দীর্ঘশ্বাসের একাদশ!

>বিশ্বকাপ জিততে পারেননি—এমন বিখ্যাত ক্রিকেটারের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। তাঁদের নিয়ে একটা দল গড়লে কেমন হয়! নির্বাচকের ভূমিকায় কামরুল হাসান

সুনীল ভালসনকে দেখলে কি মাঝেমধ্যে একটু ঈর্ষা হয় সৌরভ গাঙ্গুলীর?

এই কিছুদিন আগেও ভালসন আইপিএলের দিল্লি ক্যাপিটালস দলের ম্যানেজার ছিলেন। সৌরভও এই মৌসুমে দিল্লির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। দুজনের মাঝেমধ্যে দেখা–সাক্ষাৎ হয়েছে, ধরেই নেওয়া যায়।

অবশ্য ক্রিকেটার হিসেবে একজন সৌরভ যে মাপের, তাতে ভালসনকে নিয়ে তাঁর ঈর্ষাটির্ষা থাকার কথা না। অন্ধ্র প্রদেশের এই পেসার কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই খেলেননি। প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট ‘এ’ মিলিয়ে তাঁর যা উইকেট, খণ্ডকালীন বোলার হয়েও সৌরভের উইকেট তাঁর চেয়ে বেশি। আর ব্যাটসম্যান সৌরভের সঙ্গে তো ভালসনের তুলনার প্রশ্নই আসে না।

তবে ভালসনের এমন একটা অর্জন আছে, যেটা সৌরভের নেই—একটা বিশ্বকাপ! ১৯৮৩ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারতের যে দলটা, সে দলের অংশ ছিলেন সুনীল ভালসন। তবে পুরো স্কোয়াডে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, যাঁর ওই বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ খেলা হয়নি। তাতে কী, অর্জনটা তো দলে থাকা সবারই। না খেলেই যা পেয়ে গেছেন ভালসন, অনেক সাধনার পরও সেটা পাওয়া হয়নি সৌরভের। এবং আরও অনেক কিংবদন্তির।

হ্যাঁ, বিশ্বকাপ জিততে না পারার আক্ষেপ নিয়ে বিদায় নেওয়া কিংবদন্তি ক্রিকেটারের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। অনায়াসে তাঁদের নিয়ে একটা একাদশও গড়ে ফেলা যায়। এবং গড়ার পর মনে হবে, আরে, এই দলটা তো বিশ্বকাপজয়ী যেকোনো দলকে হারানোর সামর্থ্য রাখে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে আগে দলটা গড়ে ফেলা যাক।

সৌরভকে দিয়েই শুরু হোক। ভারতীয় ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার অন্যতম কারিগর বলা হয় তাঁকে। তাঁর নেতৃত্বেই আসলে সত্যিকারের আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে শুরু করে ভারত, জিততে শুরু করে বিদেশের মাটিতে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বাঁহাতি ওপেনারের নেতৃত্বে ২০০৩ সালে বিশ্বজয়ের খুব কাছেও গিয়েছিল ভারত। কিন্তু রিকি পন্টিং যে সেদিন এমন তাণ্ডব চালাবেন, কে জানত! বিশ্বকাপ এর আগে পরে সৌরভ আরও দুটি খেলেছেন, কিন্তু এত কাছাকাছি যেতে পারেননি কখনোই।

সৌরভের ওপেনিং সঙ্গী কে হতে পারেন? চট করে যে দুটি নাম মাথায় আসছে, সেই দুজনও বাঁহাতি—সাঈদ আনোয়ার ও গ্যারি কারস্টেন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে কারস্টেনের অপরাজিত ১৮৮ তো দীর্ঘদিন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস হয়ে ছিল। আর ম্যাথু হেইডেন-বীরেন্দর শেবাগের মতো ওপেনাররা ওয়ানডের বড় আকর্ষণ হয়ে ওঠার আগে সময়টা ছিল আসলে সাঈদ আনোয়ারের। ১৯৯৭ সালে চেন্নাইয়ে ১৯৪ তো একটা সময় ওয়ানডে ক্রিকেটের বড় একটা বিজ্ঞাপনই ছিল। কারস্টেন খেলোয়াড় হিসেবে না জিতলেও পরে ভারতের কোচ হিসেবে জিতেছেন বিশ্বকাপ। আক্ষেপটা যেহেতু সাঈদ আনোয়ারেরই বেশি, সৌরভের সঙ্গী হিসেবে তাঁকেই বেছে নেওয়া যাক।

এরপর ব্রায়ান লারা। তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তাঁর মতো ম্যাচ উইনার আর কেউ ছিলেন কি না, এ নিয়েও তর্ক হতে পারে। ক্রিকেটের যেকোনো বিশ্ব একাদশ গড়তে গেলেই তাঁর নামটা রাখা হয়, বিশ্বকাপ না জেতাদের একাদশে তো তিনি থাকবেনই।

চারে থাকবেন যে ভদ্রলোক, তিনি এখন আর এ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু রস টেলর আর কেন উইলিয়ামসনদের আগে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ব্যাটসম্যান তো মার্টিন ক্রোই। তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন, তবে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ক্রো–ই ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে জায়গা নিয়ে থাকবেন চিরদিন। শিরোপাটা ওই বিশ্বকাপে জিতেছিল পাকিস্তান, কিন্তু এককভাবে ওই বিশ্বকাপটা তো আসলে ক্রোরই।

ক্রিকেট বিশ্বকাপ না জেতার আক্ষেপ নিয়ে ক্রো না–ফেরার দেশে চলে গেছেন ৫৩ বছর বয়সে। তবে দুটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেও সেই আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে আছেন কুমার সাঙ্গাকারা। ২০০৭ বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়া ও ২০১১ বিশ্বকাপ ভারত হয়েছে তাঁর স্বপ্নভঙ্গের কারণ। ক্রোর পরের ব্যাটিং অর্ডারে জায়গাটা তাঁরই থাক।

ছয় ও সাত নম্বর জায়গা দুটি নিয়ে আসলে মধুর সমস্যা। দুজনই অলরাউন্ডার রাখতে পারলে ভালো। চোখ বুজলেই ভেসে উঠবে ইয়ান বোথাম, জ্যাক ক্যালিস, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ বা শহীদ আফ্রিদির চেহারা। বিশ্বকাপ খালি হাতে ফিরিয়েছে চারজনকেই। একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার ও একজন স্পিনিং অলরাউন্ডার রাখলে অবশ্য এখানে আফ্রিদি জায়গা পেয়ে যাবেন সহজেই, রেখে দিতে হবে বাকি তিনজনের যেকোনো দুজনকে। কিন্তু সেটা বোথাম বা ক্যালিসের প্রতি রীতিমতো অন্যায়। নিজ নিজ সময় ছাড়িয়ে তাঁরা সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের ছোট তালিকায়ও থাকবেন। শেষ পর্যন্ত তাই ভেবেচিন্তে দুজনই পেস বোলিং অলরাউন্ডার রাখার সিদ্ধান্ত। তাতে আফ্রিদি বাদ পড়ছেন, বাদ পড়ছেন ফ্লিনটফও।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কা আর ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারায় বিশ্বকাপ অধরা থেকে গেছে অনিল কুম্বলেরও। তবে কোনো সন্দেহ ছাড়াই কুম্বলে ভারতের সর্বকালের সেরা স্পিনার, ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা তো বটেই। শেন ওয়ার্ন, মুত্তিয়া মুরালিধরনরা বিশ্বকাপ জিতেছেন। না জেতাদের দলে স্পিন আক্রমণের নেতৃত্ব তাই কুম্বলের কাঁধেই।

পরের তিনটি জায়গা পেস বোলারদের। সেখানে অন্তত একজনকে নিয়ে মনে হয় না কারও আপত্তি থাকবে—স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। শুধু বল হাতেই নিখুঁত সুইং আর গতিই নয়, নিজের সময়ের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন ছিলেন হ্যাডলি। তিনটি বিশ্বকাপ খেলেও যাঁর কখনো ট্রফি ছুঁয়ে দেখা হয়নি।

আরও দুজন পেসার নিতে হয় দলে। অনেকগুলো নাম বিবেচনায় আসবে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত পেস জুটি ডেনিস লিলি-জেফ টমসন দুটি করে বিশ্বকাপে খেলেছেন, কিন্তু সেটা ওয়ানডে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া বদলে যাওয়ার আগে। এমনিতে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সেরা বোলারদের মধ্যে থাকলেও বিশ্বকাপে দুজনের পারফরম্যান্সই বেশ সাদামাটা। সেদিক থেকে বরং বেশ এগিয়ে থাকবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যালান ডোনাল্ড ও পাকিস্তানের ওয়াকার ইউনিস। কিন্তু জায়গা তো বাকি মাত্র দুটি, কী করা যায়!

অনেক ভেবেচিন্তে মনে হলো, এই সিদ্ধান্তটা দলের অধিনায়কের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। উইকেট আর কন্ডিশন বুঝে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে খেলাবেন। ওহ, অধিনায়কত্ব কে করবেন সেটাই তো বলা হলো না। সৌরভ গাঙ্গুলী, কুমার সাঙ্গাকারা, ব্রায়ান লারা, মার্টিন ক্রো—বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন চারজনই। সৌরভ আর সাঙ্গাকারার নেতৃত্বে তো যাঁর যাঁর দল ফাইনালও খেলেছে।

তবে ১৯৯২ বিশ্বকাপ মার্ক গ্রেটব্যাচকে দিয়ে ওপেনিংয়ে পিঞ্চ হিটিং করানো কিংবা অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলকে দিয়ে বোলিং ওপেন করানো—সেই সময়ের জন্য খুবই সৃষ্টিশীল ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। এমন সিদ্ধান্ত যিনি নিতে পারেন, এই দলের অধিনায়ক তাঁকেই করা উচিত—মার্টিন ক্রো!

ক্রিকেট পরীক্ষা
দর্শক হিসেবে যাঁরা ১৯৯৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট দেখতে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, তাঁদের ক্রিকেটজ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। যেসব ক্রিকেট–ভক্ত ভিসার আবেদন করেন, সবাইকে অভিবাসন কর্মকর্তারা ক্রিকেট নিয়ে নানা প্রশ্ন করেন। উদ্দেশ্য একটাই, সম্ভাব্য অবৈধ অভিবাসীদের আটকানো।

তাঁরা দুজন
২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও দলকে জেতাতে পারেননি দুই অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারা। পরের বিশ্বকাপেও খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন তাঁরা। আর সেবার শ্রীলঙ্কা বিদায় নিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালেই।

গড় ১৪০.৫০!
ল্যান্স ক্লুজনার ১৯৯৯ বিশ্বকাপ উন্মাতাল করে তুলেছিলেন ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে। ১২২.১৭ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন ২৮১ রান। অবিশ্বাস্য ছিল তাঁর ব্যাটিং গড়—১৪০.৫০! রহস্যটা হলো, ৮ ইনিংসের ৬টিতেই অপরাজিত ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার।

পুরস্কার
২০০৭ বিশ্বকাপে টুর্নামেন্টের দ্রুততম সেঞ্চুরি করার জন্য ম্যাথু হেইডেন এবং একই ওভারের ছয় বলে ছয় ছক্কা মারার জন্য হার্শেল গিবস পেয়েছিলেন বিশেষ পুরস্কার—সেন্ট কিটস ও নেভিসের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব! পর্যটননির্ভর দেশটির নাম বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই ছোট্ট দ্বীপদেশটির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল এই পুরস্কার।

অপরাজিত তিন
২০০৩ বিশ্বকাপের ২১টি সেঞ্চুরির ১০টিতেই অপরাজিত ছিলেন ব্যাটসম্যান। সর্বোচ্চ ৩টি সেঞ্চুরি করেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। তিনবারই অপরাজিত!

শূন্য-শূন্য-শূন্য
মহসিন খান ০, মুদাসসর নজর ০, জহির আব্বাস ০। পাকিস্তান ০। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের স্কোরকার্ডের এই করুণ দশা হয়েছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। হ্যাডলি ও ল্যান্স কেয়ার্নসের আট বলে পত্রপাঠ বিদায় পাকিস্তানের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের।