বাংলাদেশের আরো একটি হার, আরো একটি হতাশার দিন। তবে এর উল্টোটি ঘটলে অন্যায় হতো ডমিনিকাবাসীর প্রতি। পাঁচ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরে পাওয়া উপলক্ষ্যে তাদের যত আনন্দ–আয়োজন, সবকিছুতেই যে পানি ঢেলে দিত উইন্ডসর পার্কে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হার!
প্রথমে রোভম্যান পাওয়েলের ব্যাটিং ঝড় এবং পরে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার আরেকটি প্রদর্শনী সেটি হতে দেয়নি। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ব্যতিক্রম অবশ্য সাকিব আল হাসানের ৫২ বলে অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংসটি। তাতে পাওয়েলকে একটা জবাব দেওয়া গেলেও বাকিদের ব্যর্থতায় এড়ানো যায়নি হার। বাংলাদেশকে ১৫৮ রানে আটকে রেখে ৩৫ রানে জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিন ম্যাচের টি–টোয়েন্টি সিরিজে তারা এগিয়ে গেল ১–০তে। এর আগে বৃষ্টি শেষ হতে দেয়নি সিরিজের প্রথম টি–টোয়েন্টিটি। ৭ জুলাই গায়ানায় হবে তৃতীয় ও শেষ টি–টোয়েন্টি ম্যাচ।
১৯৩ রানের বিশাল লক্ষ্যের সামনে শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের ইনিংস। দ্বিতীয় ওভারেই বাঁহাতি পেসার ওবেদ ম্যাকয় পরপর দুই বলে ফেরান দুই ওপেনার লিটন দাস আর এনামুল হককে। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে লিটন সহজ ক্যাচ দিয়েছেন শামারা ব্রুকসের হাতে, এনামুল বোল্ড হয়েছেন অফ স্টাম্পের বাইরের বল উইকেটে টেনে এনে।
দলকে ৮ রানে রেখেই পর পর দুই বলে তাঁদের বিদায় চাপে ফেলে দেয় বাংলাদেশকে, যে চাপ থেকে তো পরে আর ওঠা যায়ইনি, বরং হোঁচট খেতে খেতেই এগিয়েছে ইনিংস। ব্যতিক্রম বলতে পারেন সাকিব আল হাসান আর আফিফ হোসেনের লড়াইটাকে।
দলের ২৩ রানে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহও ফিরে যাওয়ার পর চতুর্থ উইকেটে ৫৫ রানের জুটি হয়েছে তাদের। সেটি যে গতিতে হয়েছে তা হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৯৩ রান তাড়া করার মতো ছিল না, তবে বাংলাদেশের ইনিংসটাকে কিছুটা সময় স্বস্তি অন্তত দিয়েছে। পরে মোসাদ্দেকের সঙ্গে সাকিবের আরেকটি জুটি হয়েছে ৫৩ রানের।
২৭ বলে ৩৪ রান করে আফিফ আউট হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত উইকেটে থেকে পাওয়েলকে একটা জবাব অন্তত দিতে চেয়েছেন সাকিব। তিন ছক্কা আর পাঁচ বাউন্ডারিতে সাজানো ইনিংসে সতীর্থ ব্যাটসম্যানদেরও দেখিয়েছেন, তাদের একটু সহযোগিতা পেলে উইন্ডসর পার্কে ফলাফলটা অন্যরকমও হতে পারত।
গত কয়েকটি সিরিজে ব্যাটিংটাই বাংলাদেশের হতাশার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু উইন্ডসর পার্কে সিরিজের দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ বোলিংটাই বা করল কি! চার ওভারের মধ্যে ২৬ রানে দুই উইকেট তুলে নেওয়ার পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজের রানটা গিয়ে যখন ঠেকে ১৯৩— বোলিংয়ের ধারাবর্ণনা এরপর আর না দিলেও চলে। তবু শেষটা একটু জেনে নিন। ইনিংসের শেষ বলে বাঁহাতি পেসার শরীফুল ইসলাম দিলেন লোভনীয় এক ফুলটস। ডিপ মিডউইকেট দিয়ে সেটিকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে নিজের ষষ্ঠ ছক্কাটি উদ্যাপন করেছেন পাওয়েল।
পাওয়েল আর ওপেনার ব্রেন্ডন কিং মিলে এর আগে যে রকম তান্ডব বইয়ে দিয়েছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের এরকম একটি সমাপ্তি আসলে প্রাপ্যই ছিল। ১২.৩ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঠিক ১০০ রানে অধিনায়ক নিকোলাস পুরান এলবিডব্লু হয়ে যান মোসাদ্দেক হোসেনের বলে। কিন্তু ৩০ বলে ৩৪ রান করা পুরানকে ফিরিয়ে হীতে যেন বিপরীত হলো! পরের ৭.ও ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছে ৯৩ রান, যার ৬৩–ই এসেছে কিংয়ের সঙ্গে পাওয়েলের চতুর্থ উইকেট জুটিতে।
মাত্র ৪ ওভার ৪ বলের এই জুটিতে বাংলাদেশের বোলারদের ওপর ক্যারিবীয় দুই ব্যাটসম্যান কত নির্দয়ভাবে চড়াও হয়েছিলেন তার একটি নমুনা সাকিবের করা ইনিংসের ১৬তম ওভার। ওই এক ওভারেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোরবোর্ডে যোগ হয়েছে ২৩ রান এবং ২৩–ই এসেছে পাওয়েলের ব্যাট থেকে। প্রথম বলে মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা, দ্বিতীয় বলে লং অন দিয়ে বাউন্ডারি। পরের দুই বলে আবার দুই ছক্কা। একটি হাঁটু গেড়ে ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে। পরেরটি তো এক কথায় চোখে লেগে থাকার মতো। অফ স্টাম্পের বাইরের বলটিকে পাওয়েল পেছনের পায়ে ভর করে মাঠের বাইরে পাঠালেন লং অফ দিয়ে।
আরও নমুনা চান? তাসকিন আহমেদের পরের ওভারটিতেই আছে তা। প্রথম দুই বলেই ডিপ মিডউইকেট আর ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে দুই ছক্কা পাওয়েলের। ব্যাট হাতে রীতিমতো দানব হয়ে ওঠা পাওয়েল ২১ রান আসা তাসকিসের ওই ওভারটা শেষ করেছেন লং অন দিয়ে চার মেরে।
ডেথ ওভারে ভালো শুরু করা শরীফুল ১৮তম ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র ৩ রান। কিন্তু শেষ ওভার করতে এসে তিনিও হারিয়ে ফেললেন খেই। প্রথম বলে রোমারিও শেফার্ডকে মেহেদীর ক্যাচ বানালেও তৃতীয় বলেই ছক্কা খেয়েছেন স্মিথের হাতে। আর শেষ বলে তো পাওয়েলের ওই গ্যালারিতে পাঠানো ছক্কা। ছয় ছক্কা আর দুই বাউন্ডারিতে মাত্র ২৮ বলে অপরাজিত ৬১ রান পাওয়েলের।
পাওয়েল হয়তো তাণ্ডবটা একটু বেশি চালিয়েছেন, তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামার পর থেকেই বাংলাদেশের বোলারদের শর্ষে ফুল দেখিয়েছেন ব্রেন্ডন কিং। তাসকিনের করা ইনিংসের প্রথম ওভারেই চার, ছক্কার উদ্বোধন করে দেন ওপেনার কাইল মায়ার্স। দলের ১৮ রানে সেই মায়ার্স ও ২৬ রানে ব্রুকসকে ফেরানো গেলেও কিংসের তান্ডব চলছিল। তৃতীয় ওভারে মোস্তাফিজুর রহমানকে পর পর দুই বাউন্ডারি মারার পর পঞ্চম ওভারে শরীফুলকেও পর পর দুই চার। তৃতীয় উইকেটে অধিনায়ক পুরানের সঙ্গে মাত্র ৯.১ ওভারেই তাঁর ৭৪ রানের জুটিতে বড় রানের দিকে এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা।
সাকিবের ক্যাচে ৪৩ বলে ৫৭ রান করা কিংকে শেষ পর্যন্ত ফিরিয়েছেন শরীফুল। কিন্তু ততক্ষণে যে রানের ক্ষুধা পেয়ে বসেছে আরেকজনকে, রোভম্যান পাওয়েল। বাংলাদেশের ইনিংসে সে ক্ষুধাটা ছিল শুধু সাকিবের মধ্যেই।