পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বজন হারানোর কান্না বুকে চেপে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন নতুন করে জেগে ওঠার চেষ্টা করছে। আর সবকিছুর মতো দেশের ক্রীড়াঙ্গনও ছিল নতুন শুরুর অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষারই যেন অবসান হলো ১৩ ফেব্রুয়ারি।
১৯৭২ সালের আজকের দিনেই তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ফুটবল ম্যাচ। ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া সেই প্রীতি ম্যাচে স্বাধীন বাংলা দলের ফুটবলারদের নিয়ে গড়া বাংলাদেশ একাদশের মুখোমুখি হয় ঢাকা মাঠের নির্বাচিত ফুটবলারদের নিয়ে গড়া রাষ্ট্রপতি একাদশ। বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি আয়োজিত সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের ৫০ বছর পূর্ণ হলো আজ। কাকতালীয়ভাবে ৫০ বছর আগের ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল রোববার, আজও সেই রোববারই।
৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই মাসের কম সময়ে ফুটবল মাঠে গড়ানোয় ফুটবলার, সংগঠক, কোচসহ সবাই ছিলেন আনন্দিত। তবে সেই আনন্দের মধ্যে ছিল বিষাদের বেদনা। মুক্তিযুদ্ধে অনেক ক্রীড়াবিদই যে শহীদ হয়েছিলেন! বুকে বন্ধু হারানোর বেদনা নিয়েই ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন ফুটবলাররা। ৯০ মিনিটের ম্যাচটি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্রীড়াবিদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের এক প্রীতি সম্মিলনী।
সেই সম্মিলনীর মধ্যমণি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখনো সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণায় বারবার ফিরে আসেন তিনি। রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ উদ্বোধন করতে আসেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছোট্ট শেখ রাসেলও।
বাংলাদেশ একাদশের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু এই ৮০ ছুঁই ছুঁই বয়সেও সেদিনের রোমাঞ্চটা ভোলেননি। স্মৃতির জানালা খুলে দিয়ে সাবেক এই ফুটবলার বলছিলেন, ‘সেদিন অন্য রকম এক অনুভূতি হয়েছিল। ম্যাচের আগে আমরা দুই দল সারি বেঁধে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলেছিলেন, ‘কী রে পারবি তো ভালো খেলতে? তোরা ভালো খেল।’ তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেকের ছবিটা বাঁধাই করে রেখেছি বাসায়। সেই মুহূর্ত, বঙ্গবন্ধুর উৎসাহব্যঞ্জক কথা, মাঠের পরিবেশ, সবকিছুই আমৃত্যু মনে রাখব।’
রাষ্ট্রপতি একাদশ ২–০ গোলে জিতেছিল ম্যাচটা। জয়ী দলের অধিনায়ক কাজী আবদুর রফিক (দীপু) আরও আগেই প্রয়াত হয়েছেন। প্রয়াত হয়েছেন আরও অনেকেই। অন্যদের কাছেও সেদিনের অনেক স্মৃতি এখন ঝাপসা। রাষ্ট্রপতি একাদশের সহ–অধিনায়ক গোলাম সারোয়ার টিপু বলছিলেন, ‘সদ্য স্বাধীন দেশ পেয়েছি আমরা। সবার মধ্যে নতুন উদ্দীপনা আর আনন্দ। ঢাকা স্টেডিয়ামে সেদিন আমিই প্রথম গোল করলাম, আবদুল গফুর (স্কুটার গফুর নামে বেশি পরিচিত) করেন দ্বিতীয় গোল। আসলে জয়–পরাজয় নয়, সবার সঙ্গে দেখা হওয়াটাই ছিল মূল ব্যাপার। আমাদের ফুটবল ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক হয়ে আছে।’
ম্যাচের পরপর স্টেডিয়াম–সংলগ্ন মোহামেডান টেন্টে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল। সে সময় মোহামেডানে খেলা টিপু স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন, ‘শেখ কামাল মোহামেডান ক্লাবে এসে আমাকে বলল, ‘‘টিপু ভাই দিলেন তো বাবার টিমটাকে হারিয়ে।” দুষ্টুমি করেই কথাটা বলেছে কামাল। তখন আবাহনী দল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল ও। খেলোয়াড় খুঁজছিল।’
রাষ্ট্রপতি একাদশের গোলকিপার ছিলেন শহিদুর রহমান সান্টু। অনেক বছর ধরেই তিনি আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। সেখানে শিশু–কিশোরদের ফুটবল শেখান তিনি। পরশু হোয়াটসঅ্যাপে ৫০ বছর আগের স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বললেন, ‘অনেক দিন পর সেদিন মাঠে গিয়ে দেখলাম প্রচুর দর্শক। মনে হয়েছিল আমরা নতুন জীবন পেয়েছি। যুদ্ধের সময় সবাই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যাই। আবার সবাই একত্র হই ওই ম্যাচটাকে ঘিরে। সত্যি বলতে সেই বিকেলটা আমাদের জন্য বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা হয়ে আসে।’
কিন্তু সেদিন যে আশা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে, তা আজও পূরণ হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলেই বাংলাদেশ পেছনের বেঞ্চের ছাত্র। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ একাদশে খেলা ডিফেন্ডার শেখ আশরাফ আলীর কাছে বড় হতাশার সেটা, ‘স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখব। দেখে ভীষণ উৎফুল্ল ছিলাম। দারুণ কিছু সময় কাটিয়েছিলাম আমরা। স্বপ্ন ছিল, ফুটবলে আমরা অনেক এগিয়ে যাব। কিন্তু সেভাবে এগোতে পারলাম না।’
এ হতাশা আসলে স্বাধীন বাংলাদেশে ফুটবলের গোড়াপত্তন করা সেদিনের সেই ম্যাচে খেলা সবারই।
দুদলে যাঁরা ছিলেন
রাষ্ট্রপতি একাদশ: শহিদুর রহমান সান্টু, বড় নাজির (জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা), জহিরুল হক, এরশাদুর রহমান, মনোয়ার হোসেন নান্নু (ভুট্টো), জিল্লুর রহমান, কাজী আবদুর রফিক (অধিনায়ক) (কাজী সাত্তার), সলিমুল্লাহ, সরফুদ্দিন আহমেদ, আবদুল গফুর, গোলাম সারোয়ার টিপু (সহ–অধিনায়ক) (ওয়াজেদ গাজী)। অতিরিক্ত: আবুল কাসেম, সালেহ আহম্মদ, পিয়ার আলী, বদরুল হুদা বাটু, বেলাল মিয়া, আবদুল আলিম, মোহাম্মদ মালা। কোচ: শেখ সাহেব আলী। ম্যানেজার: শহিদ উদ্দিন ইসকান্দার।
বাংলাদেশ একাদশ: অনিরুদ্ধ (সহ-অধিনায়ক), আইনুল হক, জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), শেখ আশরাফ আলী, আবদুল হাকিম, আলী ইমাম, ফজলে সাদাইন খোকন (মোহাম্মদ কায়কোবাদ), শাহজাহান, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান খান, তসলিম উদ্দিন (নওশেরুজ্জামান)। অতিরিক্ত: আবদুল মোমেন, আবদুস সাত্তার, নিহার রঞ্জন গুহ, সিরাজুদ্দিন সিরু, গোবিন্দ কুণ্ডু, সাইদুর রহমান প্যাটেল, বিমল চন্দ্র, মাহমুদ, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, সুভাষ। কোচ: ননী বসাক। ম্যানেজার: লুৎফর রহমান।