দুই বিশ্বকাপের মাঝখানে

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম এক ছবি—অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শেষ আট নিশ্চিত করার পর। আর এই হারের পরই ইংল্যান্ডের বদলে যাওয়ার শুরু
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম এক ছবি—অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শেষ আট নিশ্চিত করার পর। আর এই হারের পরই ইংল্যান্ডের বদলে যাওয়ার শুরু
>২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে মাঝের চার বছরে কোথায় বদলেছে ওয়ানডে ক্রিকেট? উত্তর খুঁজেছেন নাইর ইকবাল

গত চার বছর ক্রিকেট অনেক বদলে গেছে! চার বছর বলতে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে। এ সময় ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন যেটি এসেছে, সেটি কিন্তু দুর্দান্ত। খেলাটিতে এখন তিন শ রান মোটেও নিরাপদ কিছু নয়। একটা সময় ছিল, যখন কোনো দল আগে ব্যাটিং করে সংগ্রহটা তিন শ বা তার ওপারে নিয়ে যেতে পারলেই জয়ের ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যেত। দু–একটা ব্যতিক্রম অবশ্যই ঘটত। কিন্তু সেগুলো তো ব্যতিক্রমই। ব্যতিক্রম তো নিয়মকেই প্রমাণ করে। সে কারণেই ১৯৯৮ সালে ঢাকার ইনডিপেনডেনস কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের ৩১৪ রান টপকে উৎসবে মেতেছিল ভারত। সৌরভ গাঙ্গুলীর ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি ঠাঁই পেয়েছিল ক্রিকেটের ইতিহাসে। কিন্তু এখন ৩১৪ রান তো কিছুই নয়, চার শর কাছাকাছি রান করেও কোনো দল স্বস্তিতে থাকতে পারছে না। কখনো কখনো চার শর বেশি করেও নয়।

বাংলাদেশের কাছে ১৫ রানে হেরে গত বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছিল ইংল্যান্ড। গত চার বছরে ওয়ানডে ক্রিকেটের যে বদল, তাতে মাশরাফিদের কিন্তু যথেষ্ট ভূমিকা আছে। সে হারটাই যে আমূল বদলে দিয়েছে ওয়ানডের ইংল্যান্ডকে। প্রথাগত ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে তারা বেছে নেয় আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের পথ। ইংল্যান্ডের সেই পরিবর্তনেই বড় বদলটা এসেছে ওয়ানডেতে। ইংল্যান্ডের খেলা মানেই এখন সাড়ে তিন শ। এটিকে এমনই অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছে যেকোনো লক্ষ্যকেই তাড়া করা অসম্ভব বলে ভাবে না তারা।

গত বিশ্বকাপের ফাইনাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪৯৬টি ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে, এগুলোর মধ্যে আগে ব্যাটিং করা দল ৩০০ রান তুলেছে ১৩৩ ম্যাচে। তাদের জয়ের হার ৭৭ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, এই ১৩৩ ম্যাচের মধ্যে ১০২ ম্যাচে আগে ব্যাটিং করা দল ৩০০ রান তুলে জিতেছে। তিন শ কিংবা তার ওপাশে রান তাড়া করতে নেমে জয়ের এ সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। গত বিশ্বকাপের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৮টি ওয়ানডে হয়েছে ইংল্যান্ডের মাঠে। এর মধ্যে ১০ ম্যাচে পরে ব্যাটিং করা দল ৩০০ কিংবা তার বেশি রান তাড়া করে জিতেছে। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয়, গত চার বছরে ক্রিকেট কতটা বদলে গেছে।

গত ক্রিকেট বিশ্বকাপের পর আরও একটি জায়গায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। গুরুত্ব বেড়েছে লেগ স্পিনারদের। প্রায় প্রতিটি দলই তাদের একাদশে অন্তত একজন লেগ স্পিনারকে রাখতে চাচ্ছে। ভারত তো কুলদীপ যাদব আর যুজবেন্দ্র চাহালকে একসঙ্গে দলে নিয়ে রীতিমতো বিপ্লব এনেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আছেন ইমরান তাহির, ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ। আফগানিস্তানের মতো নতুন শক্তিও পেয়ে গেছে রশিদ খানের মতো দারুণ এক লেগ স্পিনার। যিনি পরিণত হয়েছেন তাদের উইকেট নেওয়ার মূল অস্ত্রে। অস্ট্রেলিয়া দলে গতিতারকাদের ভিড়েও আছেন এক লেগ স্পিনার—অ্যাডাম জাম্পা।

গত চার বছরে ক্রিকেট–দুনিয়ায় বড় এক পরিবর্তন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি নিজে। নিজের মানসিক শক্তিকে যেভাবে দলে ছড়িয়ে দিয়েছেন, যেভাবে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সব কন্ডিশনের জন্য আদর্শ এক দল হিসেবে গড়ে তুলেছেন, সেটি একটা বড় ঘটনা। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেটের দিগন্তরেখা বদলে দিতে বড় একটা ভূমিকা আছে ভারতের। ভারত এখন অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে জেতে, জেতে ইংল্যান্ডে গিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি কন্ডিশনও এখন ভারতীয় দলের কাছে খুব বড় কোনো বাধা নয়। কোহলির ধারাবাহিকতাটা অনন্য এক ব্যাপারই। নিজের ফিটনেস আর সামর্থ্যকে ক্রিকেট–বিশ্বেই দারুণ এক উদাহরণে পরিণত করেছেন ভারতীয় অধিনায়ক।

এই সময়ে ক্রিকেটে পরিবর্তনের বড় বিজ্ঞাপন তো বাংলাদেশও। ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর ঘরের মাঠে ভারত, পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে জয়যাত্রার শুরু হয়েছিল, সেটির ধারাবাহিকতায় মাশরাফি–সাকিবরা এখন অনেক বড় কিছুরই স্বপ্ন দেখে। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠাটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা বড় ঘটনা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কার্ডিফের সেই ম্যাচটি তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার বড় উদাহরণ। নিউজিল্যান্ডের ২৬৫ রান টপকাতে গিয়ে ১২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেছিল ৫ উইকেটে। সাকিব আল হাসান আর মাহমুদউল্লাহর ২৪৪ রানের ম্যাচজয়ী জুটি বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় তুলে দিয়েছে। ক্রিকেট মাঠে, বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে কোনো বাধাই যে বাংলাদেশের কাছে বাধা নয়—এই ম্যাচটিতে সে বিশ্বাসটা ছড়িয়ে পড়েছে দলের মধ্যে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর বড় পরিবর্তন তো এটা। এই সময়ের পর তিনটি ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠা সে বিশ্বাস থেকেই।

এই চার বছরে ক্রিকেট–দুনিয়ায় উল্টোপথে হাঁটার উদাহরণটা চমকে ওঠার মতোই। ক্রিকেটের অদম্য শক্তি হিসেবে একসময় পরিচিত শ্রীলঙ্কা এখন দুর্বল এক শক্তি। ২০১৫ বিশ্বকাপেই টানা চারটি সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। নিজের শেষ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত এই কিংবদন্তি ক্রিকেটার নিশ্চয়ই সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, তাঁর অনুপস্থিতিতে কী ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে লঙ্কান ক্রিকেট। একই কথা প্রযোজ্য আরেক গ্রেট মাহেলা জয়াবর্ধনের ব্যাপারেও। এই দুই ক্রিকেটার চলে যেতেই শ্রীলঙ্কা যেন পথ হারিয়ে ফেলল। দলে একজন ক্রিকেটারও খুঁজে পাওয়া গেল না, যারা সাঙ্গাকারা ও জয়াবর্ধনের মানের না হলেও মোটামুটি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন । ২০১৫ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া শ্রীলঙ্কা এরপর ক্রিকেটের সাফল্যের বলয় থেকে মোটামুটি হারিয়েই গেছে। একসময়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলটি এখন র​্যাঙ্কিংয়ের নিচের দিকে ধুঁকছে।

চার বছর তো নেহাতই কম সময় নয়। তাই ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেটে যে বদল, সেটি স্বাভাবিকই। তবে ক্রিকেটে আক্রমণাত্মক কেতাটা যেভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেটিই আসলে এই বদলের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। টি–টোয়েন্টি ক্রিকেট যেভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তাতে ৫০ ওভারের ক্রিকেটের শক্ত ভিত্তির ওপর টিকে থাকতে যে ব্যাপারগুলোর প্রয়োজন ছিল, সেটি এই চার বছরে অর্জন করেছে ক্রিকেট।

চার বছরের সব ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোকে সঙ্গী করে ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে উপভোগ্য এক আসর। এটি আগামই বলে দেওয়াই যায়।