প্রথম দেখা

তিরাশিতে প্রথম সুযোগ এল বিশ্বকাপ নিজের চোখে দেখার। ফাইল ছবি
তিরাশিতে প্রথম সুযোগ এল বিশ্বকাপ নিজের চোখে দেখার। ফাইল ছবি
>প্রথম বিশ্বকাপ দেখার স্মৃতি কি ভোলা যায়! সেই অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছেন জালাল আহমেদ চৌধুরী

আমার প্রথম বিশ্বকাপ দেখা নিয়ে স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে দেখি সেখানে ক্রিকেটের চেয়ে আনুষঙ্গিক ভিন্ন প্রসঙ্গ হাত নাড়ায় বেশি। বিশ্বকাপের প্রথম দুই পর্বে ক্রিকেটের এই রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা অনুসরণ করার প্রবল চাহিদা বা তাড়না তৈরি হয়নি আমাদের। আমাদের ক্রিকেট তখন সবে স্বপ্নের কুঁড়ি মেলা শুরু করেছে। তৃতীয় পালায় এসে, অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে আমাদের আগ্রহের মাত্রা একটু লকলকিয়ে মুখ ভাসাচ্ছে। খেলা যথারীতি ইংল্যান্ডে। এদিকে সরাসরি সম্প্রচারিত খেলা দেখার সুবিধাও অনেকটা তৈরি হয়েছে। তখন ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আমার বয়স নগণ্য। কাজ করি অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস-এ। তিরাশির মে মাসের মধ্যভাগে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে খেলা দেখার সুযোগটা এল। সেই সূত্রে এক বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার স্মৃতিভার বহন করছি বহুকাল। সেই অভিজ্ঞতার শরীরে ক্রিকেটের অংশ সামান্যই। দুনিয়া না–চেনা এক অপটু সাংবাদিকের অতৃপ্তির দহনই সেখানে বেশি। ক্রিকেটে চরম আগ্রহী পাঠকের এ বয়ান বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে, তবু সরলরেখায় এসে যাচ্ছে বলে বলে ফেলছি।

তখনকার বাংলাদেশ ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থার কাছে এক বিদেশি এয়ারলাইনসের বদান্যতায় ঢাকা-লন্ডনের একটি টিকিট এল। সেই সৌজন্য টিকিটটাই ভরসা। অন্য খরচ নিজের। সংস্থার প্রবীণ বন্ধুরা বললেন তোমার ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি বেশি। আবার ব্যয় সংকুলানের জন্য তোমার সিলেটি সংযোগ কাজে দেবে, তুমিই যাও। মন লাফাল, আবার কলিজা শুকিয়ে গেল। তখনকার এক নবীন সাংবাদিকের পকেটের কথা না বলাই ভালো। খবর শুনে অফিস জানাল, যাবে যাও, ছুটি পেতে পারো, কিন্তু রাহা খরচ চেয়ো না বাপু। বিলেতে কিছু আত্মীয়স্বজন আছেন। সেই সাহসে বুক বাঁধলাম। এদিকে খেলার মাসখানেকও বাকি নেই। ভিসা জোগাড়, সরকারি ভ্রমণ ছাড়পত্র জোগাড় করতে প্রাণান্ত হতে হবে। তা ছাড়া একেবারে শূন্য পকেটেও যাওয়াটা উচিত কর্ম হবে না। তবু সুযোগটা হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না। লেগে গেলাম প্রস্তুতিতে। প্রেস অ্যাক্রিডিটেশনের প্রক্রিয়ার সময় বা সুযোগ নেই। খেলা দেখতে হবে টিকিট কিনে, যদি পাওয়া যায়। তবু বাঙালির উৎসাহ মিইয়ে যাওয়ার নয়। গেলাম ভিসা করতে। কর্তৃপক্ষ জানাল ভিসা পেতে মাসখানেক লাগবে, তত দিনে খেলার কর্মকাবার। অবশ্য বুদ্ধি দিলেন যে কাগজপত্র ঠিক থাকলে সুযোগ নিতে পারো। সরাসরি চলে যাও, অন অ্যারাইভাল ভিসা পেয়েও যেতে পারো।

ঢাকা থেকে বোম্বে হয়ে লন্ডন যেতে হবে। বোম্বে তখনো মুম্বাই হয়নি। গেলাম, ট্রানজিট দিল। কিন্তু গোল বাধল কানেকটিং ফ্লাইটের জন্য বোডিং পাস নিতে গিয়ে। ওরা বলল, তোমার টিকিট ফ্রি অফ কস্ট, মানে মাগনা। নিয়মিত যাত্রী না থাকলে কেবল তোমাকে জায়গা দেওয়া যাবে। তোমাকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। মেয়াদ অনিশ্চিত। সাত দিনও লাগতে পারে।

অপমানে সাংবাদিকের মেরুদণ্ড শিরশির। এয়ারলাইনস জেনেশুনে এই অসম্মানজনক টিকিট দিয়েছে। ওখান থেকে ঢাকার ফিরতি টিকিট কেটে ফিরব, সে পয়সাও নেই। রাগে–ক্ষোভে সস্তা হোটেলে এক রাত কাটিয়ে জনতা এক্সপ্রেসে রেলপথে কলকাতা এসে বিমানে ঢাকায় ফিরলাম। জনতা এক্সপ্রেসে দুই দিন এক রাতে গন্তব্যে পৌঁছালাম। সে মন্থরগতি অজগরের রিজার্ভেশনহীন কামরায় এ ভ্রমণ যে কী দুঃসহ, বলে বোঝানো যাবে না। সে যা–ই হোক বোম্বে হাজি হয়ে ফিরলাম। ফিরে সদলবলে হামলা করলাম পৃষ্ঠপোষক উড়োজাহাজ দপ্তরে। শুনে–বুঝে তাঁরা বললেন ভুলটা তাঁরাই করেছেন। দুঃখ প্রকাশ করে নতুন টিকিট দিয়ে সঙ্গে দিলেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু বিলেতি মুদ্রা। অভিমান, অনুযোগ ভুলে আবার যাত্রা করতে হলো। টাকাটা খুব কাজে দিয়েছিল। এবার দুশ্চিন্তা ভিসা পাব কি না। কিন্তু না, সহজেই এক মাসের ভিসা পাওয়া গেল। ওরা শুধু আমার পত্রিকার পরিচয়পত্র দেখে ছেড়ে দিল। লন্ডনে উঠলাম এক জ্ঞাতি বোনের বাসায়। আর সিলেটের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে এমন কোনো আগন্তুকের বিলেতে আর কোনো অসুবিধা হওয়ার সুযোগ নেই। সে কথা তো সবাই জানেন। তা এই বিশ্বকাপ দর্শনজনিত বিড়ম্বনা নিয়ে তেমন করে কখনো লিখিনি। আজ সুযোগ পেয়ে কিছুটা বললাম। এখনকার মতো মুহূর্তে রিপোর্ট পাঠানোর সুযোগ সেদিন ছিল না। অতি সংক্ষেপে কাজ সেরেছি। যা বিস্তারিত লিখেছি, সেটা ফিরে এসে। আর লিখবই–বা কী? দেখিছি তো মাত্র দুটো ম্যাচ, তা–ও কালোবাজার থেকে টিকিট সংগ্রহের সুবাদে।

আমি যখন বিলেতে পৌঁছাই, তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট সেমিফাইনাল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ২২ জুন দুটি সেমিফাইনাল। ওভালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে ভারত-ইংল্যান্ড। ওভালেই গেলাম। মাঠের আকর্ষণ তো ছিলই। তার ওপর এটাই বেশি প্রতিযোগিতা–কাতর হওয়ার কথা। দরদাম করে টিকিট নিতে হলো। একপেশে খেলায় হেসেখেলে জিতল শিরোপাধারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে এর মাঝেও উপভোগ্য ক্রিকেট ছিল। শিরোপাধারীদের পেস চতুষ্টয়—গার্নার, রবার্টস, মার্শাল ও হোল্ডিং। গতিময়, মসৃণ, ভয়ংকর সুন্দর। আর তাদের বিপক্ষে পাকিস্তানিদের অসহায় আত্মসমর্পণ। মহসিন খানের এক চারের ম্যারাথন ইনিংসে ৭০ রান রিচার্ডসদের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ দাঁড় করাতে পারেনি। রিচার্ডসের রাজসিক ব্যাট অনায়াসে তাদের তুলে নিয়েছে ফাইনালে। পরাভূতদের জঘন্য ফিল্ডিংও ছিল পীড়াদায়ক। তবে আমার কাছে বেশি উপভোগ্য লেগেছিল আমার পাশে বসা ক্যারিবীয়দের ক্রিকেটীয় আচরণ। সকাল সকাল একজন বললেন কী দেখবে আজ। ইমরান বল করবে না, জাভেদ নেই, লয়েডের তো আজ ছুটির দিন। সত্যি সত্যি অনায়াস জয়ে দিনটিকে ছুটির দিনই বানিয়ে নিয়েছিল তাদের দল। ওদিকে শেষ বিকেলে বড় পর্দায় খবর আসছে অন্য সেমিতে বব উইলিসের বুক ভেঙে দিচ্ছে কপিল দেবের ভারত। তুমুল আওয়াজ উঠল ওভালে। পাশের রঙিন জামা পরা নিকশ কালো লোকটা বলে উঠলেন, ‘বুঝলে হে, এবার শুধু ফাইনালে কালোরা।’ এশিয়ানদের ওরা স্বগোত্রীয়ই মনে করে বলেই ভদ্রলোক একটি বিয়ারের ক্যান খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

তিন রাত্রি পরে লর্ডসে চূড়ান্ত খেলা। আগের দুই ক্রিকেট বিশ্বকাপে কেবল ইস্ট আফ্রিকার সঙ্গে জেতা ভারত খেলবে টানা তৃতীয়বার শিরোপাপ্রত্যাশী ক্লাইভ লয়েডের দলের বিপক্ষে। ভারতীয়দের মধ্যে খেলা দেখার জন্য বুনো উন্মাদনা। সেন্ট জনস উডসে কালোবাজারির মহোৎসব।

আর খেলা, সে তো ক্রিকেট ইতিহাসে রোমান্টিক রোমাঞ্চের চরম উদাহরণ হয়ে রয়েছে। সে বহুল পরিচিত গল্প করা অবান্তর। কপিল দেবের দল ক্রিকেটকে যান্ত্রিক আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত হওয়া থেকে টেনে এনে আবার গৌরবময় অনিশ্চয়তার শৈল্পিক বৃত্তে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল।

অবশ্য এ খেলার কিছু কিছু দৃশ্য ক্রিকেট দর্শকমাত্রেরই মনে গেঁথে থাকবে। আমারও রয়েছে। না আমি সান্ধুর বলে গ্রিনিজের বোল্ড হওয়ার কথা বলছি না, না বলছি রিচার্ডস পতনের বহুল আলোচিত দৃশ্যের কথা। বলছি প্রতিপক্ষের সামান্য সংগ্রহের জবাবে লয়েডের আউট হওয়ার পরের দৃশ্যটা। ১৮৩ রানের জবাবে তাঁর দল তখন ৬৬ রানে ৫ উইকেট। রিচার্ডস–গ্রিনিজরা আগেই গেছেন। লয়েডের অভিজ্ঞ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাঁকে জানান দিচ্ছে অসম যুদ্ধে উজ্জীবিত ব্র্যাঘ্রের পশ্চাদ্ধাবন। পূর্বঘোষিত অবসরে যাওয়ার খেলায় তিনি ফিরে যাচ্ছেন আশুপতনের আর্তনাদ শুনতে শুনতে। ইচ্ছে ছিল বিশ্বকাপ জয়ের ত্রিমুকুট ধারণ করার। তিনি ফিরে যাচ্ছেন ছন্দহীন। যেন তিনি এক স্থবির আগন্তুক এখানে। বাষ্পে ঢেকে যাচ্ছে তাঁর চশমার কাচ। হারিয়ে যাওয়া উটের মতো সামনে ঝুঁকে তিনি হাঁটছেন লর্ডসের সাজঘরের কোনো এক আলো–আঁধারির আশ্রয়ে হারিয়ে যেতে। সে দৃশ্য ভোলার নয়।