করিম বেনজেমার মুখ ফুটে বলতে সময় লেগেছে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়েন ২০১৮ সালে। বেনজেমা মুখ খুলেছেন গত জানুয়ারিতে, 'রোনালদো রিয়ালে থাকতে বছরে ৫০ থেকে ৬০টি গোল করত। তাই বাস্তবতা বুঝে তাকে (খেলার) জায়গা দিতে আমাকে নিচে নামতে হয়। সে যাওয়ার পর গোল করা ও গোল করানোর পালা এখন আমার।'
কথাটাকে ঘুরিয়ে অন্যভাবেও ভেবে নেওয়া যায়, রিয়ালে রোনালদোর অতিমানবীয় সব সংখ্যায় ভুলে লোকে বেনজেমাকে সেভাবে পাত্তা দেয়নি। অথচ, গোল করায় দক্ষতাই তাঁকে চিনিয়েছে, কিন্তু রোনালদো থাকতে তাঁঁর দায়িত্বটা ছিল সহকারির, ব্যাটম্যানের যেমন রবিন। রিয়ালে সেই বেনজেমাই 'ব্যাটম্যান।'
গত ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলো প্রথম লেগে পিএসজির মাঠে ১-০ গোলে হেরে বিপদে পড়েছিল রিয়াল। মার্চে ফিরতি লেগে বেনজেমা করলেন হ্যাটট্রিক, গোথাম সিটির মতোই রক্ষা পায় রিয়াল। এরপর স্টামফোর্ড ব্রিজে কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগেও সেই একই বেনজেমাকে দেখা গেল।
রোনালদোর মতো নির্মম দক্ষতায় দুমড়ে-মুচড়ে দিলেন প্রতিপক্ষকে, টানা দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকের প্রথম দুটো গোলে বেনজেমার হেড করার দক্ষতা পর্তুগিজ তারকার চেয়ে কোনো অংশে কম না! শুধু কী তাই, চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদোর একটি রেকর্ডেও ভাগ বসিয়েছেন বেনজেমা।
চ্যাম্পিয়নস লিগে কোনো ম্যাচে হ্যাটট্রিক করাই যেখানে স্বপ্নের মতো, সেখানে টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিকের মহিমা অন্য কিছু। রোনালদো, লিওনেল মেসি ও লুইজ আদ্রিয়ানোর পর চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে টানা দুই হ্যাটট্রিকের কীর্তি এখন বেনজেমারও। কিন্তু এই চারজনের মধ্যে রোনালদো ও বেনজেমা একটি জায়গায় আলাদা।
না, টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিকের শেষ দুটি নজির এ দুজনের, সেজন্য নয়। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ার্টার ফাইনাল (ফিরতি লেগ) ও সেমিফাইনালে (প্রথম লেগ) হ্যাটট্রিক করেন রোনালদো। বেনজেমার আগে সেটাই সর্বশেষ নজির।
আলাদা জায়গাটা হলো, চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা দুটি নকআউট পর্বের ম্যাচে হ্যাটট্রিক নেই মেসি ও লুইজ আদ্রিয়ানোর। এই কীর্তি ছিল শুধু রোনালদোর একার, এখন বেনজেমারও। ব্যক্তিগত এই কীর্তির চেয়েও বড় কথা, দলের মধ্যে বেনজেমা একটা বিশ্বাসের জন্ম দিতে পেরেছেন, শিরোপা জেতার মতো রসদ আছে!
আর সে রসদ যোগানোর দায়িত্ব বেনজেমা কতটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, প্রমাণ দিচ্ছে পরিসংখ্যান।
৩৪ বছর বয়সে এসে বেনজেমা ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম কাটাচ্ছেন। ৩৬ ম্যাচে ৩৭ গোল। এর আগে কোনো মৌসুমেই ফরাসি ফরোয়ার্ডকে এতটা ক্ষুরধার দেখা যায়নি। গোলসংখ্যায় তো নয়-ই। ইএসপিএন তাই টুইট করেছে, 'করিম বেনজেমার এ মৌসুমে ব্যালন ডি'অর প্রাপ্য।'
চ্যাম্পিয়নস লিগে ফ্রান্সের হয়েও এ মৌসুমে ইতিহাস গড়েছেন বেনজেমা। প্রথম ফরাসি খেলোয়াড় হিসেবে ন্যূনতম ১০ গোল করেছেন এক মৌসুমে। চ্যাম্পিয়নস লিগের আগের সংস্করণ ইউরোপিয়ান কাপ বিবেচনায় নিলে ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বশেষ এ নজির গড়েছেন কিংবদন্তি স্ট্রাইকার জাস্ট ফন্টেইন।
১৯৫৯ সালে রিঁমের হয়ে ফাইনাল খেলেন ওই মৌসুমে ১০ গোল করা ফন্টেইন। হেরেছিলেন কার কাছে নিশ্চয়ই জানেন। এ মৌসুমে ১১ গোল করা বেনজেমার বর্তমান ক্লাবের কাছে! ৬৩ বছর পর বেনজেমার কল্যাণে ফ্রান্সের কোনো ফুটবলারকে চ্যাম্পিয়নস লিগে ন্যূনতম ১০ গোল করতে দেখা গেল।
লা লিগায় ১২ পয়েন্ট ব্যবধানে রিয়ালের শীর্ষস্থান ধরে রাখার পেছনেও বেনজেমার অবদান সিংহভাগ। ২৪ গোল নিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং ১১টি গোল বানিয়ে এই কাজেও সবার ওপরে। বলা হচ্ছিল, রিয়ালে রোনালদোর সময়ের কথা। তারপর এই রিয়াল তো বেনজেমারই। যে বয়সে বেশির ভাগ ফরোয়ার্ড নিজের শেষ দেখতে পান, বেনজেমা সে বয়সেই আছেন সেরা ফর্মে।
রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তির কাছে বেনজেমা যেন তাই ওয়াইনের মতো। বয়স বাড়ার সঙ্গে গুণ-মান-স্বাদও বাড়ে, 'সে ওয়াইনের মতোই দিন দিন আরও ভালো হয়ে উঠছে। দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে শুধু স্ট্রাইকার না, একজন পরিপূর্ণ খেলোয়াড়। বল দখলে রাখতে সাহায্য করে। আমরা তাকে পেয়ে ভাগ্যবান।'
রিয়াল অন্তত তেমন কিছু মনে করতেই পারে। নইলে কী আর ক্লাবটির পক্ষ থেকে টুইট করা হয়, 'ফুটবল একটা সহজ খেলা। ২২ জন মিলে ৯০ মিনিট একটি বলের পেছনে দৌড়ায়, শেষ পর্যন্ত বেনজেমাই গোল করে।'