বঞ্চনার প্রাপ্তি কিংবা অর্জনের আলো

এবার এই ট্রফি উঠবে কোন দলের হাতে? এএফপি
এবার এই ট্রফি উঠবে কোন দলের হাতে? এএফপি

পৃথিবীর মানচিত্রটা যদি খেয়াল করেন, দেখবেন অনেকগুলো দেশের এক্কেবারে নিচে অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার ।দক্ষিণ গোলার্ধের বিশাল দেশটির নাম তাই ‘ডাউন আন্ডার’। এই আদুরে নামটির মতোই দেশটিও চমৎকার। বৈচিত্র্যে ভরা। আদ্যন্ত ক্রীড়ামনস্ক জাতি। ক্রিকেট নামের মোহনীয় খেলাটির জনক যদি হয় ইংল্যান্ড, তাহলে অস্ট্রেলিয়া সেটির প্রতিপালক । অস্ট্রেলীয়দের শ্রম-ঘাম, মেধা-মনন, উদ্ভাবন-উদ্দীপনার কাছে আধুনিক ক্রিকেটের অনেক ঋণ। আর ৪৮ ঘণ্টা পর সেখানেই যে একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বযজ্ঞ শুরু হচ্ছে, সেটির আঁতুড়ঘরই তো অস্ট্রেলিয়া!
বৃষ্টির পাকে-চক্রে একটা টেস্ট ম্যাচের গর্ভ থেকে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল একদিনের ক্রিকেট। জন্মসাল ১৯৭১। এ কথা আপনাদের প্রায় সবারই জানা। প্রথম ওয়ানডের পর পেরিয়ে গেছে ৪৪ বছর।এই পৌনে চার যুগে ৩৫৯৮টি ওয়ানডের পর অস্ট্রেলিয়াতেই দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের বোধন। ১৯৯২-এর প্রথম আয়োজনের মতো তাসমান সাগর প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ড এবারও সঙ্গী অস্ট্রেলিয়ার।
সেখানে যেকোনো ক্রীড়া শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চ মানেই নতুন কিছু। রূপ-রং-রসে ভরা ’৯২-এর মতো বিশ্বকাপ এবারও অনেক নতুন উপহারই দিতে পারে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে । বিস্ময়ের ভাঁজ খুলে খুলে দেয় সবচেয়ে নতুন উপহারটি হতে পারে কোনো নতুন অধিনায়ককে শিরোপা সমর্পণ। ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনি ছাড়া এই জায়গাটায় আর সবাই নতুন । আর টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর ক্ষেত্রে—হোন না তিনি অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল ক্লার্ক, নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, ইংল্যান্ডের এউইন মরগান, দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স, পাকিস্তানের মিসবাহ-উল-হক, শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেসন হোল্ডার, বাংলাদেশের মাশরাফি বিন মুর্তজা, জিম্বাবুয়ের এলটন চিগুম্বুরা। সম্ভাবনায় আলোকবর্ষ দূরের আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশ আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড, আরব আমিরাতের অধিনায়কদের নাহয় বাদই রাখা গেল।
১৯৭৫ ও ১৯৭৯—টানা দুবার বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরে গৌরবে ভেসেছিলেন ক্লাইভ লয়েড। ২০০৩ ও ২০০৭—টানা দুবার বিশ্বকাপ জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়কের পাশে বসেন অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিং। ‘হ্যাটট্রিক’ কেউই করতে পারেননি। তবে সামর্থ্য ও সম্ভাবনা নিয়ে কাছাকাছি গিয়েছিলেন দুজনই। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে তো বলতে গেলে ‘ক্যাচ’ ফেলার মতোই ফাইনালে গিয়ে ট্রফিটাকে ফেলে দিয়েছিল লয়েডের দল। ২০১১ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে হার মানতে হয় পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে। ঘটনাচক্র যে, এই দুবারই বিজয়ী দলের নাম ভারত। লয়েডকে হ্যাটট্রিক-বঞ্চিত করেছিল কপিল দেবের ভারত। ধোনির ভারতের সামনে এসে থেমে যায় পন্টিংয়ের জয়রথ।

বিশ্বকাপের চল্লিশ বছরের এই ইতিবৃত্ত যে সত্যকে সামনে তুলে আনে, তা হলো, কোনো অধিনায়ক টানা দুবার শিরোপা জিততে পারেন; টানা তৃতীয়বার কোনোক্রমেই নয়। ক্রিকেট–বিধাতাই যেন বাধার দেয়াল তুলে দাঁড়ান ।সেই হিসেবে ধোনির সামনে সুযোগ দ্বিতীয়বার ট্রফি হাতে তোলার। কে আবার হ্যাটট্রিকের সামনে এসে দাঁড়ান, সেটি দেখতে কত যুগ-যুগান্তরের অপেক্ষা চলতে থাকবে কে বলবে! এ প্রসঙ্গ বাদ। আমরা বরং ধোনির ভারতের টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে পারি। যে সম্ভাবনা ক্রমশই ঢুকে পড়ছে ধূসর দিগন্তে ।ধোনিদের নিয়ে বাজি ধরতে চূড়ান্ত আশাবাদী ভারতীয়দেরই বুক কাঁপছে।
অস্ট্রেলিয়ার জল-হাওয়ায় আড়াই মাস কাটিয়েও ভারত নিজেদের ফিরে পায়নি। স্মিথ-ওয়ার্নার-ম্যাক্সওয়েলদের চাবুকে নীল হয়ে গেছে ভারতীয় বোলিং। জনসন-অ্যান্ডারসন-হ্যারিস-কামিন্স-ফিনদের তোপে উদ্ভ্রান্ত কোহলি-ধাওয়ান-রায়না-রোহিতদের ব্যাটিং। তবে কে জানে, বিশ্বকাপের মঞ্চে অন্য ভারতকে দেখা যেতেও পারে। এমনটা হতে পারে যে গ্রীষ্মের উষ্ণতা মেখে দ্রুতগতির, বাউন্সি উইকেটের ‘জুজু’ নির্বিষ হতে থাকবে আর খোলস ছেড়ে বেরোবে ভারতের দাপুটে ব্যাটিং। যে দলে দুটি ওয়ানডে ডাবল সেঞ্চুরির মালিক রোহিত শর্মা আছেন, আছেন ছাব্বিশেই নামের পাশে ২১টি শতক লিখিয়ে ফেলা বিরাট কোহলি, তাদের দ্রুতই মুছে ফেলা যায় না। শেষ বিচারে ওয়ানডে ক্রিকেট ব্যাটসম্যানদেরই খেলা হয়ে ওঠে। বিপুল অর্থযোগের এই সময়ে বলের আঘাতে স্টাম্প উপড়ানো শব্দের চেয়ে চার-ছক্কার বৃষ্টিটাই বেশি উপভোগ্য মনে করে বিশ্বকাপ।

হ্যাঁ, বিশ্বকাপ নতুন অধিনায়কের হাতে ট্রফি তুলে দিতে ব্যগ্র থাকে। কোনো অধিনায়ককে দ্বিতীয়বার জয়মাল্য দিতেও অনিচ্ছুক সে নয়। তবে তার নিবিড় আকাঙ্ক্ষা সম্ভবত ক্রিকেট তপস্বীর অতৃপ্তি ঘোচানো। ক্রিকেটের তপস্যায় নিবেদিত নায়ককে সব সময় করেনি বঞ্চনা । বঞ্চনার উপান্তে পৌঁছে গিয়েও তাই বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে জনতার অভিবাদন কুড়ান শচীন টেন্ডুলকার। হাতে ট্রফি উঠবে বলেই হয়তো ৪১ বছর বয়সে কোনো দৈব ইশারায় অবসর ভেঙে মাঠে ফেরেন ইমরান খান। অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে উজান ঠেলে এগিয়ে যাওয়া অ্যালান বোর্ডারও পান পুরস্কার। ক্রিকেটে নতুন এক যুগাভিষেক যাঁর হাত ধরে, সেই স্টিভ ওয়াহও প্রাপ্তির আলোয় হন আলোকিত । অর্জুনা রানাতুঙ্গার জয়মাল্যও হয়তো বিদ্রোহী এক ক্রিকেট বীরকে বিশ্বকাপের শ্রদ্ধা। অধিনায়ক হতেই হবে, এমন কথা নেই। ক্রিকেটের প্রকৃত নায়কই বিবেচ্য। ফুটবলের চেয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটটা এখানে একটু আলাদা। ফুটবল নতুন নায়কের মাথায়ই যেন মুকুট পরাতে চায়। বঞ্চনা আর কান্নায় তার মন খুব একটা ভেজে না।

এই বিশ্বকাপে বঞ্চিত, অতৃপ্ত দল যেমন বেশ কটি আছে, নায়কও আছেন কয়েকজন। অতৃপ্ত ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের পাশে বসেই শাপমোচনের দিন গুনছে দক্ষিণ আফ্রিকা । কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনের অন্তরের আক্ষেপ বিশ্বকাপের কাছে গোপন কিছু তো নয়। ৩৯টি সেঞ্চুরিতে মিলিতভাবে ২৬ হাজারেরও বেশি রানের মালিক লঙ্কান দুই নায়কের এটাই যে শেষ বিশ্বকাপ! ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করে বিশ্ব ক্রিকেটকে নাড়িয়ে দেওয়া শহীদ আফ্রিদির ক্যারিয়ারও কি শেষ হবে বিশ্বকাপ না জিতেই?
কে জানে, এবার অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ সান্তা ক্লজ সেজে কাকে প্রাপ্তির তৃপ্তি দেয়!