“যাওয়ার আগে একটা দুইটা নিয়ে যাই!”
স্টাম্প মাইকে শুনতে পাওয়া ওপরের কথাটি লিটন দাসের, বলছিলেন মোস্তাফিজুর রহমানকে।
ঠিক পরের বলেই এনক্রুমা বোনারের বিপক্ষে এলবিডব্লুর আবেদন হলো, তবে সাড়া দিলেন না আম্পায়ার। উইকেটকিপার নুরুল হাসান নিশ্চিত করলেন, উচ্চতা বেশি ছিল বলটার। ‘যাওয়ার আগে’ আর কিছু নিয়ে যেতে পারেনি বাংলাদেশ, ‘উইকেটের দাম’ কতো, প্রথম দিন বরং বোলিংয়ে সেটি বেশ ভালোই টের পেয়েছে তারা। দারুণ আঁটসাঁট বোলিং করে, এখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকা ঘাস ও অসমান বাউন্সের উইকেট থেকে পাওয়া সুবিধা কাজে লাগিয়ে, ৪৮ ওভারে মাত্র ৯৫ রান দিয়েও অ্যান্টিগা টেস্টের প্রথম দিন বাংলাদেশ নিতে পেরেছে ২টি উইকেট। অথচ এর আগে মাত্র ৩২.৫ ওভারে ১০৩ রান করেই গুটিয়ে গেছে তারা। প্রথম দিনশেষে মাত্র ৮ রানে পিছিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অধিনায়ক ক্রেগ ব্রাফেট অপরাজিত ৪২ রানে। তাঁর সঙ্গী বোনার।
প্রথম ইনিংসে সম্বল বেশ কম হলেও বাংলাদেশ বোলাররা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন শুরু থেকেই। দ্বিতীয় সেশনে ১৫ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তোলে মাত্র ১৫ রান, ষষ্ঠ ওভারে গিয়ে প্রথম রানের দেখা পায় তারা, ১৪তম ওভারে ব্যাট থেকে আসে প্রথম বাউন্ডারি। তবে অবিচ্ছিন্ন থেকেই চা-বিরতিতে যান দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ব্রাফেট ও জন ক্যাম্পবেল। যদিও চিত্রটা ভিন্ন হতে পারত সহজেই, শূন্য রানেই মুমিনুলের হাতে ব্রাফেট জীবন পাওয়াতে হয়নি সেটি। মোস্তাফিজুর রহমানের বলে ফ্লিক করে লেগ স্লিপের ফিল্ডারের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন ব্রাফেট।
বাংলাদেশ অবশ্য আঁটসাঁট বোলিং করেছে এরপরও। পিচের সুবিধা আদায় করলেও উইকেটের দেখাই শুধু পায়নি তারা। হয়তো ক্যাচ উঠেছে, তবে সেটি পড়েছে ফিল্ডারদের সামনেই। অবশেষে ২৬তম ওভারে দেখা মেলে প্রথম ব্রেকথ্রুর। মোস্তাফিজের ভেতরের দিকে ঢোকা বলে আগবাড়িয়ে ডিফেন্ড করেছিলেন ২৪ রান করা ক্যাম্পবেল, তবে ইনসাইড-এজের পর গড়িয়ে গিয়ে সেটি ভাঙে স্টাম্প। এর আগে মিরাজকে ছয়-চার মেরে একটু খোলস ছেড়ে বের হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ক্যাম্পবেল।
সুযোগ তৈরি হয়েছে এরপরও। ২৮তম ওভারে মোস্তাফিজের পরপর দুই বলে ক্যাচ তোলেন রেমন রিফার ও ব্রাফেট। দুবারই দারুণ চেষ্টা করেও ফল পাননি লিটন—প্রথম দফা দ্বিতীয় স্লিপ থেকে ডান দিকে ডাইভ দিয়েছিলেন, পরের বার স্কয়ার লেগে বাঁদিকে। পরে ব্রাফেটের বিপক্ষে নেওয়া একটা কট-বিহাইন্ডের রিভিউও ব্যর্থ হয় সাকিবের বলে।
অবশ্য কিছুক্ষণ পরই আসে দ্বিতীয় উইকেট। রিফারকে দারুণ সেট-আপে আউট করেন ইবাদত। ব্যাক অব আ লেংথ থেকে একটু মুভমেন্ট আদায় করেন, তাতেই স্কয়ারড-আপ হয়ে খোঁচা দেন প্রায় সাড়ে চার বছর টেস্ট খেলতে নামা রিফার। এরপর অবশ্য আর উইকেট হারায়নি উইন্ডিজ। ৪৪তম ওভারে মোস্তাফিজের বলে বোনারের বিপক্ষে একটা রিভিউ নিয়েছিলেন তখন ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা লিটন, তবে মিলিমিটার ব্যবধানে আম্পায়ারস কলও হয়নি সেটি।
নিশ্চিতভাবেই সেটি হতাশার, তবে বাংলাদেশের ব্যাটিং-হতাশার কাছে সেটি যেন কিছুই নয়! দেড় সেশন ও ৩২.৫ ওভার ব্যাটিং করেই প্রথম ইনিংসে থামে বাংলাদেশ। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ৫১ রান করলেও ইনিংসে দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেন আর মাত্র দুজন—তামিম ইকবাল (২৯) ও লিটন দাস (১২)। বাংলাদেশ ইনিংসে ছয় জন ব্যাটসম্যান আউট হয়েছেন শূন্য রানে। এর আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে হয়েছিল এমন। ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে তাই পর পর দুই টেস্টে কমপক্ষে ছয় জন ব্যাটসম্যানের কোনো রান না করেই ফিরে যাওয়ার কীর্তি গড়ল বাংলাদেশ।
মূলত তিন দফার ধসেই শেষ হয় বাংলাদেশ। প্রথম দফা ১৬ রানের মধ্যে বাংলাদেশ হারায় মাহমুদুল হাসান, নাজমুল হোসেন ও মুমিনুল হককে। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই রোচের অফ স্টাম্পের বাইরের লেংথ বলে খোঁচা মেরে স্লিপে ক্যাচ দেন মাহমুদুল। পরের ওভারে এসে নাজমুলকে ফেরান রোচ, ফুললেংথের বলটা ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে ঢুকে ভাঙে স্টাম্প। এরপর জেইডেন সিলসের বলে শরীর থেকে দূরে শক্ত হাতে ডিফেন্ড করতে গিয়ে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ দেন মুমিনুল, এ নিয়ে টানা ৯ ইনিংস দুই অঙ্কের আগেই ফিরলেন তিনি, সর্বশেষ তিন ইনিংসের দুটিতেই আউট হলেন কোনো রান না করেই। বাংলাদেশের দুই থেকে চার নম্বর ব্যাটসম্যানের কেউই রান করতে পারেননি—নিজেদের ইতিহাসে এমন ঘটনাও ঘটল এই প্রথম বার।
পরের ধসটি নামে প্রথম ঘণ্টার পানি-পানের বিরতির পর, যার আগে তামিম ও লিটন একটু ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ওই সময়ে মুশফিকুর রহিমের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ৫ হাজার রানও পূর্ণ করেন তামিম। তবে বিরতির পরপরই ৪ রানের ব্যবধানে পড়ে ৩ উইকেট—আলজারি জোসেফের লেগ স্টাম্পের বাইরের নিরীহ বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ দেন তামিম, প্রথম ওভারে বোলিং করতে আসা কাইল মায়ার্সের বলে ফেরেন লিটন ও নুরুল। লিটন কট-বিহাইন্ড হন অফ স্টাম্পের বাইরে লাইন ধরে রাখা বলে, বেশ বাইরে থেকে ভেতরের দিকে ঢুকতে থাকা বলে শট না খেলে এলবিডব্লু নুরুল হাসান।
শেষ ধসে ৪ উইকেট পড়ে ২৬ রানের। তার আগে সাকিব প্রতি-আক্রমণের চেষ্টা করেছেন, মধ্যাহ্নবিরতিতে মিরাজের সঙ্গে তাঁর জুটি অবিচ্ছিন্নই থাকে। তবে দ্বিতীয় সেশনের প্রথম ওভারে জেইডেন সিলসের লেগ স্টাম্পের বেশ বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে জশুয়া ডা সিলভার হাতে ধরা পড়েন মিরাজ, ২২ বলে ২ রান করে। সাকিব এরপর ভুগতে থাকেন সঙ্গীর অভাবে। মিরাজের পর ফেরেন মোস্তাফিজও। এর মধ্যে ক্যারিয়ারের ২৮তম অর্ধশতক পূর্ণ করেন সাকিব, সিলসের বলে চার মেরে, ৬৩ বলে। তবে পরের ওভারে আলজারি জোসেফকে তুলে মারতে গিয়ে লং-অন বাউন্ডারিতে ধরা পড়েন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ওই ওভারেই খালেদ আহমেদকে ফিরিয়ে ইনিংস শেষ করেন জোসেফ।