তাঁরা তিনজন...
>বিশ্বকাপে একই ম্যাচে অভিষেক তাঁদের। সেই ম্যাচেই আবার স্মরণীয় এক জয়। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের বাংলাদেশের স্বপ্নসারথি হয়ে ওঠার গল্প বলছেন ইকরামুল হক
স্মৃতির সরণি বেয়ে একটু পেছনে বেড়িয়ে আসি চলুন!
খুব বেশি নয়, মাত্র এক যুগ আগে। ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ—ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর রাজধানী পোর্ট অব স্পেনে। কিছু মনে পড়ছে নিশ্চয়ই। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে সেই দিনেই হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এবারের ২০১৯ বিশ্বকাপ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার সেই ৩৮ রানে ৪ উইকেট নেওয়া বোলিংয়ের কথা মনে পড়ছে কি একটু? তাতেও যদি অসুবিধা হয় তো আরেকটা ছবির কথা মনে করুন। ভারতের সে সময়ের প্রধান পেসার জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে প্রবল ঔদ্ধত্যে লং অন দিয়ে বিশাল ছক্কা মারলেন ১৭ বছরের এক তরুণ, নাম তাঁর তামিম ইকবাল।
শুধু ওই ম্যাচ নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানপর্বের কোলাজে চিরদিনের জন্য জায়গা করে নেওয়া একটা ছবি। সেই ম্যাচে শুধু তামিম নন, সেদিন বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের আরও দুই তরুণ তুর্কির। এই তিন বিশ্বকাপ অভিষিক্তের ব্যাটে বাংলাদেশ জিতেছিল সেই ম্যাচ, তিনজনই করেছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। আসলে সেদিনে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের গান শুনিয়েছিলেন এই তিন তরুণ। অনুচ্চারে সেদিন যেন তিন নবীন ক্রিকেট–বিশ্বকে বলেছিলেন, ‘আসছে নতুন বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেওয়া কোচ নাজমুল আবেদীন একবার বলছিলেন, ‘ওই দিনটা আমাদের ক্রিকেটের জন্য বিশেষ একটা দিন। তামিম, সাকিব, মুশফিক সেদিন নতুন স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল এ দেশের ক্রিকেটকে ঘিরে। তামিমের ওই ছক্কা শুধু ছয়টা রান ছিল না কেবল, ওটা বিশ্বের জন্য বার্তা ছিল।’
সেই বার্তা যে ভুল ছিল না, সেটি এক যুগ ধরে প্রমাণ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের তিন স্তম্ভ। ইংল্যান্ডে নিজেদের চার নম্বর বিশ্বকাপটা যখন খেলতে যাচ্ছেন, তখন এই তিনজনের প্রত্যেকেই বিশ্ব ক্রিকেটের বড় নাম। তামিম ইকবাল বিশ্বের অন্যতম সেরা ওপেনার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। যেকোনো দলই নিশ্চয়ই মুশফিকুর রহিমের মতো একজন উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যানকে চাইবে। যিনি একটি দেশের প্রধান ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলে চলেছেন প্রায় দেড় যুগ। আর সাকিব আল হাসানকে নিয়ে নতুন করে বলার কি কিছু আছে? তিন ফরম্যাটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ছিলেন লম্বা সময়। সব পরিসংখ্যানকে যদি দূরেও সরিয়ে রাখা হয়, তবু ক্রিকেটীয় জ্ঞান ও মাঠের পারফরম্যান্সে সেটির প্রতিফলনের জন্য সময়ের সেরা যেকোনো দলেই জায়গা করে নেওয়ার সামর্থ্য রাখেন সাকিব।
এই ত্রয়ীকে এক শব্দে যদি বাঁধতে চান, তাহলে ‘আস্থা’ই সম্ভবত ভালো শব্দ। শুধু ক্রিকেট বিশ্বকাপ কেন, আজও যেকোনো ম্যাচে বাংলাদেশের নামা মানেই প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট এই ত্রয়ী। বাংলাদেশের অধিকাংশ জয়ের দিকে ফিরে তাকালেই মুখ্য ভূমিকায় দেখা যাবে এই ত্রয়ীর যেকোনো একজনকেই। আসলে গত এক যুগের বাংলাদেশ দল মানেই যে এই তিন স্তম্ভে ভর করে বিশ্ব ক্রিকেটে সম্মানের জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্ন।
আর তাঁরা তিনজন? মাঠের বাইশ গজে, সবুজ ঘাসে একসঙ্গে চলতে চলতে জনমের বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে তাঁদের। অনূর্ধ্ব–১৫ দলে খেলার সময় পরিচয়, তারপর পথচলা–বন্ধুতা। আর গত কয়েক বছরে সেখানে এসে জমা হয়েছে আরেকটা দারুণ ব্যাপার। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, খুবই স্বাস্থ্যকর সেটি বাংলাদেশের জন্য। বোলিংয়ে তো তামিম–মুশফিকদের সুযোগ নেই, কিন্তু ব্যাটিংয়ে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মজার খেলায় মেতেছেন তিন বন্ধুতে। কখনো মোট রানে এগিয়ে যাচ্ছেন সাকিব, পরের ম্যাচেই আবার তাঁকে টপকে গেলেন তামিম। কখনো আবার টেস্টে সাকিবের বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব৵ক্তিগত ইনিংসের রেকর্ডটা ভেঙে নতুন করে নিজের নামে লিখছেন মুশফিক। একবার এক ক্রিকেট ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিব নিজেই বলেছিলেন, কতটা উপভোগ করেন তাঁরা নিজেদের মধ্যের এই লড়াই, ‘সত্যিই অসাধারণ একটা ব্যাপার, আমাদের তিনজনের জন্যই। আমার মতে এটি অসাধারণ একটি যাত্রা। আশা করি আগামী আরও কয়েক বছর আমরা একসঙ্গে খেলতে পারব, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কিছু দিতে পারব।’
এই ত্রয়ী যত দিন সম্ভব একসঙ্গে বাংলাদেশের সব সোনালি স্বপ্নপূরণের সাক্ষী হোন—এর চেয়ে বেশি আর কী চায় বাংলাদেশ? এবার বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ যেমন চাইছে—এই তিনের ব্যাটে রানের বান ডাকুক, সাকিব বোলিংয়ে বিশ্বকে শাসন করুন, উইকেটের পেছন থেকে অনুপ্রেরণার সুর ছড়িয়ে যান মুশফিক, বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনো ক্যাচ নিয়ে স্টেডিয়ামকে স্তব্ধ করে ফেলুন তামিম।
বিশ্বকাপটা ইংল্যান্ডে বলেই বোধ হয় চাওয়াটা আরও বাড়তি এই তিনের কাছে। অভিজ্ঞতা তো আছেই, ইংল্যান্ডের বুকে সুখস্মৃতি আছে এই তিনেরই। ২০১০ সালে তামিম ইকবালের লর্ডস ও ওল্ড ট্রাফোর্ডের টানা দুই সেঞ্চুরিকে দূরে সরিয়ে রেখে শুধু ওয়ানডেকে বিবেচনায় আনলেও ইংলিশ উইকেট হতাশ করেনি বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যাটসম্যানদের। ইংল্যান্ডে খেলা ৭ ওয়ানডেতে ৫০.৭১ গড়ে ১ সেঞ্চুরি আর ২ ফিফটিতে ৩৫৫ রান করেছেন তামিম। ৫ ম্যাচে ৩৭.০০ গড়ে মুশফিকুর রহিমের রান ১৮৫। শীর্ষ চারের মধ্যে সাকিব আল হাসানের গড়টাই যা একটু কম, ৭ ইনিংসে ২৭.৮৫ গড়ে ১৯৫ রান। তবে এর মধ্যে কার্ডিফের সেই ম্যাচে ১১৪ রানের ইনিংসটাকে আত্মবিশ্বাসের উৎস হিসেবে খুঁজে নিতে পারেন বাঁহাতি অলরাউন্ডার।
ত্রিশ পেরিয়ে যাওয়া এই তিন ক্রিকেটারের জন্য এটাই শেষ বিশ্বকাপ ভাবছেন অনেকেই। কে জানে পরের চার বছরে কী হয়! তবে এই তিন নিশ্চয়ই এত দ্রুত শেষ দেখেন না নিজেদের। সে তর্ক তোলা থাক সময়ের খাতায়। শেষ হোক আর না–ই হোক, বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের জন্য রাঙিয়ে তুলুন সাকিব–তামিম–মুশফিক।
পুরো বাংলাদেশ যে আপনাদের চোখেই স্বপ্ন দেখে।