কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে এল যে ৫ উইকেট
গত মার্চের কথা। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশ দল দেশে ফিরেছে মাত্র দুই দিন হলো। দেশে এসেই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দল গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন খালেদ আহমেদ, ম্যাচও খেলবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ডারবান ও পোর্ট এলিজাবেথে ৮ উইকেট নিয়ে খালেদই ছিলেন ওই সফরে বাংলাদেশের সেরা পেসার। দারুণ বোলিং ফর্মটা গাজী গ্রুপের হয়েও কাজে লাগাতে চাইছিলেন বলেই এত তাড়াহুড়ো তাঁর।
প্রিমিয়ার লিগে গাজী গ্রুপের কোনো এক ম্যাচের দিন সকালে বিকেএসপিতে খালেদের সঙ্গে দেখা। হাতে সাদা বল, চোখে রোদচশমা। উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরোনো বলটা ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বিভিন্ন ধরনের সিমে ধরছিলেন নিজের অজান্তেই। বলছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর ৮ উইকেটের গল্প, কাকে কীভাবে আউট করেছেন, কার জন্য কী পরিকল্পনা ছিল—এসব কৌশলগত আলাপ।
কদিন পরই ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কা সিরিজ। সেই ভাবনাও যে খেলা করছিল খালেদের মাথায়, বোঝা গেল সহজেই। প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়ক দিমুথ করুনারত্নেকে কীভাবে আউট করবেন, সে পরিকল্পনা করা, ছক কষা শুরু তখন থেকেই। যেমনটি তিনি করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে। প্রতিপক্ষ দলের মূল ব্যাটসম্যান ও অধিনায়ক ডিন এলগারের উইকেট নেওয়া ছিল তখন খালেদের লক্ষ্য। ওই সিরিজে এলগারকে দুবার আউট করে সে লক্ষ্যে সফলও হয়েছিলেন।
শ্রীলঙ্কা সিরিজে হয়তো সেটি কাজে লাগেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ঠিকই কাজে লেগেছে। অ্যান্টিগা টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫ উইকেট, সেন্ট লুসিয়ায় টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট—খালেদের ম্যাচপূর্ব পরিকল্পনা যে মাঠের পারফরম্যান্সে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেটিরই প্রমাণ এটি।
খালেদের এই প্রক্রিয়াকে ক্রিকেটের ভাষায় বলে ‘ভিজ্যুয়ালাইজেশন’। বোলারদের জন্য বিষয়টি নতুন নয়। এই যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার আগে খালেদ কল্পনায় বারবার এলগারকে আউট করার দৃশ্য চিত্রায়ণ করেছেন। ২২ গজে এসে সেটি যখন বাস্তবায়ন করছিলেন, তখন হয়তো খালেদের মনে হচ্ছিল, ‘আরে, এ আর নতুন কী, এমন কিছুই তো আমি কল্পনা করেছিলাম!’
অথচ ছোট টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে খালেদের চিন্তাভাবনা এত পরিচ্ছন্ন ছিল না। বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে কোন বলটি করবেন, কোনটি করবেন না, তা নিয়ে দোটানায় থাকতেন। কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়ে সেটি ঠিক করেছেন। সেদিন বিকেএসপিতে তিনি বলছিলেন, ‘আমি আগে বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে কনফিউজড থাকতাম বেশির ভাগ সময়। এক বল করার আগে অনেক কিছু ভাবতাম। এরপর বল হতো এলোমেলো। এখন আগের মতো কনফিউজড নই। আমি জানি কোন বল করব। শেষ পর্যন্ত সেটা এমনিতেই হয়ে যায়।’
সেই খালেদের শ্রীলঙ্কা সিরিজটা কেটেছিল কল্পনাতীত। তাঁর ভাষায়, ‘এমন বাজে সিরিজ যাবে কল্পনাও করিনি।’ দল ১-০ ব্যবধানে হেরেছে, সেই হিসাবে সিরিজটি দলগতভাবেও বাজেই কেটেছে। খালেদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের বিচারেও সিরিজটি স্মরণীয় কিছু ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন বলে ভালো করে এসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে প্রথম ইনিংসে ১৬ ওভার বল করে ৬৬ রান দিয়ে থেকেছেন উইকেটশূন্য। প্রতি ওভারে চারের ওপর রান দিয়ে উল্টো দলের ‘ক্ষতি’ই ডেকে আনেন তিনি। পরের ইনিংসে ৭ ওভারে দেন ৩৭ রান, প্রতি ওভারে এবার পাঁচের বেশি! ঢাকা টেস্টে এসে কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু সেটিও আহামরি নয়—২৩ ওভারে ৮৫ রান দিয়ে থাকেন উইকেটশূন্য।
এমন পারফরম্যান্সের পর দলে জায়গা ধরে রাখা একটু কঠিনই। বিশেষ করে যখন টেস্ট দলের পেস বোলিংয়ে প্রতিযোগিতাটা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু তাসকিন আহমেদ ও শরীফুল ইসলামের চোটের কারণে খালেদ টিকে যান। অ্যান্টিগায় সুযোগটা কাজেও লাগান। প্রথম ইনিংসে তিনের কম ইকোনমি রেটে বল করে ২ উইকেট শিকার করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তো চোখের পলকে ৩ উইকেট নিয়ে মাত্র ৮৪ রানের পেছনে ছুটতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ে কাঁপুনি ধরান। বিশেষ কিছু আসছে, হয়তো সেটিরই ইঙ্গিত ছিল সেটি।
সেটি এলোও ঠিক পরের টেস্টে। নিজের অস্ত্রাগারের সব কটি হাতিয়ার কাজে লাগিয়ে তবেই সফল হলেন তিনি। ওবল বল, রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে অ্যাঙ্গেল, লেংথ থেকে বল ওঠানো, নাকল বল, কাটার—ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশি পেসার হিসেবে ৫ উইকেট পেতে যেন জাদুর বাক্স খুলে বসেছিলেন ২৯ বছর বয়সী এই পেসার।
কল্পনার পাখা মেলে উড়ে যাওয়ার স্বাধীনতাটা খালেদ পেয়েছেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের কাছ থেকে। আজ অধিনায়কের কাছে খালেদের আবদার ছিল, যতক্ষণ ইচ্ছা বোলিং করে যাবেন তিনি। সাকিব তাতে সাড়া দিয়েছেন। খালেদ নিজের মতো ফিল্ডিং সাজিয়েছেন, দেখিয়েছেন যা খুশি তা করার ঔদ্ধত্য। তৃতীয় দিনের শুরুতে সেন্ট লুসিয়ার ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের একটা প্রান্ত যেন নিজের করে নিয়েছিলেন। এক টানা ১০.৩ ওভার বোলিং করেছেন। এর মধ্যেই আগের দিনের ২ উইকেটের সঙ্গে যোগ করেছেন আরও ৩ উইকেট। প্রতিটিই যে খালেদের কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার এক একটি উদাহরণ!
খালেদও তৃতীয় দিনের খেলা শেষে বলছিলেন, ‘প্রতিটা উইকেটই আমাদের জন্য স্পেশাল ছিল। যেহেতু প্রথম বার পাঁচ উইকেট পেয়েছি। বিশেষ করে মায়ার্সের উইকেটটা ভালো লেগেছে বেশি। কারণ, তাঁকে আউট করার চেষ্টা করছিলাম গতকাল থেকেই। আজ তাঁকে আমি স্লোয়ার বলে পরাস্ত করি। নিজের কাছে ভালো লাগছে যে তাকে পরিকল্পনা করে আউট করতে পারছি।’
সেন্ট লুসিয়ার ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে দৃশ্যগুলো দেখছিলেন ইয়ান বিশপ। খালেদের ব্যাগভর্তি কৌশল দেখে বারবার তিনি অবাক হয়ে বলছিলেন, ‘এই বোলারের বোলিং পরিসংখ্যান এমন হয় কীভাবে?’ টেস্ট ক্রিকেটে খালেদের গড় ৪৯, স্ট্রাইক রেট ৮২। কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে সংখ্যাগুলোর মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না সাবেক এই ক্যারিবীয় পেসার। তাই সংখ্যার আরও গভীরে গিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলেন বিশপ।
সেটা পেয়েও গেলেন। দেশের বাইরে খালেদ ৫ টেস্ট খেলে ৩৩ গড়ে নিয়েছেন ১৮ উইকেট। দেশের বাইরে ম্যাচগুলোর ভেন্যু নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে। দেশে ৪ টেস্ট খেলে খালেদের শিকার মাত্র ১ উইকেট। দেশের বাইরে কন্ডিশন পক্ষে থাকলে সে-ই খালেদ যে হয়ে ওঠেন ভয়ংকর, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। খালেদও যেন বিদেশে গিয়েই সাহসী হয়ে ওঠেন!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে খালেদের এমন পারফরম্যান্সের মাহাত্ম্য বেড়ে যায় অন্য আরেকটি কারণে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই সিলেট অঞ্চল লড়ছে বন্যার সঙ্গে। খালেদের পরিবারকেও ভুগতে হচ্ছে তাতে। সিলেটে খালেদের বাড়ির বারান্দায় বন্যার পানি উঠেছে। অ্যান্টিগা টেস্টের সময় তো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন ছিল বিদ্যুৎ না থাকায়। অন্যদিকে খালেদের বাবা আবার কিডনির রোগে ভুগছেন, নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। এসব দুশ্চিন্তা নিয়েই খেলেছেন খালেদ। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো আর ফুলশয্যা নয়, শীর্ষ পর্যায়ে খেলে যেতে হলে অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। নিজের ভাবনাটাকে সে জন্য তৈরিও করে রেখেছেন খালেদ।