ক্ষমতা, দুর্দান্ত ফিনিশিং যে কোনো দলকেই ভড়কে দিতে পারে।
দুর্বলতা: জাপানের ডিফেন্স। গত বেশ কয়েকটি ম্যাচেই জাপান গোল খেয়েছে সেট পিস থেকে। ফুলব্যাকরা আক্রমণে উঠে গেলে বল হারালেই কাউন্টার অ্যাটাকে গোল খাচ্ছে দলটি। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে বিশ্বকাপে বড় মাশুলই দিতে হবে।
একটা সময় ছিল যখন শীর্ষ দলগুলো বলে-কয়েই হারাত এশিয়ার পরাশক্তিদের। এখন আর সেই দিন নেই। সাম্প্রতিক ফর্ম কিংবা ২০১৫ এর কোপা আমেরিকাতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ—এসবই কিন্তু বড় দল হয়ে উঠার পূর্বাভাস। বিশ্বকাপে চমকে দেওয়ার মতো সব উপাদানই জাপানের আছে, সঙ্গে আছে পুরো এশিয়ার সমর্থন। এখন শুধু জ্বলে উঠার অপেক্ষা।
পড়ুন: এশিয়ার ‘কালো ঘোড়া’