ব্যাটিংয়ে অতৃপ্তি, বোলিংয়ে পরিকল্পনাহীনতা

বৃষ্টি বিঘ্নিত সিরিজটি শেষ পর্যন্ত স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজই জিতে নিয়েছে ২–০ ব্যবধানেটুইটার

প্রেসবক্সে মৃদু সুর উঠল, ‘ও বাঙালী বাবু...।’ লাইনটা গায়ানার জনপ্রিয় চাটনি গান ‘ও বাঙালী বাবু... ও গায়ানিজ বাবু’ থেকে নেওয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের নবম ওভারে বোলিংয়ে আসা মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রথম বলেই লং অফ দিয়ে ছক্কা মারেন নিকোলাস পুরান। মোস্তাফিজের প্রতি পুরানের এমন ‘স্বাগত সম্ভাষণ’ দেখেই কিনা স্থানীয় এক সাংবাদিকের কণ্ঠে চলে এল গানের লাইনটা।

বাংলাদেশ–ওয়েস্ট ইন্ডিজ তৃতীয় টি–টোয়েন্টির ফাঁকে ফাঁকে প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামের লাউড স্পিকারে বাজছিল ইন্দো–গায়ানিজ সঙ্গীত, ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত যে কেউ সে সব গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে প্রলুব্ধ হবেন। তবে এত গানের ভীড়ে ‘ও বাঙালী বাবু...’ গানটা একবারও শোনা যায়নি লাউড স্পিকারে, মোস্তাফিজের ছক্কা খাওয়ার উদ্‌যাপনে যে অপূর্ণতা কিছুটা হলেও দূর করলেন ওই সাংবাদিক।

গায়ানায় বাংলাদেশের ‘বাঙালী বাবু’রা টি–টোয়েন্টি সিরিজের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকেছেন ৫ উইকেটের হারে। বৃষ্টি বিঘ্নিত সিরিজটি শেষ পর্যন্ত স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজই জিতে নিয়েছে ২–০ ব্যবধানে। টেস্টের পর টি–টোয়েন্টি সিরিজেও হার। এখন যদি ১০ জুলাই থেকে শুরু ওয়ানডে সিরিজ থেকে কিছু সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পারেন ‘বাঙালী বাবু’রা!

ম্যাচের আগের দিন রবার্ট অ্যাম্ব্রোস বলেছিলেন, প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামের উইকেটে ১৬০–১৮০ রান করা অনায়াসে সম্ভব। একটু ভালো ব্যাটিং করলে ১৯০–২০০–ও নাকি অসম্ভব নয়। গত ১৬ বছর ধরে গায়ানার এ মাঠে গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে কাজ করছেন অ্যাম্ব্রোস। উইকেটটা তাঁর না চেনার কথা নয়।

টসে জিতে মাহমুদউল্লাহ ব্যাটিং নেওয়ার পর দেখা গেল কাইল মায়ার্স–ওবেদ ম্যাকয়দের বলগুলো দারুণভাবেই ব্যাটে আসছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। ওপেনার লিটন দাস এবং পরে আফিফ হোসেন তো দুর্দান্ত কিছু শটও খেললেন সেসব বলে। কিন্তু রবার্ট অ্যাম্ব্রোসকে সন্তুষ্ট করার মতো রান কি করতে পারল বাংলাদেশ? কিংবা এই উইকেটে ৫ উইকেটে ১৬৩ রান—ব্যাটসম্যানরা নিজেরাই কি সন্তুষ্ট হতে পারলেন নিজেদের ব্যাটিংয়ে?

বাংলাদেশকে ছিটকে দিয়েছে মায়ার্স-পুরানের জুটি
টুইটার

টি–টোয়েন্টির জন্য নাকি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কানে ‘হয় মার, না হয় মর’র মন্ত্র পড়ে দিয়েছেন কোচরা। কিন্তু প্রথমটিতে কারো কারো বেশ অনীহাই মনে হচ্ছে। লিটনেরর কথাই ধরুন। যা একটু হাত খুলেছিলেন আউট হওয়ার আগে। তার আগে শুরুতে করেছেন খোলসে ঢুকে থাকা ব্যাটিং। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে মায়ার্সকে প্রথম বাউন্ডারি মারার আগে ১০ বলে ৮ রান। ৪১ বলে ৪৯ রান করে ১৩তম ওভারে ফিরেছেন হেইডেন ওয়ালশের অফ স্টাম্পের বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে। আফিফের সঙ্গে ৪৪ বলে ৫৭ রানের জুটিতে লিটনের ব্যাট থেকে তিন চারের সঙ্গে আসে দুটি ছক্কা।

আরও পড়ুন

লিটনের আগেই ড্রেসিংরুমে ফেরা আরেক ওপেনার এনামুল হক এবং সাকিব আল হাসান অবশ্য মারতে গিয়েই ‘মরেছেন’। স্মিথের ফুলটসে বাউন্ডারি মেরে এনামুল ফিরেছেন পরের বলেই। লেগের দিকে আসা বল তুলে মারতে গিয়ে ব্যাটের আগায় লাগিয়ে থার্ডম্যানে ক্যাচ। লিটনের সঙ্গে তাঁর ওপেনিং জুটি হয়েছে ৩৫ রানের।

প্রথম দুই ম্যাচে দলের সেরা ব্যাটসম্যান সাকিবও এদিন নিষ্প্রভ, ফিরেছেন ৩ বল খেলে আর ৫ রান করে। রোমারিও শেফার্ডকে থার্ডম্যান দিয়ে চার মারার পরের বলটাই তুলে মারতে গিয়ে মিড-উইকেটে ক্যাচ দিয়েছেন ওডিন স্মিথের হাতে। পরপর ২ ওভারে বাংলাদেশ হারায় ২ উইকেট। পাওয়ার প্লেতে এনামুল আর সাকিবকে হারিয়ে বাংলাদেশ তুলতে পেরেছে ৪৪ রান।

ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র আফিফকেই মনে হয়েছে স্বচ্ছন্দ। লিটনের সঙ্গে ওই জুটির পর চতুর্থ উইকেটে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুটি বেঁধে ৪৯ রান। দুই ছক্কা আর দুই চারে ৩৮ বলে টি–টোয়েন্টিতে নিজের দ্বিতীয় ফিফটির (৫০) ইনিংসে দারুণ কিছু শট খেলেছেন তরুণ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ১৯তম ওভারের তৃতীয় বলে আফিফ রানআউট হওয়ার দুই বল আগেই অবশ্য ২০ বলে ২২ রান করে হেইডেন ওয়ালশের কুইকারে এলবিডব্লু হয়ে যান মাহমুদউল্লাহ।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের রান শেষ পর্যন্ত ১৬০ পার হয়েছে ম্যাকয়ের শেষ ওভারে মোসাদ্দেক হোসেনের পরপর দুই বাউন্ডারিতে। কিন্তু ম্যাচের ১০ বল বাকি থাকতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় বুঝিয়ে দিল এই উইকেটে জেতার জন্য ১৬৩ রান যথেষ্ট ছিল না। মাহমুদউল্লাহকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে মারা নিজের পঞ্চম ছক্কায় জয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন পুরান। পাঁচ ছক্কার সঙ্গে পাঁচ বাউন্ডারি, মাত্র ৩৮ বলে অপরাজিত ৭৪ রানের ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচও তিনিই।

৪৩ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিন উইকেট ফেলে দিয়ে বোলিংয়ের শুরুটা খারাপ করেনি বাংলাদেশ। কিন্তু এরপরই মাত্র ৮ ওভার ২ বলে মায়ার্স–পুরানের ৮৫ রানের জুটিতে ম্যাচে ফিরে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যেখান থেকে তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন নিকোলাস পুরান
টুইটার

শুরুটা বাদ দিলে বোলিং এবং বোলিং নিয়ে পরিকল্পনা, দুটোতেই বেশ এলোমেলো ছিল বাংলাদেশ। নতুন বলে প্রথম ওভারেই ব্রেন্ডন কিংকে ফেরানোর পর বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ নিয়েছেন মায়ার্সের উইকেটটিও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নামের পাশে ৪ ওভারে ৪৪ রান। পুরানের ছক্কায় ‘স্বাগত সম্ভাষণ’ পাওয়া মোস্তাফিজকে তো মাহমুদউল্লাহ দুই ওভারের বেশি বলই করাতে পারেননি। ২ ওভারে একজন বোলার ২৭ রান দিয়ে ফেলার পর অধিনায়ক সেটা আর করানইবা কীভাবে! মাঝে শরীফুল এসে উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া পুরানকে শর্ট বল দিয়ে ছক্কা খেয়ে ‘নিবৃত’ হয়েছেন ১৩ রান দিয়ে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর সাকিবকে দীর্ঘ সময় বল না দেওয়া দেখে। ইনিংসের সপ্তম ওভারে বোলিংয়ে এসে ৪ রান দিয়ে সাকিব তুলে নিয়েছিলেন স্মিথের উইকেটটি। অথচ মাহমুদউল্লাহ কিনা এরপরই থামিয়ে দিলেন সাকিবের বোলিং! নবম ওভারে তাঁকে থামিয়েই মোস্তাফিজকে আনা, এরপর তো প্রথম বলেই পুরানের ওই ছক্কা। মোস্তাফিজের ওই ওভারে এসেছে ১২ রান।

সাকিবকে আবার বোলিংয়ে আনতে অধিনায়ক অপেক্ষা করেছেন ৯ ওভার। যে ম্যাচে বাংলাদেশকে আট বোলার ব্যবহার করতে হয়েছে, ১৭তম ওভারে আরেকবার বোলিং পাওয়া সাকিব সে ম্যাচেই কিনা বোলিং করলেন মাত্র ২ ওভার!

কেন, সেটার ব্যাখ্যা অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহই ভালো দিতে পারবেন। ম্যাচ শেষের সংবাদসম্মেলনে টেস্ট দলের সহ–অধিনায়ক লিটন দাসও তাই বললেন। মাঠের সিদ্ধান্ত সবই অধিনায়কের।