বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এলাকায় পা দিলেই যে কেউই ধন্দে পড়ে যেতে পারেন। এটি দেশের খেলাধুলায় পীঠস্থান, নাকি বিরাট বড় এক বাণিজ্যকেন্দ্র। চারদিক বেচাবিক্রির হাঁকডাক। পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। স্টেডিয়ামে বারান্দাজুড়ে ইলেকট্রনিকসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান। বারান্দার মেঝেও খালি নেই, পণ্য নিয়ে হাঁক দিচ্ছে ভাসমান হকার। পান-সিগারেটের দোকান তো আছেই। অথচ এই স্টেডিয়ামই দেশের খেলাধুলার সবচেয়ে বড় জায়গা। স্টেডিয়ামটির বড় জায়গা আছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসেও।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সেই ইতিহাসের কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। খুঁজে পাওয়ার উপায়ও নেই। কারণ, ইতিহাসের নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। অপরিকল্পিত স্থাপনা তৈরি করে ইতিহাসের এই মঞ্চকে বানানো হয়েছে বাণিজ্যকেন্দ্র। ইতিহাসের এই পীঠস্থানেই রাতে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ—এ লজ্জা আমাদের সবার।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছিলেন। ঠিক সে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামেই চলছিল পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের ম্যাচ। সেখানেই ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল সাধারণ দর্শকেরা। দলে দলে তারা মাঠে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল অন্যায় সিদ্ধান্তের। ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সেই ম্যাচ তাই ঠাঁই নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।
রকিবুল হাসান নামের ১৮ বছর বয়সী এক বাঙালি ক্রিকেটার সে ম্যাচে নিজের ব্যাটে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকার লাগিয়ে পাকিস্তানিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকুতি। পাকিস্তানিদের সামনে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কাগজে-কলমে এক দেশ হলেও পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে মানসিক দূরত্বটা। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ ক্ষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কোনো নিদর্শন কি যত্ন করে রাখা হয়েছে?
এই প্রজন্ম কি জানে, স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয় অর্জন করে ১৬ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই ক্যাম্প স্থাপন করেছিল ঢাকায় প্রবেশ করা মুক্তি বাহিনীর প্রথম দলটি। মেজর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) মঈনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি সেনাদল স্টেডিয়ামের পশ্চিম গ্যালারিতে তাঁবু খাটিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গার্ড অব অনার দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ফিরে গিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। এ মাঠের প্যাভিলিয়ন প্রান্তের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যুদ্ধফেরত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়েছিলেন স্বাধীনতার এই স্থপতি। এই অনন্য স্মৃতিগুলো ধূসর হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এখনকার পরিবেশে।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে স্বাধীনতাসংগ্রামের স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনতে কিছুই কি করার নেই? ক্রিকেটের পীঠস্থান লর্ডসে রয়েছে আটটি গ্যালারি—দ্য প্যাভিলিয়ন, ওয়ার্নার স্ট্যান্ড, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড কম্পটন স্ট্যান্ড—এমন কত নামেই না সেখানে গ্যালারির নামকরণ হয়েছে। আমাদের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কোনো এক কালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও ক্রিকেট সংগঠন মুশতাক হোসেনের নামে দুটি গ্যালারির নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এ মাঠ থেকে ক্রিকেট সরে যাওয়ার পর ওই নামকরণও বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠে একবার হেঁটে দেখুন। সেখানকার মাটির ইতিহাস জানলে শিহরিত হতে হয়। পল্টন প্রান্তের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কল্পনার মানসপটে হয়তো অনেক কিছুই ভেসে উঠবে। ওই যে পশ্চিম গ্যালারি বরাবর যুদ্ধফেরত সেনাদলের তাঁবু! রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা চেহারায় সেনারা বিশ্রাম নিচ্ছেন অনাগত এক ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। প্যাভিলিয়ন প্রান্তে বানানো মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বজ্রকণ্ঠে শোনাচ্ছেন একটি জাতির আনন্দ-বেদনার কাব্য। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরই এক সহযোগী মুষ্টিবদ্ধ স্লোগান দিচ্ছেন—জয় বাংলা!
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের সেই দৃশ্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ঢুকলে যেকোনো ইতিহাসপ্রেমীর মানসপটে ভেসে উঠবেই। কিন্তু এসব ইতিহাস কি বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়েছে? নানা উদ্যোগ, নানা স্মারকে ইতিহাসের এই আবেগ ছড়িয়ে দিতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে—কিন্তু তেমনটি তো কখনোই দেখা গেল না এ দেশের খেলাধুলার ইতিহাসে।