দুই সপ্তাহ আগে আমি একটা প্রচারণায় ইতালি গিয়েছিলাম এবং বিশ্বকাপে নিজেদের দলের সম্ভাবনা নিয়ে ওদের হতাশা দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ইতালিকে নিয়ে যখন প্রত্যাশার বাড়াবাড়ি থাকে না, তখনই ওরা সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের জন্ম দেয়। এটা তো অন্য অনেকের মতো আমারও জানা।
আমি কখনোই আশা করিনি যে ইতালি টানা দ্বিতীয়বারের মতো গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেবে। কিন্তু সেটাই হয়েছে। অথচ ইংল্যান্ডকে প্রথম ম্যাচে হারানোর পর তাদের শেষ ষোলোতে খেলার সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল ছিল। পরের ম্যাচে কোস্টারিকার কাছে হারটা ওদের জন্য একটা বিশাল ধাক্কা হয়েই এসেছে।
কোস্টারিকা প্রতিটি প্রতিপক্ষকেই ভীষণ চমকে দিয়েছে। অথচ কঠিন ‘ডি’ গ্রুপে বাকি সবার কাছে নিষ্পেষিত হওয়াই ছিল ওদের নিয়তি। কিন্তু বাইরে বসে বোদ্ধা কিংবা দর্শক হয়ে কিছু অনুমান করা আর মাঠে কোচ কিংবা খেলোয়াড় হয়ে থাকার মধ্যে অনেক তফাত। আমার মনে হয়, উরুগুয়ে, ইতালি ও ইংল্যান্ড প্রতিপক্ষ হিসেবে কোস্টারিকাকে হালকাভাবে নিয়েছে। ইংল্যান্ডের জন্য অবশ্য কোস্টারিকার ম্যাচটা ছিল শুধুই নিয়মরক্ষার, এর চার দিন আগেই তো তারা বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছে।
প্রথম ম্যাচেই কোস্টারিকার কাছে ৩-১ গোলে হারটাই ছিল উরুগুয়ের জন্য সতর্কবার্তা। বাজে প্রথমার্ধের পর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তারা ম্যাচে। তবে আমার কাছে কোস্টারিকার কাছে ইতালির হারটাই বেশি জঘন্য মনে হয়েছে। ওই ম্যাচেই প্রমাণিত হয়েছে, মাঠে ইতালি কেমন ছন্নছাড়া হয়ে যেতে পারে। সিজার প্রানদেল্লির কৌশলও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মাঝমাঠে থিয়াগো মোত্তা, মার্কিসিও আর ডি রসিকে নিয়ে শুরু করাটা আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। তার মানে, বালোতেল্লির দিকে বল বাড়ানোর কাজটা শুধু পিরলো করবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটা কাজে লেগেছে বলে প্রতিদিনই লাগবে এমন তো কথা নেই। এর চেয়েও খারাপ হয়েছে যখন প্রানদেল্লি চার ফরোয়ার্ডকে মাঠে নামালেন একসঙ্গে। মনে হচ্ছিল, যেন ওরা একজন আরেকজনের সঙ্গে হোঁচট খাচ্ছে। এই ইতালি উরুগুয়ের সঙ্গে ভুগবে, এটা জানাই ছিল। যদিও উরুগুয়ের রণকৌশল আন্দাজ করাটা আরও সহজ। ওদের দলে সবাই চেষ্টা করে সুয়ারেজকে বল দিতে।
উরুগুয়ের উদাহরণ দিয়ে আমি ইতালি আর ইংল্যান্ডের কিছু সমস্যা তুলে ধরতে চাই। দুটি দলেরই বিশ্বকাপ-পরবর্তী দল পুনর্গঠন নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ইতালির। পিরলোরা চলে যাওয়ার পর সেই জায়গা কারা নেবে, এটা নিয়ে ভাবার বোধ হয় এখনই সময়। ইংল্যান্ড ড্যানিয়েল স্টারিজ আর রাহিম স্টার্লিংয়ের মতো বেশ কিছু তরুণ ফুটবলার পেয়েছে। কিন্তু এসব তরুণের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে খুব বড় কোনো সাফল্য নেই। শুধু ২০০৭ অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোতে সেমিফাইনাল খেলা, এই তো! এ বিষয়ে ইতালিও লক্ষ্যহীন। তরুণ প্রতিভা খুঁজে বের করাটা তাদেরও বড় সমস্যা। যদিও ইতালিয়ান লিগে প্রিমিয়ার লিগের মতো বিদেশিদের দাপট নেই। তবে এ দুটি দেশই বিদেশি ফুটবলারদের গড়ে ওঠার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। যে ফুটবলাররাই এখন তাদের ভোগাচ্ছে। যেমন সুয়ারেজ অথবা বেলজিয়ামের এই সোনালি প্রজন্ম। এদের অনেকেরই বেড়ে ওঠা ইতালিতে কিংবা প্রিমিয়ার লিগে হয়েছে। ইতালি আর ইংল্যান্ডের উচিত নিজেদের দেশের খেলোয়াড়দের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া।
স্টিভেন জেরার্ডের বিকল্প কে হবেন কিংবা রুনি আসলে কোথায় খেলবে এ নিয়ে ইংল্যান্ডকে এখনই ভাবতে হবে। ওদের বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়ে খুব বেশি কিছু বলতে চাই না। এই গ্রুপটাই আসলে অনেক কঠিন ছিল। দুটি ম্যাচেই ইংল্যান্ড অনেক সুযোগ নষ্ট করেছে এবং তারা কিছুটা দুর্ভাগাও ছিল।
পুনর্গঠন দুটি দলের জন্যই জরুরি। তবে এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ইতালির চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে। বালোতেল্লি সহজাত প্রতিভা। কিন্তু ইতালি আক্রমণভাগের কেন্দ্রবিন্দু সব সময় সে হতে পারে না। কারণ, বল ধরে খেলা কিংবা অন্যদের জন্য জায়গা তৈরি করার গুণটা নেই ওর মধ্যে। ওদের এমন একজন ফরোয়ার্ড দরকার যে শুধু পিরলো ম্যাজিক পাসের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বল বানিয়ে নিতে পারবে। বিশ্বকাপ থেকে এই বিদায় ইতালিকে একটা বড় ধাক্কা দেবে সন্দেহ নেই। ওরা সেখান থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, সেটাই দেখার। পেছনে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। একই কথা প্রযোজ্য ইংল্যান্ডের বেলায়ও। সেখানকার ক্লাবগুলো জাতীয় দল নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে না।
কোস্টারিকা দারুণ সাহসী খেলেই পরের রাউন্ডে উঠেছে এবং গ্রিসের বিপক্ষেও ওরা বেশ আত্মবিশ্বাসী থাকবে। তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। রক্ষণ শক্তিশালী এমন প্রতিপক্ষকেও যে ওরা নিজেদের দিনে হারাতে পারে, সেটা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে। উরুগুয়ে অন্তত আরও একটি রাউন্ডের জন্য টিকে গেছে। তবে ইতালির বিপক্ষে লজ্জাজনক ওই ঘটনার পর তারা পরের ম্যাচে সুয়ারেজকে পাবে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্ট। সে কারণেই কলম্বিয়ার বিপক্ষে ওদের ভুগতে হতে পারে।
দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দলগুলোর মতোই কলম্বিয়াও এই বিশ্বকাপে চেনা পরিবেশের সর্বোচ্চ সুবিধা নিচ্ছে। রাদামেল ফ্যালকাওকে না পাওয়া ওদের জন্য বিশাল ধাক্কা হতে পারত। কিন্তু দল হিসেবে খেলে ওরা দারুণভাবে সেটা সামাল দিয়েছে। উন্মুক্ত একটা গ্রুপ পাওয়ায় তাদের জন্য সুবিধাই হয়েছে। তবে উরুগুয়ে যদি ওদের বিপক্ষে আগে গোল করে দেয়, তখন ম্যাচটা রোমাঞ্চকর হতে পারে।
দ্বিতীয় রাউন্ডে আরও একটা দক্ষিণ আমেরিকান দ্বৈরথ হবে ব্রাজিল ও চিলির মধ্যে। ক্যামেরুনের বিপক্ষে ব্রাজিল সবচেয়ে সুন্দর খেলা উপহার দিয়েছে, এটা বলা যাবে না। কিন্তু ব্রাজিল বুঝিয়েছে তারা কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। লড়ার অদম্য স্পৃহা ওদের। প্রত্যাশা পূরণ করে যাচ্ছে নেইমার। ফার্নান্দিনহো যোগ হওয়ায় ওদের মাঝমাঠের বৈচিত্র্য আর প্রাণশক্তি দুটোই বেড়েছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে চিলি খুবই ভয়ংকর হবে। আমার মনে হয়, হল্যান্ডের বিপক্ষে ওরা যতটা আক্রমণাত্মক ছিল, ব্রাজিলের বিপক্ষে এতটা আক্রমণাত্মক খেলবে না। সে কারণেই দুই দলের এই লড়াইটা দারুণ উপভোগ্য হতে পারে।