কী হচ্ছে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব ইয়র্কশায়ারে?
‘ইংল্যান্ড দল ততটাই ভালো, যতটা ভালো ইয়র্কশায়ার’, ইংলিশ ক্রিকেটে ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের ‘ভূমিকা’ বোঝাতে এটাই বলা হতো। তবে ইংল্যান্ডের এ ক্লাবটি এখন আলোচনায় ভিন্ন এক কারণে। বর্ণবাদ বিতর্কে বড় এক ঝড়ই বয়ে যাচ্ছে ইয়র্কশায়ারে।
ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দল ও ইয়র্কশায়ারের সাবেক অধিনায়ক আজিম রফিকের আনা বর্ণবাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) এবং ইয়র্কশায়ার। পদত্যাগ করেছেন ক্লাবটির চেয়ারম্যান, এর আগেই ইয়র্কশায়ারের মাঠ হেডিংলিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসিবি। ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পৃষ্ঠপোষকেরাও। ব্রিটিশ সরকারও ঢুকে পড়েছে ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে। বর্ণবাদবিরোধী একটি সরকারি কমিটিতে ডাক পড়েছে আজিম রফিকের।
রফিকের অভিযোগের তালিকায় এসেছে সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভনের নাম। এরই মধ্যে রফিকের উদ্দেশে একটা বর্ণবাদী গালি দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেছেন ইয়র্কশায়ার ও ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান গ্যারি ব্যালান্স, যদিও সেটিকে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ মজা’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন তিনি।
কী অভিযোগ করেছিলেন রফিক?
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস’ আন্দোলন নতুন করে সামনে আসে। এর পরপরই ইয়র্কশায়ারে বর্ণবাদের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন রফিক। ইএসপিএনক্রিকইনফোর এক প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, বর্ণবাদের শিকার হয়ে একসময় আত্মহত্যার কথাও নাকি চিন্তা করেছিলেন তিনি। এমনিতে রফিকের জন্ম পাকিস্তানে। ২০০১ সাল থেকে ইংল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন তিনি। এরপর ইংল্যান্ড ও ইয়র্কশায়ারের বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন, নেতৃত্বও দিয়েছেন। ২০১৮ সালের পর থেকে অবশ্য পেশাদার ক্রিকেট খেলেননি বর্তমানে ৩০ বছর বয়সী এ ক্রিকেটার।
ব্যাপারটি নিয়ে ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও করেছিলেন রফিক। ‘প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ’ ও ‘বর্ণবাদভিত্তিক’ গালির শিকার হওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি।
অনড় অবস্থানে ইয়র্কশায়ার
ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে রফিকের আনুষ্ঠানিক অভিযোগের শুরুতে একটা নিরপেক্ষ কমিটির অধীনে চলছিল তাঁর অভিযোগের তদন্ত। তবে সে কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরই শুরু হয় বিপত্তি। ইয়র্কশায়ার বলেছিল, ‘অগ্রহণযোগ্য আচরণের শিকার’ হয়েছেন রফিক। এ জন্য রফিকের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল তারা। রফিককে হুমকি দেওয়া হয়েছে বা এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে হুমকিদাতাকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করার কথাও বলেছিল ইয়র্কশায়ার। তবে পুরো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তারা। ইসিবির পর ব্রিটিশ সংসদেও পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বলেছিল ক্লাবটিকে।
এরপর প্রতিবেদনটির সারাংশ প্রকাশ করে ইয়র্কশায়ার। তাতে বলা হয়, রফিকের আনা ৪৩টি অভিযোগের ৭টির সত্যতা মিলেছে। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা–সংক্রান্ত আইনের স্বার্থে পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। তবে ইয়র্কশায়ার সে সারাংশ প্রকাশ করেছিল, ভারত–ইংল্যান্ড সিরিজে ম্যানচেস্টার টেস্ট বাতিল হওয়ার ডামাডোলের মধ্যে।
রফিককেও তখনো পুরো প্রতিবেদন পাঠায়নি ইয়র্কশায়ার। গত মাসে ইসিবি জানিয়েছিল, তারাও অপেক্ষা করছে এ প্রতিবেদনের।
‘নির্লিপ্ত’ ইয়র্কশায়ার
গত ২৮ অক্টোবর ইয়র্কশায়ার জানায়, তারা এ ব্যাপারে নিজস্ব তদন্ত চালিয়েছে। তবে তারা জানিয়ে দেয়, ‘কোনো কর্মকর্তা, খেলোয়াড় বা নির্বাহীর বিপক্ষে কোনোরকমের পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।’ এরপরই ব্রিটিশ সরকারের ‘ডিজিটাল, সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও ক্রীড়া’ বিষয়ক কমিটি ডেকে পাঠায় ক্লাবটির চেয়ারম্যান রজার হাটনকে। এরপর ক্রিকইনফো জানায়, রফিককে উদ্দেশ করে দেওয়া এক গালিকে ‘বন্ধুত্বসুলভ মজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইয়র্কশায়ারের প্রতিবেদনে।
কোণঠাসা ইয়র্কশায়ার
সরকারের সে কমিটি শুনানির দিন ধার্য করেছে ১৬ নভেম্বর। এর আগেই ঝড়ের কবলে পড়েছে ইংল্যান্ডের অন্যতম পুরোনো কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবটি। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষকগুলোর মধ্যে এমারল্যান্ড পাবলিশিং, ইয়র্কশায়ার টি ও নাইকি নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে এরই মধ্যে।
এরপরই এক বিবৃতিতে নিজেদের অবস্থান ও গৃহীত পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে ইসিবি। আজিম রফিকের অভিযোগের ভিত্তিতে নিজেদের তদন্তের কথা জানিয়েছে তারা। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগপর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেটের বড় ম্যাচ আয়োজন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইয়র্কশায়ার ও এর মাঠ হেডিংলিকে।
ইসিবির বিবৃতির পর রফিক টুইটে বলেছেন, ‘ইসিবির বিবৃতি নজরে এসেছে আমার। আমার একটু সময় দরকার তারা কী বলেছে ও কোন পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা বোঝার জন্য। আপাতত এ ব্যাপারে আর কোনো মন্তব্য করব না আমি।’
অভিযোগের তির ব্যালান্স ও ভনের দিকে
রফিককে বর্ণবাদমূলক গালি দিয়েছিলেন তাঁর সাবেক সতীর্থ গ্যারি ব্যালান্স, অভিযোগ ছিল এমন। এরপর মুখ খুলেছেন ব্যালান্স। এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, কম বয়সে কিছু শব্দ ব্যবহার করার জন্য তিনি দুঃখিত। তবে রফিককে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবেই সেসব শব্দ ব্যবহার করেছিলেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
অবশ্য ব্যালান্সকে আপাতত ইংল্যান্ড জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা না করার ঘোষণা দিয়েছে ইসিবি। যদিও ২০১৭ সালের পর থেকে জাতীয় দলে খেলেননি এ ব্যাটসম্যান।
অভিযোগ আছে সাবেক অধিনায়ক ভনের বিরুদ্ধেও। রফিকের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ান সম্প্রদায় থেকে সে সময় ইয়র্কশায়ারের খেলতেন আদিল রশিদ, আজমল শেহজাদ ও পাকিস্তানের সাবেক পেসার রানা নাভেদ-উল-হাসান। অভিযোগ আছে, তাঁদের উদ্দেশ করে ভন বলেছিলেন, ‘তোমাদের সংখ্যা বেশি হয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে কিছু করা দরকার।’
অবশ্য দ্য টেলিগ্রাফে লেখা এক কলামে ভন বলেছেন, রফিকের প্রতিবেদনে তাঁর নাম থাকলেও কোনো রকমের বর্ণবাদের সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে ওই ধরনের কোনো কিছুই তিনি বলেননি।
সরে দাঁড়ালেন ইয়র্কশায়ার চেয়ারম্যান
এদিকে আজ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ইয়র্কশায়ার চেয়ারম্যান হাটন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘এ সুযোগে আমি প্রকাশ্যে আজিমের কাছে ক্ষমা চাই। বোর্ডের নির্বাহী সদস্যদের এ পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে ও সহানুভূতি প্রকাশে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছি বলে আমরা দুঃখিত। আমি এটা পরিষ্কার করতে চাই, আজিম রফিকের অভিযোগ সম্পর্কে জানার পরই আমি ইসিবির সহায়তা চেয়েছিলাম। একটা তদন্তের জন্য তাদের হস্তক্ষেপও কামনা করেছি। তখন তারা সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ব্যাপারটিতে আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল খেলার স্বার্থের এ ব্যাপারে ইসিবির তদন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পুরো খেলার জন্যই এ ব্যাপারটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।’
কী বলছেন ইংল্যান্ড ক্রিকেটাররা?
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ডের টি–টোয়েন্টি দল এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। টেস্ট দল অ্যাশেজ খেলতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। তবে রফিকের ঘটনা ছুঁয়ে গেছে তাঁদেরকেও।
ইংল্যান্ডের সীমিত ওভারের অধিনায়ক এউইন মরগান ইসিবির তদন্তের ঘোষণা ও গৃহীত পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘দলের দিক থেকে তাকালে আমরা “রোল-মডেল” হিসেবে ঠিক কাজটাই করতে পারি শুধু। এই তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের অংশ হয়ে আমাদের মনে হচ্ছে, এটা আরও বড় কিছুর দিকে নিয়ে যাবে। আমাদের ক্যারিয়ার বা আমাদের জেতা যেকোনো শিরোপার চেয়ে বড় হবে এটা। এ মুহূর্তে যা করছি, সেটা অবশ্যই “পারফেক্ট” নয়, তবে আমরা যে পরিবর্তন চাই, সেটার পথে এগিয়ে নেবে এটা।’