মনে পড়ে মোনেম মুন্নাকে
‘হি ওয়াজ মিসটেকেইনলি বর্ন ইন বাংলাদেশ’—মোনেম মুন্না সম্পর্কে এ কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। সেই অটো ফিস্টার, যিনি ঘানাকে বিশ্ব যুব কাপের শিরোপা এনে দিয়েছিলেন, সেই ফিস্টার যিনি আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ টোগোকে বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিস্টারের প্রিয় সেই মোনেম মুন্না পরলোকে চলে গেছেন আজ নয় বছর পূর্ণ হলো। বাংলাদেশ কি মনে রেখেছে তাঁর সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারকে? স্মৃতি ফিকে হয়ে আসার জন্য নয় বছর কি অনেক সময়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পান না খোদ মোনেম মুন্নার পরিবার। মৃত্যুর সময় অনেকের মুখ দিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছুটলেও মোনেম মুন্নার নবম মৃত্যুবার্ষিকী আজ পেরিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির চাদর গায়ে পরেই, অনেকটা নীরবে-নিভৃতে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের ফুটবলে মুন্নার উত্থান। সালটা ১৯৮৪। প্রথম দুই মৌসুম মুক্তিযোদ্ধায়। এরপর এক মৌসুম ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ১৯৮৭ সালে তিনি যোগ দেন আকাশি নীল জার্সিধারী আবাহনী শিবিরে। দেশের ফুটবলের অন্যতম জায়ান্টেই তিনি পার করে দেন তাঁর পুরো ফুটবল ক্যারিয়ার। তিনি ছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এক ফুটবলার। ১৯৯১ মৌসুমের দলবদলে তিনি আবাহনীতে খেলেছিলেন ওই সময়ের বিচারে অকল্পনীয় ২০ লাখ টাকা পারিশ্রমিকে, যা অনেক দিন পর্যন্ত বাংলাদেশেই শুধু নয়, গোটা উপমহাদেশেই ছিল এক অনন্য রেকর্ড, অভাবনীয় এক ঘটনা।
জাতীয় দলের অধিনায়ক তিনি হয়েছেন একাধিকবার। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমস দিয়ে তিনি গায়ে জড়িয়েছিলেন জাতীয় দলের গর্বের জার্সি। এরপর দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে তিনি জাতীয় দলে খেলেছেন টানা ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতে পরেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমারে চার জাতি প্রতিযোগিতার শিরোপা জয় করেছিল। ওটাই ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রথম কোনো শিরোপা।
রক্ষণসেনা মোনেম মুন্না ছিলেন এক অনন্য দৃঢ় চরিত্রের ফুটবলার। পরিশ্রমী মুন্না ছিলেন আবাহনী ও জাতীয় দলের পরম নির্ভরতার প্রতীক। ফ্রি-কিক থেকে গোল করার অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী মুন্না ছিলেন এক সেলিব্রেটি ফুটবলার। ক্রিকেট এ দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার আগে অর্থাত্ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মোনেম মুন্না নামটি এদেশের করপোরেট বাণিজ্যেরও অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে মুন্নাকে ব্র্যান্ড প্রতিনিধি বানিয়ে সম্মানিত করেছিল বিশ্বখ্যাত প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার।
কিডনির জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মোনেম মুন্না এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। মৃত্যুর সময় তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী ও দুই সন্তানকে। স্বামীর মৃত্যু কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ করায় স্ত্রী সুরভী মোনেমকে। মেয়ে ইউসরা মোনেম দানিয়া ও ছেলে আজমান সালিদকে এই সংগ্রামের মাধ্যমেই বড় করছেন সুরভী। বাবার মৃত্যুর নয় বছর পর মেয়ে দানিয়া এখন পড়ছেন মালয়েশিয়ায়, গণিতে স্নাতক ডিগ্রির জন্য। ছেলে আজমান রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। ধানমন্ডিতে স্বামীর কেনা ফ্ল্যাটেই তাঁদের বসবাস। জানালেন, নীরবে-নিভৃতে তাঁদের জীবন মোটামুটি ভালোই কেটে যাচ্ছে।
নিজেদের কষ্টের দিনগুলোর কথা আর মনে করতে চান না সুরভী। প্রথম আলোর মাধ্যমে স্বামীর মৃত্যু দিনে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি, ‘ও অনেক জনপ্রিয় ফুটবলার ছিল। ওর নাম শুনলেই সবাই ওকে এক নামে চেনে। এই মুহূর্তে আমি ওর জন্য দোয়া চাওয়া ছাড়া আর কিছুই চাই না।’
সুরভীর হতাশার জায়গাটা অন্য। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকেই তাঁকে অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যার কিছুই বাস্তব রূপ লাভ করেনি। তিনি বলেন, ‘ওর চিকিত্সার ব্যয় মেটাতে গিয়ে আমরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। মুন্নার ফুটবল থেকে রোজগারের প্রায় পুরোটাই চলে গিয়েছিল চিকিত্সার পেছনে। আমার দুটো ছেলে-মেয়েকে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করাতে হয়েছে। ওর মৃত্যুর সময় অনেকেই আমাদের দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার ব্যয় বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে যেসব প্রতিশ্রুতি সবাই ভুলে গেছে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ব্যাপারটিই আমি মানতে পারি না। আমরা তো কোনো সাহায্য চাইনি।’
এরপরই তৃপ্তি সুরভীর কণ্ঠে, ‘আল্লাহর রহমতে কঠিন দিনগুলো পার করে এসেছি। ছেলে-মেয়ে দুটো ভালোভাবেই পড়াশোনা করছে। আমার একমাত্র স্বপ্ন ওরা পড়াশোনা শেষ করে মানুষের মতো মানুষ যেন হয়।’