দেরিতে ঘুম ভাঙার পর মুশফিকের চেনানো আয়নায় যা দেখা গেল
চট্টগ্রাম টেস্টে সেঞ্চুরির পর তাঁর কথাবার্তা শুনেই প্রথম এমন মনে হলো, তা নয়। বছর দুয়েক ধরে মুশফিকুর রহিমের কথা শুনলেই বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্পটা মনে পড়ে।
বাড়িতে এক গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মী বউয়ের দশা বোঝাতে নিমগাছ ছিল গল্পের রূপক। প্রয়োজনে কেউ গাছের ছালটা ছাড়িয়ে সেদ্ধ করছে, পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে। খোসপাঁচড়ায় লাগাচ্ছে। মুখে মুখে বলাও হচ্ছে, ‘নিমের হাওয়া ভালো, কেটো না।’ কিন্তু কেউ একটু যত্নআত্তির লেশ পর্যন্ত মাড়ায় না। একদিন এক কবি এসে বলল, ‘বাঃ কী সুন্দর পাতাগুলো...কী রূপ! থোকা থোকা ফুলেরই বা কী বাহার...।’
কবি এই কথা বলে চলে যাওয়ার পর নিমগাছটির ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর সঙ্গে চলে যেতে। কিন্তু শিকড় তো মাটি চিরে গেঁথেছে অনেক গভীরে। চাইলেই কী যাওয়া সম্ভব!
নিমের রস তেতো। তবে ব্যবহারের ফল মিষ্টি। মুশফিকের কথাও হয়তো মাঝেমধ্যে নিমপাতার মতো তেতো, কিন্তু শতকগুলোর স্বাদ তো মিষ্টি। তবু সেই নিমগাছের মতোই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁর ছাল ছাড়ানো হয়, নিন্দা-গিবতের শিলে বেদম পেষা হয়। সত্যিই, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা যেন বনফুলের গল্পে সেই নিমগাছের আশপাশের লোকজনের মতো। শুধুই যথেচ্ছ ব্যবহার, একটু প্রশংসার বেলায় ঠনঠন।
দুর্ভাগ্য, এ দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে কবিসুলভ কেউ নেই, যিনি কবিদের লেখনীশক্তির মতো বাস্তবতা উল্টে চোখে পরাবাস্তবের পর্দা বেঁধে বলবেন, ‘তুমি মা (বাবা) কল্পতরু, আমরা তোমার পোষা গরু।’ আচ্ছা, থাকলেও কি কিছু লাভ হতো! ব্যাট-বল শিকেয় তুলে দেশপ্রেমের শিকড় ছিঁড়ে মুশফিক কি তাঁর সঙ্গে যেতে পারতেন? বনফুলের গল্পে নিমগাছের মতো মুশফিকের ক্রিকেট-জীবনও তাই অনেকটাই শাঁখের করাতের ওপর—এত ত্যাগ, এত পরিশ্রমে অর্জিত সাফল্যেও যেমন কথা শুনতে হয়, তেমনি বাজে খেললে তো কথাই নেই!
তবে এর মধ্যেই নিমফুল যেমন সুবাস ছড়ায়, তেমনি মুশফিকও শতক পেলে সমর্থকেরা তার যথেচ্ছ ব্যবহার, মানে প্রশংসায় ভাসিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইক কামাই করতে কার্পণ্য করেন না। নিমগাছটির যেমন সেই কবি ছাড়া আপন বলতে কেউ ছিল না, তেমনি সমর্থকদের মধ্যে মুশফিকের জন্য তেমন কেউ না থাকলেও আপন বলতে একেবারেই যে কেউ নেই, তা বলা হয় না।
এই তো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে মুশফিকের শতকের পর তাঁর হয়ে কথা বলেছেন তাঁর-ই এক আপনজন। মতান্তরে কেউ কেউ ‘কবি’ও ভেবে নিতে পারেন—‘আমরা হাসিমুখেই বিদায় নেব ইনশা আল্লাহ! তবে আপনাদের রিপ্লেসমেন্ট (বদলি) আছে তো??? সেদিকেও একটু নজর দিলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়ন হতো!’
খুব সত্য কথা। সত্যিই, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কিছু ক্রিকেটারের হয়ে এমন কিছু ‘কবি’দের উত্থান যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। অন্তত কেউ কেউ তো নিজ নিজ ‘নিমগাছ’-এর কবি হয়ে উঠতে পেরেছেন। সমর্থকেরা তা–ও পারেননি। আলসেমিতে সকালে তাঁদের ঘুম ভাঙে দেরিতে। পরচর্চায় এতটাই ব্যস্ত যে আয়নায় নিজেকে একটু দেখে যাচাইয়ের সময়ও তাঁদের নেই!
মুশফিক তাই কর্তব্যটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের জন্য এবং শুধুই নিজের জন্য শশব্যস্ত থাকার এই যুগে এমন ক্রিকেটার সত্যিই বিরল, যিনি অপরের কর্তব্যও মনে করিয়ে দেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মুশফিকের সেই কথাটা মনে আছে তো, ‘যাঁরাই এমন কথা বলেন, তাঁদের নিজেদের মুখটা একটু আয়নায় দেখা উচিত। কারণ, তাঁরা বাংলাদেশের হয়ে খেলে না, আমরাই খেলি।’
আর চট্টগ্রাম টেস্টে শতক করার পর বলেছেন, ‘বাংলাদেশেই দেখেছি, একটা দিন সেঞ্চুরি করলে ব্র্যাডম্যানের চেয়েও বড় খেলোয়াড় হয়ে যায়। আবার ২-৩ ম্যাচে রান না করলে গর্ত করে গর্তের মধ্যে ঢুকে যেতে হয়। আমার মনে হয় এটা শুধু বাংলাদেশেই হয়।’
তামিম ইকবাল উঠে না গেলে বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে প্রথম ৫০০০ হয়তো তাঁরই হতো, এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে এক সাংবাদিক যখন জানতে চেয়েছেন নিজেকে তিনি লাকি মনে করেন কি না, মুশফিক স্মরণীয় এক উত্তর দিয়েছেন, ‘এই যে কপালটা দেখছেন (ক্যাপ উঁচিয়ে), ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নে’মাল ওয়াকিল, নেমাল মাওলা ওয়া নেমান নাছির’, আমি যখন উঠে অনুশীলন করি, তখন আপনাদের অনেকেই ঘুমিয়ে থাকেন। তো আল্লাহর রহমতে কিছুটা হলেও তো আল্লাহ দেখেন…।’
অবশ্যই। একদম যথার্থ বলেছেন মুশফিক। খানিকটা ব্যাখ্যা করা যায়। মুশফিক যা উদ্ধৃত করেছেন, সেটি দুনিয়ার যাবতীয় ক্ষতি ও বিনাশ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি দোয়া, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়—‘আল্লাহু তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনিই উত্তম কর্ম বিধায়ক; আল্লাহু তাআলাই উত্তম অভিভাবক এবং উত্তম সাহায্যকারী।’
মুশফিক এই দোয়াটি বলেছেন নিজের কপাল দেখিয়ে। আর বাংলা অর্থ, তাঁর পাশে দাঁড়াতে সৃষ্টিকর্তাই যথেষ্ট। এই বিশ্বসংসারে সৃষ্টিকর্তার রহমতপ্রার্থী কে নয়! একজন ক্রিকেটার যখন সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে আলাদা করে আয়াতটি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সংবাদমাধ্যম বা সমর্থক তাঁর পাশে না থাকলেও চলবে! এ দুটি ঘরানার লোকজনই তো মুশফিক শতক পেলে তাঁকে ব্র্যাডম্যান বানান, আবার জেতা ম্যাচ হারালে কিংবা কিপিং গ্লাভস পরে রানআউটের সহজ সুযোগ কঠিন করে নষ্ট করলে গর্তে ঢুকিয়ে দেন। বেচারা!
মুশফিকের ভেতর যেহেতু সমর্থক-সংবাদকর্মীদের মতো এমন ‘দ্বৈত চরিত্র’ নেই—সব সময় নিজের বিশ্বাসেই অটল থাকেন, যেমন রিভার্স সুইপ—তাই ওই দুটি ঘরানার লোকজনকে ধারণ করারও তাঁর প্রয়োজন নেই। কারণ, মুশফিক পরিশ্রম করেন আর তাঁর দেখভালের জন্য সৃষ্টিকর্তা আছেন—আর কিছু তো লাগে না।
কিন্তু আল্লাহর ওপর এমন ভরসা তো বাকিরাও করেন। মুশফিক ঠিক কতটা সকালে উঠে অনুশীলনে যান, তা হয়তো সবার জানা নেই, তবে যেসব ‘অলস’ লোকজন তাঁর অনুশীলনে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে আগেভাগে বিছানা ছাড়েন না, তাঁরাও সম্ভবত দলের সাফল্য কামনায় ‘আল্লাহ ভরসা’ বলে ওঠেন মনের অজান্তেই।
মুশফিকের আরেকটি কথাও প্রশংসা পাবে—‘আমার মনে হয় এটা শুধু বাংলাদেশেই হয়।’ সে তো বটেই। পৃথিবীতে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাজার যে দেশে—ভারত—সেখানে কিন্তু খেলোয়াড়দের ব্যর্থতায় তাঁদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার নজিরও আছে। এই তো ২০১৮ সালেই ভারতীয় ক্রিকেট দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বিরাট কোহলি রান না পাওয়ায় নিজের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন এক সমর্থক। মুশফিক নিশ্চয় এমন সমর্থক চান না!
এ দেশের সমর্থক কেমন, সেটা বুঝতে ঢাকার রাস্তায় তাকালেই টের পাবেন। কাস্তে-কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে ফুটপাতে বসে আছেন অনেকে। রিকশায় প্যাডেল মারছে জীবন্ত কঙ্কাল। এরা ক্রিকেটটা অত ভালো বোঝেন না মুশফিকের মতো। ক্রিকেটের গড়, স্ট্রাইকরেট বা পাঁচ হাজারের মাইলফলকের কেক কাটার কারণটাও বুঝে আসে না তাঁদের।
তবে বাংলাদেশের ম্যাচ চললেই রাস্তায় টিভির দোকানের সামনে তিল ঠাঁই নাই ভিড়ে তাঁরাই সিংহভাগ। তাঁরা কখনো হাসছেন, করতালি দিচ্ছেন, আবার রাগে ফুঁসছেন... বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে মনে হলেই ভাষার ব্যবহারে ওই দুরাচারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে ছাড়েন না।
মুশফিকের জানা থাকা ভালো, এই দেশে এঁরাই সিংহভাগ। এক অর্থে এঁরাই বাংলাদেশ। দুটো ভাতের আশায় উদয়াস্ত খাটুনির মধ্যে ‘ক্লান্তিজনিত’ কারণে ক্রিকেটারদের মতো ছুটি নিয়ে তাঁদের বিশ্রামে থাকার সুযোগ নেই। তাঁদের বিশ্রাম বলতে সুযোগ পেলে ওই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখা ক্রিকেট দেখা।
এঁদের সঙ্গে আরেক দল সমর্থকও আছেন। যাঁরা ক্রিকেটটা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করেন। কখনো সফল হন, কখনো ব্যর্থ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে তাঁরা সমালোচনাতেও যোগ দেন। আর সাংবাদিকেরা তো আছেনই। এঁদের ওপরই যত ক্ষোভ মুশফিক পরিবারের। এ কারণেই ‘অবসর নিলে কী করবেন, তখন দেখব’–জাতীয় স্ট্যাটাসের দেখা মেলে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের ‘আলসে’ বলার মতো ব্যাপারও ঘটে। হয়তো ভুলে গেছেন, জাতীয় দল ভেঙে নিষিদ্ধঘোষিত আইসিএলে যখন কিছু খেলোয়াড় চলে গিয়েছিলেন, তখনো খেলোয়াড়দের পাশেই ছিলেন সমর্থকেরা। ‘রিপ্লেসমেন্ট’—তখনো মিলেছে এবং ভবিষ্যতেও মিলবে। এটাই স্বাভাবিক। দুনিয়াতে কারও জন্য তো কিছু থেমে থাকে না। হয়তো একটু ভালো কিংবা তুলনামূলক মন্দ—এই যা পার্থক্য।
আসলে, বনফুলই ভুল লিখেছেন। গাছের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই তো স্বার্থের। গাছ ছোট থাকতে ফল পেতে লোকে খানিকটা পরিচর্যা করবে—যেমন মাহমুদুল হাসান—তারপর বড় হয়ে উঠলে প্রয়োজনে যা যা সম্ভব নেবে এবং একসময় প্রয়োজনেই কেটে ফেলবে। ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারও তেমন নয় কি!
গাছের এই জীবনচক্রের মধ্যে এখন একটা বড়সড় ‘নিমগাছ’ যদি বাস্তবতা ভুলে ভেবে নেয়, পৃথিবীতে তার জন্য কেউ নেই, তাহলে সেই প্রশ্নটা উঠবেই—এই জগতে যদি মানুষ-ই না থাকে, তাহলে নিমগাছের ঔষধি গুণের কী মূল্য, ডালপালা হারিয়ে ত্যাগ স্বীকার করবে কার জন্য? একটা গাছের বেড়ে ওঠার সার্থকতা যেমন মানুষের জন্য, তেমনি খেলার সুবাদে বিনোদন দিতে নামা একজন ক্রিকেটারের খেলার সার্থকতাও সমর্থকদের জন্য। দেরিতে ঘুম ভাঙলেও আয়নাতে মুখ দেখতে দেখতে এই সত্যটা আবারও মনে পড়ে গেল!