জয়ের সম্ভাবনা জার্মানিরই বেশি

আজ তাহলে আমরা এখানে! জার্মানি ও আর্জেন্টিনা, ঐতিহ্যবাহী দুই ফুটবল জাতি নামছে বিশ্বকাপের শিরোপা যুদ্ধে। কেউই বলতে পারবে না যে আজকের মঞ্চ এই দুদলের প্রাপ্য নয়।
সব বাধা টপকে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টুর্নামেন্টের ফাইনালে এসেছে দুদল। যদিও দুদলের খেলার ধরন, পথচলা বা এই পর্যায়ে আসার ধরন ছিল ভিন্ন। আজ মারাকানায় বিশেষ কিছুর অপেক্ষায় আমরা। তবে এই বিশ্বকাপে আমরা যেভাবে গতিময়তার উৎসব দেখেছি, আমার মনে হয় আজকে তেমন স্প্রিন্ট হবে না, বরং আজ হবে দাবা খেলা। তার পরও অবশ্য স্মরণীয় একটি ম্যাচ হওয়া উচিত।
শুধু জার্মানি-ব্রাজিল ম্যাচের মতো গোল উৎসব প্রত্যাশা না করাই ভালো। সত্যি বলতে, টমাস মুলার অ্যান্ড কো. স্বাগতিকদের বিধ্বস্ত করেছে বলেই পরের সেমিফাইনালটি অমন ম্যাড়মেড়ে হয়েছে। আর্জেন্টিনা-হল্যান্ড কোনো দলই ঝুঁকি নিতে চায়নি, বেশ আঁটসাঁট খেলেছে। গ্রুপ পর্বে বেশ কবার হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় আর্জেন্টিনা জানত তাদের রক্ষণ আরও পোক্ত করতে হবে। মার্টিন ডেমিচেলিস ফেরায় শেষ পর্যন্ত তারা সেটা করতে পেরেছে। এজেকিয়েল গ্যারাইয়ের সঙ্গে মিলে নির্ভরযোগ্য একটা সেন্টার ব্যাক জুটি গড়ে তুলেছে ডেমিচেলিস। ডাচ কোচ লুই ফন গালও একই রকম নিরাপদ পথ বেছে নিয়েছিলেন। দুদলই ঝুঁকি না নেওয়ায় ম্যাচ ঠিক গতি পায়নি। কোনো দলই পরস্পরকে জায়গা দিতে চায়নি। হল্যান্ড লিওনেল মেসিকে দমিয়ে রাখতে পেরেছে, আর্জেন্টিনাও আরিয়েন রোবেনকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পেরেছে।
গোলের খুব সামান্য সুযোগই সৃষ্টি হয়েছিল এই ম্যাচে। বেশ আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়াচ্ছে। এ জন্যই টিম ক্রালকে কাজে না লাগানোর ফন গালের সিদ্ধান্তে আমি হতবাক হয়ে গেছি। একটি বদলি তার অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা উচিত ছিল। কারণ কোস্টারিকার বিপক্ষে ক্রালের সাফল্য ডাচ কোচের জন্য একটু সমস্যাও সৃষ্টি করেছিল। আগের ম্যাচে কোচের কাছে ‘প্রত্যাখ্যাত’ বেচারা ইয়াসপার সিলেসেন ভীষণ চাপে পড়ে যায়। সেটা আর্জেন্টিনার পক্ষে গেছে।
আজকের ম্যাচের ব্যাপার অবশ্য আলাদা। জার্মানি অবশ্যই বেশি পরিপূর্ণ, ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছে। ম্যাচের পরিবর্তিত সব পরিস্থিতির জন্য ওদের অনেক বেশি বিকল্প আছে। কিন্তু আর্জেন্টিনার আছে মেসি এবং আমি মোটেও ওর সমালোচনা শুনব না। এই টুর্নামেন্টে মেসিই আর্জেন্টিনার ভিত্তি। যখন সে ভালো খেলে না, তখনো প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত ও অস্থির রাখে। জার্মানি অবশ্যই সমীহ জাগানিয়া দল। ওদের পাসিং, মাঠে যেভাবে দ্রুত পজিশন বদলে ওরা খেলে, সবকিছুই অসাধারণ। কিন্তু ওদের মেসির মতো একজন ফুটবলার নেই। এমনকি মুলারও মেসি নন।
আমার বিশ্বাস, ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেখনদারি কিছু করার পথে হাঁটবে না আর্জেন্টিনা। বরং যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব বলের পেছনে লাগিয়ে রাখবে, আর আশা করবে একটি স্ট্রোকেই মেসি যেন পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। বেলো হরিজন্তেতে ব্রাজিল যে ভুল করেছে, সেই ভুল আর্জেন্টিনার করা উচিত হবে না। করলে জোয়াকিম লোর দল আর্জেন্টিনাকেও একই শিক্ষা দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে আলেসান্দ্রো সাবেলার প্রশংসা করতেই হবে। প্ল্যান ‘এ’ কাজ না করলে পরিকল্পনা বদলে ফেলার নমনীয়তা তিনি দেখাতে পেরেছেন।
বসনিয়ার বিপক্ষে ৫-৩-২ ফর্মেশনে দেখা গেছে মেসি কতটা অকার্যর ছিল। সাবেলা দ্রুতই তার সেরা ফুটবলারকে মেলে ধরার মতো করে ফর্মেশন বদলেছেন। হাভিয়ের মাচেরানোকে মাঝমাঠের সূত্রধর বানিয়ে তারা হয়তো ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলে, সঙ্গে তারা ভঙ্গুর রক্ষণভাগকে পোক্ত করতে পেরেছে। এখন তারা খেলার রাশ ধরে রেখে মেসির মারণশেলের জন্য অপেক্ষা করতে পারে। বুয়েনস এইরেসের অনেকের কাছে হয়তো উদ্ভ্রান্ত মনে হতে পারে, কিন্তু এই আর্জেন্টিনা দলটাকে আমার ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ব্রাজিলের মতো মনে হয়। ওই ব্রাজিলও রক্ষণকে পোক্ত করে সামনে রোমারিওকে ঝলসে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। তার পরও এই আর্জেন্টিনা জার্মানির নাভিশ্বাস তুলে দেওয়ার মতো দল নয়।
জার্মানির কোচের পারফরম্যান্সে আমি মুগ্ধ। আলজেরিয়ার বিপক্ষে আরও বড় ক্ষতি এড়াতে পেরেছে সে। আর একদিক থেকে ভাবলে শকোদ্রান মুস্তাফির চোটে বরং দলটাকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করার সুযোগ মিলেছে। ফিলিপ লাম তার সহজাত রাইট ব্যাক পজিশনে ফিরতে পেরেছে, খেদিরাও-ও একেবারে সময়মতো ফর্মে ফিরেছে।
আমি বুঝতে পারি, লামকে কেন মিডফিল্ডে খেলিয়ে যাচ্ছিলেন লো। পেপ গার্দিওলার সৌজন্যে ক্লাবে সে মিডফিল্ডেই খেলে। তাছাড়া খুব ভালো ফুটবলার হলেও সে খুব লম্বা নয়, বয়সও কমছে না দিন দিন। কিন্তু আমি বেলো হরিজন্তের ফর্মেশন ভাঙার পক্ষে নই। একটা দল যখন এমন ছন্দে থাকে, তখন প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে সুযোগ লুফে নিতে চায়। ব্রাজিল সেই রাতে যত বাজেই খেলুক, জার্মানি খুব ভালো না খেললে সাত গোল দিতে পারত না। ব্রাজিলকে গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছে, কারণ তারা হোমওয়ার্ক করেছিল। ডেভিড লুইজের ট্যাকটিক্যাল শৃঙ্খলার অভাব আর মার্সেলোর ওপরে উঠে যাওয়ার মওকা তারা নিতে চেয়েছে এবং পেরেছে। মাঠেই বোঝা গেছে কতটা সংঘবদ্ধ ছিল ওরা, ব্রাজিলকে নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করেছে।
আমার মতে বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা জার্মানিরই বেশি, শতকরা ৭০ ভাগ। কিন্তু সব পাল্টে দিতে পারে মেসি।
আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠায় ব্রাজিলিয়ানদের হা-হুতাশকে খুব হাস্যকর লাগছে আমার। মেসির মতো একজন মারাকানায় ট্রফি জিতলে সেটি মারাকানারই সম্মান। তবে আমি একজন ব্রাজিলিয়ান। ওর হয়ে গলা ফাটানোর আশা আমার কাছে না করাই ভালো, ঠিক আছে? তাছাড়া জার্মানির দ্বিতীয় জার্সিটির রং ফ্লামেঙ্গোর মতো, সেই ব্রাজিলিয়ান ক্লাব, যা আমাকে বিখ্যাত করেছে...।