চাপ যত বেশি মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে তত হাসি
>পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে সবচেয়ে কম আলো যদি কারও ওপর পড়ে, সেটি মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু আইসিসি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল তাঁর ব্যাটই। পাদপ্রদীপের একটু আড়ালে থাকা সেই মাহমুদউল্লাহকে দেখেছেন রানা আব্বাস
বিনয়ের সঙ্গে, মিষ্টি হেসে তিনি এমনভাবে ‘না’ করে দেবেন, দ্বিতীয়বার আর তাঁকে একই অনুরোধ করা যায় না। নিজের চাওয়া পূরণ না হওয়ায় আবার তাঁর ওপর মন খারাপও হয় না। আয়ারল্যান্ড সফরের আগে কম-বেশি সব খেলোয়াড়ই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথা বলে গেছেন, এক মাহমুদউল্লাহ ছাড়া। মুখে কুলুপ এঁটে থাকা সাকিব আল হাসান পর্যন্ত উড়ান ধরার আগে বিমানবন্দরে ‘দুটি’ কথা বলে গেছেন। মাহমুদউল্লাহ সেটিও বলেননি।
আয়ারল্যান্ড সফরের আগে মিরপুরে এক দিন অনুশীলন শেষে বারবার অনুরোধ করা হলে মিষ্টি হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে দেন মাহমুদউল্লাহ, ‘এখন কোনো কথা বলব না।’ তাহলে কখন বলবেন? ‘ভালো খেললে বলব’, এ কথার ওপর কিছু বলার না থাকলেও ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় কথা তিনি বলবেন, এই আশা করাই যায়। মঞ্চ যত বড়, চাপ যত বেশি, তাঁর ব্যাটে যে তত বেশি হাসি!
আইসিসি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মাহমুদউল্লাহর সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি (৩টি) এ কারণেই। ক্যারিয়ারের বড় অংশজুড়ে থেকেছেন পার্শ্বচরিত্র হয়ে। কিন্তু তিনিও যে নায়ক হতে পারেন, সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিতে পারেন, সেটি প্রমাণ করেছেন ২০১৫ বিশ্বকাপে টানা দুই সেঞ্চুরি করে। বিশেষ করে অ্যাডিলেডে স্বপ্নপূরণের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরি আড়াল থেকে তাঁকে টেনে এনেছে পাদপ্রদীপের আলোয়।
ওয়ানডেতে তাঁর তিনটি সেঞ্চুরিই আইসিসি টুর্নামেন্টে। ২০১৫ বিশ্বকাপের দুই সেঞ্চুরির মতো ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেঞ্চুরিটাও একই রকম দুর্দান্ত। বছর দুয়েক আগে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের এক দশক পূর্তিতে প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রতিকূল কন্ডিশন, বড় মঞ্চ আর চাপে দুর্দান্ত খেলার রহস্য কিছুটা উন্মোচন করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ, ‘কোনো লক্ষ্য ঠিক করে খেলি না। সব সময়ই চেষ্টা করি। আল্লাহ হয়তো আমাকে একটু বেশি রহমত করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি ভাগ্যে ও ধর্মে বিশ্বাসী।’
২০১৫ বিশ্বকাপের আগে তামিম ইকবাল বলেছিলেন, তাঁর একটা স্বপ্ন হচ্ছে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিটা করবেন। স্বপ্নটা তাঁর পূরণ হতে হতেও হয়নি। নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আউট হয়েছিলেন ৯৫ রান করে। নিয়তি বোধ হয় ঠিক করে রেখেছিল, মাহমুদউল্লাহকে দিয়েই ভাঙা হবে এ অচলায়তন। তাঁর নিজের অবশ্য কল্পনাতেও ছিল না ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিটা তিনিই করবেন, ‘আমি নিজেও চিন্তা করিনি। তবে স্বপ্নটা তো ছিলই। আগে সাত নম্বরে ব্যাটিং করতাম। বিশ্বকাপে সুযোগটা পাওয়ায় (ওপরে ব্যাটিং) বিশ্বাস ছিল, যেহেতু চারে ব্যাটিং করছি লম্বা ইনিংস খেলার সুযোগ আছে। এখানে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের (বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ) ভূমিকা আছে।’
২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে গিয়েছিলেন বিষম চাপ নিয়ে। টুর্নামেন্টের আগে শ্রীলঙ্কা সফরে তাঁকে নিয়ে যে নাটকটা মঞ্চস্থ করে টিম ম্যানেজমেন্ট, বিশেষ করে হাথুরুসিংহে, সেটি শুধু আত্মবিশ্বাসে বড় ধাক্কা নয়, একজন সিনিয়র খেলোয়াড়ের জন্য ছিল চরম অমর্যাদারও। ২০১৭ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কা সফরে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে যদি ন্যূনতম সংশয় তৈরি হয়, সেটির উত্তর তিনি দিয়েছিলেন কয়েক মাস পরে কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করে। ২৬৬ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ৩৩ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর সাকিব আর মাহমুদউল্লাহর জোড়া সেঞ্চুরি বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো তুলে দিয়েছিল কোনো টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে।
আরও একটি বিশ্বকাপ যখন দুয়ারে, মাহমুদউল্লাহর দিকে আশাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। মিডল অর্ডারে দলের অন্যতম নির্ভরতা তিনি। বিশ্বকাপের আগে তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল একটাই, কাঁধের চোটের কারণে বোলিং করতে না পারা। কোচ স্টিভ রোডস অবশ্য আশাবাদ জানিয়ে গেছেন নিয়মিতই। ২০১৯ বিশ্বকাপ শুরু হতে হতে কাঁধের সমস্যাটা আর থাকবে না। তিনি খুব করে চাইছেন মাহমুদউল্লাহর বোলিংটা। যদি বোলিং না–ও করতে পারেন, তাঁর চওড়া ব্যাট তো আছেই। ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবে তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটিং যে ভীষণ জরুরি।
বাংলাদেশের পাঁচ সিনিয়র খেলোয়াড় শেষবারের মতো একসঙ্গে খেলতে যাচ্ছেন বিশ্বকাপ। এক যুগের বেশি সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন এই পাঁচ তারকা। শুধু মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহই নন, দলের বেশির ভাগ সদস্যই ওয়ানডেতে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। এই অভিজ্ঞতার ফল কি এবার মিলবে? কয়েক মাস আগে প্রশ্নটা করা হয়েছিল মাহমুদউল্লাহকে। সরাসরি উত্তর না দিলেও তাঁর কথায় প্রচ্ছন্নভাবে সেটি ছিলই, ‘বিশ্বাসটা আমাদের আছে, আমরা বড় কোনো টুর্নামেন্ট জিততে পারব। এর আগে আমরা চার-পাঁচটা ফাইনাল খেললাম। ফাইনালে শেষ যে বাধাটা, সেটা আমরা পার হতে পারছি না। এটা নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। কোন জায়গায় আমাদের ঘাটতি আছে, এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। সামনে যদি এ ধরনের সুযোগ আসে, বলব যে আমি অন্তত এ সুযোগ হারাতে চাই না।’
আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনালের ‘গেরো’ কাটিয়েছে বাংলাদেশ। তবে বিশ্বকাপ ফাইনাল তো অনেক দূরের পথ। এর আগের পথটুকু পাড়ি দিতে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে বড় কিছু লাগবে। আইসিসি টুর্নামেন্টের সঙ্গে তাঁর যে মিতালি, তাতে সেই আশা পূরণ না হলে সেটিই হবে অবাক করার মতো।