২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

করোনাকালের অন্য হিসাব

করোনাভাইরাস কি কারও উপকার করল?

নির্দয় রসিকতা হয়ে গেল বোধ হয় একটু। যে মহামারিতে দুনিয়া থেকে প্রায় ১২ লাখ মানুষ নেই হয়ে গেল, অর্থনৈতিক মন্দা জেঁকে বসল পৃথিবীতে, বেকারত্ব-দারিদ্র্য-ক্ষুধা বেড়ে গেল, সেটি আবার কারও উপকার করে কীভাবে!

একটু উল্টোভাবে ভাবুন তো। গত মার্চ-এপ্রিলে মাথার ওপর যে আকাশটি আপনি দেখেছেন, সেটি অত বেশি নীল এর আগে কবে ছিল? বিশ্বের দূষিত নগরের তালিকায় থাকা শহরগুলোতেও যে মানুষ বুক ভরে শ্বাস নিতে পারল, কেন? রাস্তার ধারের গাছের সবুজ পাতায় গাড়ির ধোঁয়ার কালশিটে পড়েনি, সমুদ্রের পানি আরও নীল হয়েছে, ডলফিনগুলো বহু বছর পর মনের আনন্দে খেলেছে এবং এক বছরের বহিষ্কারাদেশের শাস্তি পেয়েও সাকিব আল হাসান হাতে গোনা কয়টা ম্যাচই মাত্র মিস করলেন; এসব কি এমনি এমনি! ‘করোনার আশীর্বাদ’ লিখে গুগলে সার্চ দিলেও কিন্তু এ রকম অনেক ইতিবাচক দিক বেরিয়ে আসে।

ভিন্নমত থাকতেই পারে। করোনায় প্রকৃতির সজীব হয়ে ওঠার সঙ্গে সাকিবের শাস্তিকে মেলানোটা অনেকের ভালো না–ও লাগতে পারে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা, প্রকৃতির মতো সাকিবও একদিক দিয়ে করোনার ‘আশীর্বাদ’ই পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) এক বছরের নিষেধাজ্ঞায় ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত সাকিবের অন্তত ১২টি টেস্ট, ৪টি ওয়ানডে ও ১৪টি টি-টোয়েন্টি মিস করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি মাঠে নেই বলেই যেন করোনাভাইরাস এসে সব খেলাধুলা বন্ধ করে দিল! যে সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ দলের অতগুলো ম্যাচ খেলার কথা, সে সময়ে খেলতে পারল কিনা মাত্র চারটি টেস্ট, তিনটি ওয়ানডে ও সাতটি টি-টোয়েন্টি! করোনা কি সাকিবের ফেরার জন্যই জমিয়ে রাখল বাকি খেলাগুলো?

সমস্যা হলো, করোনাকালের খেলা বলতে তো আর শুধু সাকিবকে বোঝায় না। শুধু বাংলাদেশের কথা ধরলেও জগৎটা অনেক বিশাল। গাঢ় নীল আকাশ আর ডলফিনের খেলা দেখে যেমন প্রিয়জন হারানোর শোক ভোলা যায় না, ক্ষুধার্ত পেটের আগুন নেভে না; করোনা সাকিবের কিছু উপকারে এলেও সেটি আসলে জগৎ-সংসারের জন্য কিছুই নয়। করোনাভাইরাস এই দেশের খেলা থেকেও কেড়েই নিয়েছে বেশি, দেয়নি কিছুই।

মহামারির প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্বের মতো মার্চের মাঝামাঝি বাংলাদেশেও সব খেলাধুলা বন্ধ হয়ে যায়। প্রিমিয়ার ক্রিকেট, ফুটবল বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাই, অন্য খেলাধুলা—কিছুই আর মাঠে থাকল না। পত্রিকার পাতায় বড় করে খবর এল, নিচের দিকের লিগে খেলা অনেক ক্রিকেটার খেলা ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। কেউ হয়েছেন বর্গাচাষি, কেউ ফেরিওয়ালা, একটু অবস্থাপন্নরা পারিবারিক ব্যবসায় মন দিয়েছেন।

ক্রিকেটে করোনার এই ধাক্কা সহজে সামলে ওঠার নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) খেলোয়াড় ও খেলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জৈব সুরক্ষাবলয়ে রেখে সীমিত পরিসরে খেলা শুরু করলেও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে কবে ক্রিকেট ফেরানো যাবে, সেটি বিসিবি কর্তাদেরও অজানা। মাঠে সীমিত পরিসরে ক্রিকেট নামিয়ে ফেসবুক, ইউটিউবে লাইভ করে বহির্বিশ্বকে হয়তো দেখানো যাবে বাংলাদেশে খেলা হচ্ছে; কিন্তু তৃণমূলের ক্রিকেটার যাঁরা, তাঁদের জীবিকা তো থেমেই আছে! দেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটারের স্বার্থে প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট, জাতীয় লিগ ও জেলার ক্রিকেট মাঠে গড়ানো দরকার। সাধারণ ক্রিকেটারদের এই প্রতিযোগিতাগুলো যত দিন না স্বাভাবিক অবস্থায় আসছে, তত দিন দেশের ক্রিকেটের অর্থনীতিও পূর্ণাঙ্গ চেহারায় ফিরবে না।

করোনায় ক্রিকেটারদের যেমন আয় নেই, আয় নেই ক্রিকেট বোর্ডেরও। দেশের ক্রিকেট চালানোর কাজটা বিসিবি সরকারি টাকায় করে না। করোনাকালে বরং দেখা গেছে অন্য খেলার অসচ্ছল ক্রীড়াবিদদের সাহায্য করতে বিসিবিই উল্টো সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিসিবির রাজস্ব আসে নির্দিষ্ট কিছু খাত থেকে। তার অন্যতম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) টাকা ও টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি। আইসিসির টাকাটা আসে আবার দুই ভাগে। একটি নির্দিষ্ট বছরে বাংলাদেশ দল আইসিসির যেসব ইভেন্টে (বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) অংশ নেয়, সেগুলোর অংশগ্রহণ ফি পায়। এ ছাড়া বিভিন্ন চুক্তি থেকে আইসিসির সারা বছর যে রাজস্ব আয় হয়, তার একটা ভাগ অন্যান্য বোর্ডের মতো পায় বিসিবিও। এশিয়া কাপের বছরগুলোতে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) কাছ থেকেও আসে অংশগ্রহণ ফির টাকা। বিসিবির অন্যান্য আয় বলতে বিভিন্ন (জাতীয়, নারী ও ‘এ’ দল) দলের স্পনসরশিপ বিক্রি, হোম সিরিজের টাইটেল স্পনসরশিপ বিক্রি, মাঠের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী বোর্ডের স্বত্ব বিক্রি এবং বিপিএল ও অন্যান্য ঘরোয়া ক্রিকেটের স্বত্ব বিক্রি থেকে আসা আয়।

করোনাকালে সব আয়ের পথই বন্ধ। আইসিসির নির্ধারিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এসিসির এশিয়া কাপ হয়নি। তার মানে এসবের অংশগ্রহণ ফি এবার পাবে না বিসিবি। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী চুক্তি থেকে আইসিসি ও এসিসির যে আয় হতো, সেটির ভাগও আসবে না। হোম সিরিজগুলো সব স্থগিত হয়ে গেছে। আগের টেলিভিশন স্বত্ব চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর করোনাজনিত অনিশ্চয়তায় নতুন চুক্তি এখনো হয়নি। স্থায়ী আমানতের সুদ ছাড়া ২০২০ সালে কোষাগারে তাই তেমন কিছুই পড়ার সম্ভাবনা নেই। উল্টো এই সময়ে বিসিবির কিছু বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। করোনাকালে ক্লাব ও ক্রীড়াঙ্গনের মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদান তার অন্যতম। জৈব সুরক্ষাবলয় তৈরি করে যেসব খেলার আয়োজন চলছে, সেখানেও দলগুলোকে লম্বা সময় পাঁচ তারকা হোটেলে রাখা বাবদ বড় একটা টাকা খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে বিসিবির স্বাস্থ্যবান কোষাগারও এখন পার করছে নিম্নচাপের প্রভাব।

করোনায় স্থগিত টুর্নামেন্টগুলো যখন আবার মাঠে নামবে, তখন অবশ্য এই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে আসার কথা। তবে সেটি নির্ভর করছে করোনা–পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পৃষ্ঠপোষকেরা আগের চুক্তি কতটা অনুসরণ করে তার ওপর।

ফুটবলের আয়ের খাত ক্রিকেটের মতো অত বেশি নয়। ফিফার কাছ থেকে বছরে ১০ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। সেটি এবারও পাচ্ছে। করোনাকালে ফিফার কাছ থেকে বাড়তি ১৫ লাখ ডলার অনুদান পাবে বাংলাদেশের ফুটবল। এর মধ্যে শুধু মেয়েদের ফুটবলের জন্য ৫ লাখ ডলার। এ ছাড়া এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) কাছ থেকে বাফুফে নিয়মিত যে ৫ লাখ ডলার পেয়ে আসছিল, করোনাকালে সেটিও বন্ধ হচ্ছে না। তবে খেলা না হওয়ার ক্ষতি তো আছেই। লিগ, ফেডারেশন কাপ মিলিয়ে বাফুফের ঘরোয়া ফুটবলের সব টুর্নামেন্টের স্বত্ব সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের। ৫ বছরের চুক্তিতে বছরে তাদের কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার করে পাওয়ার কথা বাফুফের। খেলা না হওয়ায় সে আয় এবার বন্ধ।

অন্য ছোটখাটো খেলার আয় মূলত খেলার পৃষ্ঠপোষকতা থেকেই আসে। কিন্তু এবার তো খেলাই হচ্ছে না! উল্টো সঞ্চয় থেকে অফিস খরচ চালাতে হচ্ছে অনেক ফেডারেশনকে। এশিয়ান হকি ফেডারেশন থেকে করোনা অনুদান হিসেবে দেশের হকির ১৫ হাজার ডলার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটিও নাকি আর পাওয়া যাচ্ছে না।

এ তো গেল দেশের খেলাধুলায় করোনাজনিত আর্থিক ক্ষতির কথা। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা অবশ্য মাঠেই হয়ে গেছে খেলাগুলোর। পুরো একটা বছর চলে যাচ্ছে প্রায় খেলা ছাড়া। সীমিত পরিসরে যেসব খেলা হচ্ছে, সেগুলো তো অনেকটা জোর করে খেলা চালু রাখার চেষ্টা! সেটি করতে গিয়ে খেলোয়াড়দের খেলায় করোনার প্রভাব সুস্পষ্ট। বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের দুরবস্থা তো সেই ছবিই তুলে ধরেছে।

গত মার্চ থেকে খেলোয়াড়েরা ছয়-সাত মাস খেলার বাইরে ছিলেন। ঘরে বসে থেকে থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে অনেকে মাঝপথে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুশীলন শুরু করেন। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের এই ব্যক্তিগত অনুশীলন দেশের খেলাধুলার আরেকটি দৈন্যই তুলে ধরেছে।

ঢাকা যেসব খেলোয়াড়ের স্থায়ী ঠিকানা নয়, তাঁরা অনেকেই লকডাউনের সময়টাতে যাঁর যাঁর বাড়ি গিয়ে থেকেছেন। অনুশীলন করার চেষ্টা করেছেন নিজ এলাকার মাঠে। কিন্তু ঢাকার বাইরে অনুশীলনের সে রকম ভালো সুযোগ-সুবিধা থাকলে তো!

বাংলাদেশে আর সবকিছুর মতো খেলাধুলাও ঢাকাকেন্দ্রিক। নিজ জেলা ফেনীতে অনুশীলন করতে গিয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাইফউদ্দিনকে নিজে রোলার চালিয়ে উইকেট বানাতে হয়েছে। যুব বিশ্বকাপজয়ী অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক আকবর আলী রংপুরের অনুশীলন–সুবিধা নিয়ে বলছিলেন, ‘আমাদের ওখানে ইনডোর নেই। বৃষ্টি হলে ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলন করা যায় না। বাইরে কংক্রিটের উইকেট আছে, সেখানে নেট লাগিয়ে যেটুকু করা যায়, সেটুকুই। মাঠের অবস্থাও অতটা ভালো থাকে না—বড় বড় ঘাস, একটু বৃষ্টিতে কাদা জমে যায়।’

যুবদলের আরেক ক্রিকেটার তামজীদ হাসানের বাড়ি বগুড়ায়। করোনার সময় বগুড়ার টেস্ট ভেন্যু শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতে গিয়ে পড়েছেন নানা বিড়ম্বনায়। তামজীদ সেদিন বলছিলেন, ‘আমাদের মাঠের অবস্থা খুবই খারাপ। এক দিন বৃষ্টি হলে ১০-১২ দিন কাদা থাকে। অনুশীলন করা যায় না, রানিং করা যায় না।’ বগুড়ায় ইনডোর অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকলেও সমস্যা আছে সেখানেও। বাতাস যাওয়া-আসার ব্যবস্থা নেই বলে প্রচণ্ড গরম সেখানে। তামজীদের অভিজ্ঞতা, ‘এর ভেতর ১০ মিনিটের বেশি থাকা কঠিন।’

বরিশালে ক্রিকেটার মুনির হোসেনের অভিজ্ঞতাও অভিন্ন, ‘বরিশালে তো কিছুই নেই! প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের অনুশীলন করার মতো কোনো ব্যবস্থাই নেই। বৃষ্টি হলে কিছু করার উপায় থাকে না। স্টেডিয়ামের সামনে বালুর একটা মাঠের মতো আছে, তখন সেখানে ফুটবল খেলি, রানিং করি।’ মুনির মজা করে বলছিলেন, ‘আমাদের অবস্থা পুরোনো দিনের কৃষকের মতো। আকাশ দেখে অনুশীলন করি।’

ভাগ্যদেবী সবার জীবনের সমীকরণই সাকিব আল হাসানের মতো মিলিয়ে দেবেন না। করোনা কী কেড়ে নিল আর কী দিল, সে হিসাব না করে তাই করোনার শিক্ষাটাই বেশি করে নেওয়া উচিত খেলাধুলায়।