কাইজার কথন: জার্মান–কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার লিখছেন প্রথম আলোয়
চিলির গতি ভোগাতে পারে ব্রাজিলকে
ফুটবলে অনেক কিছুতেই ব্যক্তিগত পছন্দ চলে আসে। কিন্তু সমালোচকেরা একটা বিষয়ে একমত হবেন, ব্রাজিল বিশ্বকাপের মতো এ রকম প্রাণবন্ত প্রথম রাউন্ড অনেক দিন হয়নি। কৌশল ও ট্যাকটিক্যাল ব্যাপারগুলো খেলায় কম প্রভাব ফেলেছে, গতি ও আক্রমণাত্মক ফুটবলেরই দাপট ছিল বেশি। জার্মানি ও ঘানার উন্মুক্ত লড়াইয়ে ২-২ ড্র, এমনটা কমই দেখা যায়!
সাধারণত প্রথম রাউন্ডে প্রতিপক্ষকে সাবধানতার সঙ্গে নেওয়া হয়। ফলে খেলাও একটু সংযত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় আক্রমণাত্মক ধরনটা এ রকম চলবে।দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে আমার মনে হয় ট্যাকটিকস অনেক বদলে যাবে।
হল্যান্ডের সঙ্গে স্পেনের ৫-১ গোলের জয়টা ছিল বিশেষ কিছু। অনেকের কাছেই এটা একটু অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, স্পেন যদি ২-০ গোলে এগিয়ে যেত (যেটা তাদের করা উচিত ছিল), তাহলে ম্যাচটা ওরাই জিতত। কিন্তু ওরা বিধ্বস্ত হলো ৫-১ গোলে, যদিও মাঠে দুদলই ছিল সমানে সমান। তবে রবিন ফন পার্সি ও আরিয়েন রোবেনের আমি বড় ভক্ত। ওরা জানিয়ে দিয়েছে শিরোপার চ্যালেঞ্জ নিতে তাঁরা প্রস্তুত। অবশ্য আগের কয়েকটি বিশ্বকাপের মতো ডাচরা আবার খেই হারিয়ে ফেললে মুশকিল। আমার তো মনে হয়, মেক্সিকো কাল তাদের বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে।
তবে আমি সবচেয়ে সমীহ করছি কোস্টারিকাকে। আমার কাছে গ্রুপ ‘ডি’ ছিল গ্রুপ অব ডেথ। ইংল্যান্ড, ইতালি ও উরুগুয়ের মতো সাবেক তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল এই গ্রুপে। কোস্টারিকার পক্ষে আমি কখনো বাজি ধরতাম না। এখন আটটি লাতিন আমেরিকান দলের সাতটিই গেল দ্বিতীয় পর্বে। এটা বড় একটা ঘটনা । কারণ শুরুতে মানুষের আশা ছিল শুধু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও চিলিই যাবে। অন্য আমেরিকান দলগুলোর কাছ থেকে খুব বেশি আশা কারোর ছিল না।
কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকায় যখন বিশ্বকাপ হচ্ছে, মধ্য আমেরিকার দলগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ভীষণ উদ্দীপ্ত। এই তাড়নাটা আসলে আমেরিকানদের স্বাতন্ত্র্যের । শুরুতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় ওদের আবেগের উথাল-পাতাল ঢেউটা টের পাওয়া যায়। আপনি যখন এ রকম উদ্দীপনা ওদের মধ্যে দেখবেন, এটা পরিষ্কার কেন ইউরোপের কোনো দল এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে জেতেনি।
ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ফ্রান্সকে নিয়ে আমি খুশি। করিম বেনজেমাকে সামনে নিয়ে ফ্রান্স আবার ফিরে পেয়েছে স্থিতিশীলতা। জার্মানদের অবশ্য আমার আরও বেশি সংহত মনে হচ্ছে। ওরাই একমাত্র দল যারা খেলার গতিটা ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ৪ গোল পাওয়া টমাস মুলারের মতো সব্যসাচী স্ট্রাইকার আছে ওদের। তার পরও আলজেরিয়ার ওদের একটা লড়াই হবে বলেই মনে হয়।
আমাকে অবাক করেছে ফ্রান্সের কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার পরও সুইজারল্যান্ডের অমন ঘুরে দাঁড়ানো। বায়ার্নের জেরদান শাকিরির ৩ গোলে হন্ডুরাসকে তাঁরা ৩-০ গোলে হারিয়েছে। এটা সুইস মনোবিদদের দারুণ অবদানের ফসল, আর কোচ ওটমার হিটজফেল্ডের তো বটেই। মঙ্গলবার আর্জেন্টিনা ওদের বিপক্ষে ভালোই ভুগবে।
আরও যেটা লক্ষ করলাম, অনেক দলই পরিস্থিতি অনুযায়ী তেমন ঝুঁকি নিচ্ছে না। আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসির মতো এত ভালো ফ্রি-কিক আর কেউ নিতে পারে না। ইতালির আন্দ্রেয়া পিরলো ফ্রি-কিক বিশেষজ্ঞদের গুরু। দুর্ভাগ্যবশত ও আর এই টুর্নামেন্টে নেই।
অফসাইড ফাঁদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপারগুলোও অনেকে পরখ করছে। বদলিরাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে। এই ক্ষেত্রে, ডাচ কোচ লুইস ফন গাল দারুণ কিছু করে দেখিয়েছেন। তাঁকে টুপি খোলা সম্মান, তিনি এমন কিছু তরুণকে খেলিয়েছেন যারা সবাইকেই চমকে দিয়েছে।
শেষ ষোলোতে আমি ব্রাজিল-চিলি ম্যাচের দিকে আলাদা নজর রাখব। চিলি কি ওদের প্রচণ্ড গতিটা ধরে রাখতে পারবে? সেটা পারলে ব্রাজিলিয়ানদের ভুগতে হবে। তবে আমার আশা, ব্রাজিল তাদের খেলাটাকে আজ অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। ক্যামেরুনের সঙ্গে ৪-১ গোলের জয়ে তাঁরা অনেক বেশি নেইমার-নির্ভর ছিল। শিরোপা জিততে হলে ব্রাজিলকে আরও ভালো খেলতে হবে।
জাভি, জাবি আলনসো, পিরলো, রুনিদের মতো অনেকেই বিদায় বলে দিয়েছে। জীবনটা আসলে এ রকমই। বিশ্বকাপের পর দলে পরিবর্তন আসবেই। যাদের বয়স ত্রিশের বেশি, নতুনদের জন্য তারা জায়গা ছেড়ে দেবে। এটাই হয় সব সময়।
তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ে অনেক অভিযোগ-প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু এটাও বলতে হবে খেলোয়াড়েরা এতটাই প্রস্তুত যে, তারা এটা ভালোমতোই সামলাতে পেরেছে। ইউরোপীয়রা খুব বেশি ম্যাচ খেলছে, এই অজুহাত ধোপে টেকে না। আবহাওয়ার সঙ্গে ধাতস্থ হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় তো তারা পেয়েছে। প্রত্যেক খেলোয়াড়কে নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে, সে ফিট কি না। বাড়তি দৌড়ানোর মতো ফিটনেস আছে কিনা। আমি নিশ্চিত, দিন শেষে ইচ্ছাশক্তিই শেষ কথা।
তার পরও যে আমি মনে করি সবকিছুই দেখে ফেলেছি, সেই আমিও চমকে যাই। লুইস সুয়ারেজ যেভাবে ইতালির জর্জো কিয়েলিনিকে ভয়ংকরভাবে কামড়ে দিল, সেটা কখনো দেখিনি। তিনবার রিপ্লে দেখে আমাকে এটি বিশ্বাস করতে হয়েছে। সুয়ারেজের নিষেধাজ্ঞা যথার্থ। ওর জন্য আরও খারাপ হচ্ছে, অ্যাডিডাস ওর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে। আমার বিশ্বাস, রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা ওকে প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাপারে নতুন করে ভাববে।