২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ভারসাম্যের বিশ্বকাপ

স্পেনের বিদায় এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছবি: রয়টার্স
স্পেনের বিদায় এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছবি: রয়টার্স

কী দারুণ সময়ই না কাটল ফুটবলপ্রেমীদের। দল-মত-সমর্থনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এর চেয়ে রোমাঞ্চকর বিশ্বকাপ আর কবে এসেছিল?

ব্রাজিল বিশ্বকাপকে এরই মধ্যে ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ম্যাচে উত্তুঙ্গ প্রতিদ্বন্দ্বিতা, গোলের পর গোল, ব্যক্তিগত ক্রীড়াশৈলী—গত তিনটি সপ্তাহ স্বপ্নের মতোই ছিল ফুটবল-রোমান্টিকদের জন্য।

ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়ার সময়ই ফিফা-কর্তাদের অবচেতন মনে হয়তো বিষয়টা ছিল, যে ব্রাজিলকে ফুটবল-স্পিরিটের সূতিকাগার হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেই ব্রাজিলের মাটি বিশ্ববাসীকে এমন একটি বিশ্বকাপ উপহার দেবে, যা ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড শেষে কোয়ার্টার ফাইনালের যে লাইনআপ, ফিফা কর্তারা নিশ্চয়ই তা দেখে দারুণ পুলকিত। আট গ্রুপের আট শীর্ষ দলই এবার জায়গা করে নিয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালের লড়াইয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, এবারের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল এনে দিয়েছে বিশ্ব ফুটবলে শক্তির এক দারুণ ভারসাম্য। ইউরোপ আর আমেরিকা (লাতিন ও মধ্য) থেকে চারটি করে দলের কোয়ার্টার ফাইনালে পদার্পণ ফুটবলের শুদ্ধচারীদের অন্তত একটি ব্যাপারে স্বস্তি এনে দিচ্ছে যে ফুটবল বিশ্ব এখন আর কোনো নির্দিষ্ট মহাদেশের হাতে কুক্ষিগত হয়ে নেই।

১৯৯০ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ইউরোপ থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল ছয়টি দেশ। অন্যদিকে উত্তর-মধ্য ও লাতিন আমেরিকা মিলিয়ে আর্জেন্টিনা ছিল শেষ আটের একমাত্র দেশ। অপর দলটি ছিল আফ্রিকার ক্যামেরুন। চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপ যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হলেও সেবার ভারসাম্যের অবস্থা ছিল আরও খারাপ। সেবার সাতটি ইউরোপীয় দেশের বিপরীতে আমেরিকা থেকে ছিল একমাত্র ব্রাজিল। এরপর থেকে অবশ্য প্রতিটি বিশ্বকাপেই শেষ আটের লড়াইয়ে একটু একটু করে উন্নত হয়েছে মহাদেশীয় শক্তির ভারসাম্য। আটানব্বইয়ের ফ্রান্স বিশ্বকাপে ছয়টি ইউরোপীয় দলের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে আমেরিকা থেকে খেলেছিল দুটি দেশ। ২০০৬ সালে ছিল আটনব্বইয়ের অবস্থাই (৬:২)। মাঝখানে জাপান-কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০০২ বিশ্বকাপে চারটি ইউরোপীয় দল আর দুটি আমেরিকান দলের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা পেয়েছিল এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১০ বিশ্বকাপ অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছিল শক্তির ভারসাম্যের। সত্তরের মেক্সিকো বিশ্বকাপের পর সেবারই প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ইউরোপ ছিল সংখ্যালঘু। এবার চারের বিপরীতে চার যেন বিশ্বকাপে এনে দিয়েছে সেই স্বপ্নের ভারসাম্য। বিশ্বকাপের ৮৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো যেন বিশ্বকাপকে মনে হচ্ছে সত্যিকারের ‘বিশ্বকাপ।’
আমেরিকা মহাদেশের কোনো দেশ থেকে কখনোই ইউরোপের কোনো দল বিশ্বকাপ জিতে ফিরতে পারেনি—এটা এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসের ধ্রুব সত্য। তবে লাতিন আমেরিকার ব্রাজিলের কারণে এটা আমেরিকা মহাদেশের জন্য ধ্রুব সত্য নয়। ১৯৫৮ সালে সুইডেন থেকে তারা জিতে ফিরেছিল বিশ্ব জয়ের সম্মান।
এবার হল্যান্ড কোচ লুই ফন গাল, ফ্রান্সের দিদিয়ের দেশম, জার্মানির জোয়াকিম লো আর বেলজিয়ামের মার্ক উইলমটসের সামনে ইউরোপের সেই ‘জুজু’ মিটিয়ে ফেলার পালা। তঁরা তা পারবেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।
ব্রাজিল কোচ লুইস ফেলিপে স্কলারি অপেক্ষায় আছেন দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপজয়ী কোচ হওয়ার। আর্জেন্টাইন কোচ আলেসান্দ্রো সাবেলা স্বপ্ন দেখছেন সিজার লুই মেনোত্তি আর কার্লোস বিলার্দোর পর তৃতীয় আর্জেন্টাইন কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের অনন্য সম্মান ছুঁয়ে দেখতে। স্কলারি-সাবেলা দুজনই নিজেদের ঝালিয়ে নিচ্ছেন বরাবরের মতো এবারও লাতিন মাটি থেকে ইউরোপীয়দের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে।
এবারের বিশ্বকাপে ইউরোপ-আমেরিকার সমতা কিন্তু হঠাত্ই চলে আসা কোনো ব্যাপার নয়। পুরো ব্যাপারটিই বিশাল একটি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মনে করছেন অনেকে। আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি লাতিন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক খেলোয়াড় ইউরোপের নাম করা লিগগুলোয় অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই মূলত এই প্রক্রিয়াটা ত্বরান্বিত হয়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় আলাদাভাবে লাতিন-স্টাইল বলে আর কিছু নেই। লাতিন দেশগুলো ইউরোপীয় পাওয়ার ফুটবলের সংমিশ্রণ যেমন ঘটিয়েছে নিজেদের খেলায়, ঠিক তেমনি ইউরোপীয় দলগুলোও লাতিন আমেরিকার স্কিলনির্ভর পাসিং ফুটবলকে গ্রহণ করেছে ভালোভাবেই। কৌশলের পার্থক্য কমে গেছে বৈপ্লবিকভাবেই। সে কারণে এই মুহূর্তে ইউরোপ ও আমেরিকার ফুটবল-শক্তিতে এসেছে ব্যাপক ভারসাম্য।
এবারের বিশ্বকাপে স্পেন, ইংল্যান্ড, ইতালির মতো দলগুলো ব্যাপকভাবেই ব্যর্থ। এর কারণ হিসেবে অনেকেই বলছেন ব্যস্ত মৌসুমের কথা। স্পেন, ইংল্যান্ড, ইতালি—এই তিনটি দেশের ঘরোয়া লিগই কিন্তু ভুবনবিখ্যাত। প্রচণ্ড কঠিন তাদের ফুটবল মৌসুম। বিশ্বকাপ ফুটবল এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন ইউরোপীয় লিগে খেলা অনেক বাঘা বাঘা ফুটবলারই পরিশ্রান্ত। ব্যস্ত মৌসুম কাটিয়ে কয়েক দিন বিশ্রাম নিয়ে বিশ্বকাপের মতো একটি আসরে খেলতে নামা নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়। এটা বিশ্বকাপে তাদের ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
আরও একটি ব্যাপার হচ্ছে, মোটিভেশনের অভাব। স্প্যানিশ ফুটবলার ইকার ক্যাসিয়াস এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর বলেছিলেন, ‘লা ডেসিমা জয় (দশমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়), নাকি বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও বড় ব্যাপার।’ ক্যাসিয়াসের এই মন্তব্য সে সময় দারুণ সমালোচিতই হয়েছিল। তবে কি ক্লাব পর্যায়ে বড় বড় সাফল্য পেয়ে অনেক খেলোয়াড়ের কাছে বিশ্বকাপ জয়টা গৌণ বিষয় হয়ে পড়ে? এবার স্পেনের পারফরম্যান্স কি সেটাই নির্দেশ করছে না?
আলজেরিয়ার কোচ ভাহিদ হালিলহদিচ ঠিক এ ব্যাপারটিই উল্লেখ করেছেন এবারের বিশ্বকাপ থেকে স্পেনের বিদায় নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে, ‘তারা গত সাত-আট বছরে এত কিছু জিতেছে, যে নতুন করে কিছু জয়ের ইচ্ছেটাই তাদের মরে গেছে।’ ইউরোপীয় লিগের ব্যস্ততা আর বছরজুড়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষে বিশ্বকাপে এসে ইউরোপীয় খেলোয়াড়েরা যে ক্লান্ত, এবারের বিশ্বকাপে শক্তির ভারসাম্য আসায় তা প্রমাণিত হয়ে গেছে ভালোভাবেই।
শক্তির ভারসাম্য আবহাওয়ার কারণেও এসেছে বলে মনে করেন অনেকে। ব্রাজিলের উঞ্চ আবহাওয়া যথেষ্ট সমস্যা তৈরি করেছে ইংল্যান্ড ও ইতালির মতো দলগুলোর জন্য। এই আবহাওয়া লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর জন্য একটা সুবিধা বলেও মনে করেন অনেকে। তবে সাবেক ইংলিশ ফুটবলার ক্রিস ওয়াডেল এটাকেই মূল কারণ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। মেক্সিকোয় ছিয়াশির বিশ্বকাপ খেলা এই উইঙ্গার মনে করেন, বর্তমান দুনিয়ায় ক্রীড়াবিজ্ঞানে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, সেটার বিবেচনায় কেবল আবহাওয়াকে দোষারোপ করার দিন শেষ। নিজের মেক্সিকো বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘মেক্সিকোয় আমাদের ৩৫-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খেলতে হয়েছিল। সে তুলনায় ব্রাজিল তো অনেক ভালো। আমি মনে করি, ব্রাজিল ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের ‘নেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।’
ব্রাজিলের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যে শক্তির একটা ভারসাম্য এনেছে, এটা কিন্তু অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।