বিদায় 'কালো চিতা'

উত্তরসূরি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হাতে ২০১০-১১ মৌসুমের ‘ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু’ তুলে দিচ্ছেন ইউসেবিও। নিজেও দুবার এ পুরস্কার জিতেছিলেন ইউসেবিও ছবি: ফাইল ছবি
উত্তরসূরি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হাতে ২০১০-১১ মৌসুমের ‘ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু’ তুলে দিচ্ছেন ইউসেবিও। নিজেও দুবার এ পুরস্কার জিতেছিলেন ইউসেবিও ছবি: ফাইল ছবি

চিতার মতো দম ছিল তাঁর। কাল সকালে সেই দমটা ছেড়ে দিলেন। চিরদিনের জন্য।
কী ভীষণ ক্ষিপ্র ছিলেন একসময়। চোখের পলকে বোকা বানাতে পারতেন যেকোনো প্রতিপক্ষকে। বেয়াড়া হূদ্যন্ত্রটাকেও তেমনি বোকা বানিয়ে আর কিছুদিন থেকে গেলে কী হতো! ৭৩ পেরিয়ে যাওয়া বন্ধু পেলে আর ৭৬ ছাড়ানো বব চার্লটনরা বেঁচে আছেন দিব্যি হেসেখেলে। এই তো সেদিন মাঠে গিয়ে উরুগুয়ের খেলাও দেখলেন ৮৭ বছর বয়সী ঘিগিয়াও।
ইউসেবিও পারলেন না। না-ফেরার দেশে চলে গেলেন একাত্তরেই। সেই হূৎপিণ্ডটাই বিশ্বাসঘাতকতা করল। কয়েক বছর ধরে পর্তুগিজ কিংবদন্তিকে ভুগিয়ে গতকাল সকালে বন্ধ হয়ে গেল চিরদিনের জন্য। এর কিছুক্ষণ পর বেনফিকার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বলা হয়, ‘আমাদের জন্য এ এক গভীর দুঃখের দিন।’
দুঃখটা শুধু বেনফিকা কিংবা পর্তুগালের নয়, এ গ্রহের প্রত্যেক ফুটবলপ্রেমীর। ক্লাব, দেশ ছাড়িয়ে ফুটবল-অন্তঃপ্রাণ সবার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বলেই না তাঁর মৃত্যুতে জার্মানিতে বসেও শোকে মুহ্যমান ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইংল্যান্ড থেকে শোকবার্তা পাঠাচ্ছেন গ্যারি লিনেকার। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লুইস ফিগো আর হোসে মরিনহোদের চোখ আর্দ্র হয়ে উঠতেই পারে—ইউসেবিও তাঁদের দেশেরই অহংকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্তুগালের তখনকার উপনিবেশ মোজাম্বিকের মাপুতোতে জন্ম। রেলশ্রমিক অ্যাঙ্গোলিয়ান বাবা আর আফ্রিকান মায়ের চতুর্থ সন্তান

১৯৬৬ বিশ্বকাপে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ইউসেবিওর করা চার গোলের একটি ছবি: ফাইল ছবি
১৯৬৬ বিশ্বকাপে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ইউসেবিওর করা চার গোলের একটি ছবি: ফাইল ছবি

ইউসেবিওর ফুটবলের নেশা ছিল খুব ছোটবেলা থেকেই। কাগজ আর মোজা দিয়ে বানানো বলে হাতেখড়ি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলতে খেলতে স্থানীয় ক্লাবের নজরে পড়ে যাওয়া—এই গল্পটা বোধ হয় শুধু ইউসেবিওর নয়, আরও অনেক কিংবদন্তির। তবে ইউসেবিওর জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল ১৮ বছর বয়সে সাবেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার হোসে কার্লোস বাওয়ারের নজরে পড়ায়। ওইটুকু ছেলের গতি, ডান পায়ের শট আর দুর্দান্ত ড্রিবলিং দেখে তিনি তাঁকে সাও পাওলোতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ব্রাজিলিয়ান ক্লাবের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে ইউসেবিওকে নিয়ে যান বেনফিকায়। বাওয়ারের একসময়ের কোচ বেলা গাটম্যান তখন বেনফিকার দায়িত্বে। প্রথম দিনে ট্রায়ালে ইউসেবিওকে দেখেই নাকি গাটম্যান তাঁর সহকারীকে বলেছিলেন, ‘এ তো সোনার টুকরা।’ সে-ই শুরু। পরের ১৫ বছরে বেনফিকার হয়ে ফুটবল মহাকাব্যে অনেক নতুন অধ্যায় যোগ করেছেন ইউসেবিও। ১১টি লিগ শিরোপা, ৭ বার তিনিই পর্তুগিজ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। তিনবার ইউরোপিয়ান কাপের রানার্সআপ হওয়ার পাশাপাশি একবার (১৯৬২) শিরোপা জিতেছেন ডি স্টেফানো-পুসকাস-জেনতোর রিয়াল মাদ্রিদকে ফাইনালে হারিয়ে। ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের শুরু পর্যন্ত ওই সময়টায় বেনফিকায় ইউসেবিওর প্রভাব কতটা ছিল সেটা বোঝাতে তার একসময়ের সতীর্থ অ্যান্টোনিও সিমোস একবার বলেছিলেন, ‘ওকে ছাড়া আমরা বড়জোর লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারতাম, ইউরোপে সেরা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ গতি, ক্ষিপ্রতা, ড্রিবলিং আর ডান পায়ের ভয়ংকর শটের কারণের সতীর্থ-প্রতিপক্ষ সবার কাছেই তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘কালো চিতা’।
ক্লাবের হয়ে এই কীর্তির পাশাপাশি পর্তুগালের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জনটাও এসেছিল তাঁর হাত ধরেই। অনেক দিন ধরে পর্তুগালের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনটাও ছিল তাঁর দখলে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে দলকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের কাছে শেষ চারে ২-১ গোলে হারের পর তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফিরেছিলেন তৃতীয় হয়ে। তবে যে ম্যাচের জন্য ইউসেবিও ফুটবল রূপকথায় চিরকাল আলাদা জায়গা নিয়ে থাকবেন সেটা ওই টুর্নামেন্টেই কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে। মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল পর্তুগাল। শেষ চারে খেলার আনন্দে উৎসব শুরু হয়েছিল উত্তর কোরিয়ায়। সেখান থেকে একাই পর পর চার গোল করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখেন ইউসেবিও। পর্তুগাল ম্যাচ জেতে ৫-৩ গোলে!
আফসোস, না-ফেরার দেশ থেকে এমন প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পাচ্ছেন না ইউসেবিও।

সদা শাশ্বত ইউসেবিও, শান্তিতে থাকুন।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

দ্য কিং! আমাদের সবার জন্য বিশাল ক্ষতি। সবার সেরা।
লুইস ফিগো

সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার, আমার বন্ধু ইউসেবিও চলে গেলেন। তাঁর পরিবারের জন্য সহমর্মিতা।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার

তিনি পর্তুগালের মহানায়ক, একজন মহান মানুষ। আমি মনে করি তিনি অমর।
হোসে মরিনহো

একজন বড় মাপের ফুটবলার চলে গেলেন। অসাধারণ ও সুন্দর সব মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই ইউসেবিওকে।
রুড খুলিত

ইউসেবিও ফুটবল ও ফিফার দূত ছিলেন। তাঁর অভাব গভীরভাবে অনুভূত হবে। শান্তিতে থাকুন কালো চিতা।
সেপ ব্ল্যাটার

জন্ম
মাপুতো, মোজাম্বিক
জাতীয়তা
পর্তুগিজ
উচ্চতা
৫ ফুট ৯ ইঞ্চি
পজিশন
স্ট্রাইকার
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার
১৯৬১-১৯৭৩
৬৪ ম্যাচ
৪১ গোল
জয় ৩৩
ড্র ১২
হার ১৯
বিশ্বকাপ
১৯৬৬
৬ ম্যাচ
৯ গোল
জয় ৫
হার ১
বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব
১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৭৪
১৭ ম্যাচ, ১২ গোল
জয় ৬, ড্র ৪, হার ৭
গোল
৭৪৫ পেশাদার ম্যাচে
৭৩৩
ব্যক্তিগত অর্জন
ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলার
১৯৬৫
বিশ্বকাপ গোল্ডেন শু
১৯৬৬
বিশ্বকাপ ব্রোঞ্জ বল
১৯৬৬
ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট
১৯৬৮, ১৯৭৩
ইউরোপিয়ান কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা
১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৮
পর্তুগালের বর্ষসেরা ফুটবলার
১৯৭০, ১৯৭৩
পর্তুগিজ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা
১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭৩
দলীয় অর্জন
১৯৬৬ বিশ্বকাপ
তৃতীয় স্থান
উয়েফা ইউরোপিয়ান কাপ
১৯৬২
পর্তুগিজ লিগ
১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৭, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৫
পর্তুগিজ কাপ
১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭২
উত্তর আমেরিকান ফুটবল লিগ
১৯৭৬