টেস্ট খেলতে না পারার আক্ষেপ ছিল মোশাররফ রুবেলের
প্রথমে বন্ধু হিসেবে কাছ থেকে দেখা, তারপর ক্রীড়াসাংবাদিক হিসেবে লম্বা সময় দুজনের পাশাপাশি পেশা—কত ইন্টারভিউ, ম্যাচ রিপোর্ট কিংবা তার–সম্পর্কিত সংবাদ নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। কত লেখা লিখেছি খন্দকার মোশাররফ হোসেন রুবেলকে নিয়ে! সেই রুবেলের জন্য আজ আমার স্মৃতিচারণা করতে হচ্ছে! ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কত কঠিন, তা জীবনে প্রথমবারের মতো টের পেলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একই শিক্ষাবর্ষে (১৯৯৯-২০০০) ভর্তি হলেও বিভাগ ছিল আলাদা। রুবেল ছিল শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র, আর আমি ইতিহাস বিভাগের। তুলনামূলক বেশি চাপ থাকায় ক্রিকেট ও পড়াশোনা দুটো একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া কষ্টই হচ্ছিল তার জন্য। পরে বিভাগ পরিবর্তন করে চলে আসে আমাদের বিভাগে। তখন বিকেএসপির গণ্ডি পেরিয়ে রুবেল সবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরু করেছে। নিয়মিত পারফরম্যান্স করে মিডিয়ার ফোকাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের তারকা বনে গেল রুবেল। তবে এর মধ্যেই কীভাবে যেন পড়ালেখাটা ঠিকভাবে চালিয়ে যেত সে। এমনও দেখা গেছে ফাইনাল পরীক্ষার আগে সারা দিন মাঠেই কাটিয়েছে। তারপর সন্ধ্যায় হলে ফিরে সারা রাত পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে। কিংবা পরীক্ষা দিয়ে হল থেকেই দৌড়েছে ক্রিকেট মাঠে। অবশ্য এমন পরিশ্রমের পুরস্কারও সে পেয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়াক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ব্লু’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল রুবেল।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফরম্যান্সের কারণে রুবেলকে জাতীয় দলে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। বাঁহাতি স্পিনার, সঙ্গে ব্যাটিং ভালো করায় মোহাম্মদ রফিকের উত্তরসূরি হিসেবে আলোচনায় ছিল রুবেল। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে ওয়ানডে সিরিজে ডাক পেল। সেদিন আমাদের বন্ধুমহল থেকে শিক্ষকেরা—সবাই খুব খুশি হয়েছিল। আমার খুশিটা একটু বেশিই ছিল, কারণ চট্টগ্রামের তার অভিষেকটা মাঠে বসেই দেখার সুযোগ হয়েছিল। সিরিজে বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ হলো। এই সিরিজে অল্প কিছু দিন পরই আয়ারল্যান্ড এল বাংলাদেশ সফরে। সে সিরিজে আর জায়গা হয়নি রুবেলের। লম্বা সময় ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে এক সিরিজ পরই বাদ পড়াটা রুবেল সেদিন কোনোভাবেই মানতে পারেনি। খুব হতাশ হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক না হয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে হলে হয়তো ওর ক্যারিয়ারটা অন্য রকম হতো। তারপর হতাশা পেয়ে বসে। তখনই ভারতে বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ আইসিএলের প্রস্তাব ফেরাতে পারেনি। ফলাফল বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হলো। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে যখন ফিরল, সেই আগের রুবেলকেই দেখেছিলাম।
বিপিএলে দারুণ পারফর্ম করে আলোচনায় ছিল রুবেল। কিন্তু স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে খুবই বিচলিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মুক্তির আনন্দ নিয়ে আবার মাঠে ফিরেছিল। পরিশ্রম দিয়ে আবার সবকিছু স্বাভাবিক করেছিল। এই পরিশ্রমই ছিল রুবেলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় দলে ডাক পায়। আট বছর বিরতি দিয়ে জাতীয় দলে ফেরার রেকর্ড বাংলাদেশের আর কারও ছিল না। ইংল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই সিরিজে দুটি ম্যাচ খেলার সুযোগও পেয়েছিল। কিন্তু আশানুরূপ পারফরম্যান্স করতে না পারায় বাদ পড়তে হয়। তবে হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। ঘরোয়া লিগ ও বিপিএলে আগের রুবেলকেই দেখেছিলাম। ২০১৯ সালে বিপিএল চলাকালে প্রথম মরণব্যাধির উপস্থিতি কিছুটা টের পায়; যদিও শুরুতে কিছুই বুঝতে পারেনি। সেবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলার সময় হোটেল রুমেই খিঁচুনি দিয়ে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিল। চিকিৎসকেরা মোটেও আঁচ করতে পারেননি তখন। তারপর বিপিএল শেষে আবার একই সমস্যা, সেই খিঁচুনি দেখা দেয়। তখন আবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে জানা যায় মস্তিষ্কে টিউমার বাসা বেঁধেছে। সিঙ্গাপুরে আরেকটু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ল মরণব্যাধি ক্যানসার।
সেই দফায় অস্ত্রোপচার করিয়ে সুস্থ হয়ে মাঠে ফেরার প্রস্তুতিও শুরু করেছিল রুবেল। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে আবার ফিরে আসে সেই মরণব্যাধি। একই সঙ্গে করোনাও হানা দেয় পুরো বিশ্বে। যেহেতু সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, কিন্তু করোনার কারণে সাধারণ যোগাযোগ বন্ধ ছিল, তখন খুব কষ্ট করে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল এবং এ চিকিৎসা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যার জোগান দিতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। তবু কখন হতাশ হতে দেখিনি। শক্ত মানসিকতা নিয়ে এই কঠিন রোগের সঙ্গে লড়াই করে গেছে। অবশেষে সাড়ে তিন বছর পর হার মানতে হলো তাকে।
ভেবেছিলাম যেভাবে জাতীয় দলে আট বছর বিরতি দিয়ে ফিরে নতুন রেকর্ড গড়েছিল, এ যাত্রায়ও সে রকম কিছু একটা হয়ে যাবে। তবে রুবেলের এই কঠিন সময়ে একটা ব্যাপার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেটা হচ্ছে তার পাশে দাঁড়ানো। ক্রিকেটার থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, সংগঠক, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, তার বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধুমহল, এমনকি যাদের সঙ্গে রুবেলের কোনো ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল না, তারাও এই লড়াইয়ে রুবেলের পাশে দাঁড়িয়েছিল, যা কঠিন সময়ে তাকে খুব সাহস জুগিয়েছিল। তবে একটা আফসোস সঙ্গে নিয়েই বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। সেটা হলো টেস্ট ক্রিকেট খেলতে না পারা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৯২ উইকেট নিয়ে একটি টেস্টও খেলতে না পারা ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আফসোস। শয্যাশায়ী রুবেলের খুব ইচ্ছা ছিল একবারের জন্য হলেও বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে যাওয়ার। ইচ্ছা প্রকাশের তিন দিনের মাথায় সেই প্রিয় স্টেডিয়ামে যাওয়ার সুযোগ হলো রুবেলের, কিন্তু সেটা তো তার ইচ্ছা পূরণের জন্য নয়, শেষবিদায়ের।
লেখক: মাছরাঙা টেলিভিশনের ক্রীড়াসাংবাদিক