মুক্তিযুদ্ধে ক্রীড়াঙ্গন
বৃথা যায়নি শহীদ জুয়েলের আত্মত্যাগ
বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল ক্রীড়াঙ্গনও। প্রতিবাদের ভাষা ছিল নানা রকম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধে ক্রীড়াঙ্গনের অংশগ্রহণ নিয়েই এই ধারাবাহিক—
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে হত্যা করা হলো আজাদ বয়েজ ক্লাবের ক্রিকেট সংগঠক মুশতাককে। দুই দিন ধরে তাঁর নিথর দেহ পড়ে ছিল ঢাকা জেলা ক্রীড়া পরিষদের সামনে। আর তা দেখে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে আজাদ বয়েজের ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েলের বুকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণের জন্য মে মাসে তিনি চলে যান ভারতে।
আগরতলার কাছে মেঘালয় ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুনের হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দ্রুত অস্ত্র চালনা শিখে সফল ও দুর্ধর্ষ সব লড়াইয়ে অংশ নেন। কিন্তু আগস্টে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে গেরিলা হামলার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে জুয়েল আহত হলেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণে তাঁর হাত থেঁতলে যায়। আঘাত পাওয়ার পরও বোনদের বলতেন, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমি আবার ক্রিকেট খেলতে পারব তো?’ কিন্তু পারেননি। ২৯ আগস্ট বড় মগবাজার এলাকায় চিকিৎসাধীন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। কয়েক দিনের মধ্যেই জুয়েলকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানিরা।
ডানহাতি এ উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেটে প্রথমে খেলেন আজাদ বয়েজে। উইকেটকিপার হিসেবে নজর কাড়েন। ১৯৬৮ সালে নাম লেখান মোহামেডানে, এটিই ছিল তাঁর শেষ ক্লাব। পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অন্যতম মুখ জুয়েলের দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ, অমর এক ইতিহাস হয়ে আছে।
শহীদ জুয়েল বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছিলেন। তবে ৫০ বছর পর এসে তাঁর বোন সুরাইয়া খানের মনে হয়, ভাইয়ের মূল্যায়ন হয়নি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জুয়েল-মুশতাকের নামে ১৬ ডিসেম্বর একটি প্রীতি ম্যাচ হয় মিরপুরে। এই এক দিনই হয় জুয়েল–স্মরণ। মিরপুরে ওর নামে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, ছোট হওয়ায় সেটা ভালোভাবে দেখাও যায় না। আমি মনে করি, মিরপুরে ওর একটা ভাস্কর্য থাকা উচিত।’
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার। ক্রিকেটের মাঠ থেকে ছড়িয়েছেন প্রতিবাদের ঢেউ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলে প্রতিবাদে ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল একাদশ বিসিসিপি একাদশের ক্রিকেট ম্যাচে দর্শকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এর ঠিক ৫ দিন আগেই পাকিস্তানি শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকায় নিজের ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগিয়ে ব্যাট করতে নেমে পড়েন রকিবুল হাসান।
১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক একাদশের বিপক্ষে পাকিস্তানের হয়ে বেসরকারি টেস্ট খেলতে নামেন ১৮ বছরের তরুণ রকিবুল। করাচির আজমত রানাকে নিয়ে খেলতে নামার পর খবর রটে, ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ স্টিকার নিয়ে পাকিস্তানের হয়ে খেলছেন একজন বাঙালি ছেলে।
৫০ বছর পেছনে ফিরে গর্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা রকিবুল স্মৃতিতে তুলে আনেন সে দিনটির কথা, ‘ম্যাচের আগের দিন শেখ কামাল ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন পূর্বাণী হোটেলে আমার রুম নম্বর ৭০৭–এ এল আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে। আমি তখন ব্যাটে “জয় বাংলা” স্টিকার লাগিয়ে ব্যাট করার কথাটা বললাম ওদের। বললাম, কাল একটা ধামাকা দেখাব। কামাল সঙ্গে সঙ্গে জালালকে বলল, “যেখান থেকে পারো এ স্টিকার নিয়ে আসো।” স্টিকার জোগাড় হলো। শেখ কামাল আমার ব্যাটে স্টিকার লাগিয়ে দিল। আমি ব্যাট করতে নামলাম। আজও শিহরিত হই দিনটির কথা ভেবে।’
রকিবুল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনেরও চেষ্টা চালান। ছয়জন ক্রিকেটারও ছিল তাঁর হাতে। যদিও শেষ পর্যন্ত ম্যাচ আয়োজন করা হয়নি।
ষাটের দশকে ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে অন্যতম শক্তিশালী ক্লাব বিবিসির (বকশীবাজার ক্লাব) পেসার শাফায়াত জামিলও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ক্রিকেট ছেড়ে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মার্চে মেজর পদে পদোন্নতি এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি পেয়েছেন বীর বিক্রম খেতাব। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা তানভীর মাজহার তান্না পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সদস্য। জুডো ও কারাতের মানুষ মেজর (অব.) নূরন্নবী ওরফে মুন্না ১৯৬৯ সালে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলা শুরু করেন উদিতির হয়ে। মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা তিনিও। কাজী সালাউদ্দিন, নওশেরুজ্জামানরা স্বাধীন বাংলা দলের জার্সিতে ফুটবল খেললেও তাঁরা ছিলেন ক্রিকেটার।
দেশের মুক্তির জন্য লড়েছেন প্রবাসীরাও। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দল ইংল্যান্ড সফরে গেলে প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকেরা ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করেন। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পোড়ান তাঁরা।