গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাতারের স্থানীয় দল আল-ঘারাফাকে কোচিং করিয়েছি আমি ৷ ব্রাজিলে ফেরার পর একটা ব্যাপার আমার খুব নজর কাড়ল৷ অনেক আগে থেকেই বিশ্বকাপ-জ্বরে কম্পমান ব্রাজিলের উত্তেজনা যেন অনেকটাই স্তিমিত৷ সম্ভবত বিশ্বকাপবিরোধী বিক্ষোভ-আন্দোলনে অনেক সমর্থকই দমে গেছে৷
আমি তাদের দোষ দেখি না৷ আয়োজক হিসেবে আমাদের প্রস্তুতি মোটেও আদর্শ কিছু হয়নি৷ আকাশচুম্বী ব্যয় আর নির্মাণকাজের ধীরগতি নিয়ে অভিযোগ করার অধিকার মানুষের আছে৷ তাদের করের টাকায় এই ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে, ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ তো আছেই৷ তবে সবকিছুর পরও আমার মনে হয় না মানুষ সরাসরি বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে৷ তবে এই প্রস্তুতিগত নানা সমস্যায় আবহটা খানিক তিক্ত৷ আমাদের স্টেডিয়ামগুলোর সংস্কার ছিল জরুরি৷ আর আমাদের যে ইতিহাস-ঐতিহ্য, তাতে বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়াটাও আমাদের প্রাপ্য ছিল৷ ১৯৫০ সালে আমরা যখন প্রথমবার বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিলাম, তখন ব্রাজিল ছিল পুরোই ভিন্ন একটা দেশ৷ এখনকার মতো ফুটবলের প্রতিনিধিত্বও এতটা ছিল না৷
এসবের সঙ্গে অবশ্য দলের কোনো সম্পর্ক নেই৷ সেলেসাওদের গত এক বছরের পারফরম্যান্স সমর্থকদের আশাবাদী করে তুলেছে৷ কনফেডারেশনস কাপ জয় তো আছেই, এর বাইরে লুইস ফেলিপে স্কলারি দায়িত্ব নিয়ে টালমাটাল দলটিকে থিতু করেছেন৷ তবে তাঁর পূর্বসূরি মানো মেনেজেসকেও কৃতিত্ব দিতে হবে৷ ২০১০ সালের জুলাইয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি নেইমারসহ বেশ কজন নতুন ফুটবলারকে দলে আনেন৷ থিয়াগো সিলভা, ডেভিড লুইজ, অস্কার, দানি আলভেজ, পাওলিনহোরা তো বিকশিত মেনেজেসের সময়েই৷
ইরাকে থাকার সময় ২০১২ সালের অক্টোবরে মেনেজেসের দলকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার৷ এশিয়ান বাছাইপর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে ইরাক ফুটবল ফেডারেশন একই ঘরানার ফুটবল খেলে এমন একটি দলকে প্রস্তুতি ম্যাচের জন্য খুঁজে বের করতে বলে আমাকে৷ আমি বলেছিলাম ওয়েলসের কথা৷ কিন্তু আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা ম্যাচ আয়োজন করল ব্রাজিলের সঙ্গে৷ েমনেজেসের দল আমাদের উড়িয়ে দিল ৬-০ গোলে!
স্কলারি দলটাকে একটু ঘষে-মেজে আরও ধারালো করে নিজের দর্শন জুড়ে দিয়েছেন৷ দলটা সুগঠিত, প্রতিপক্ষের ঘাড়েও ওরা েচপে বসে৷ সমর্থকদের কাছে এটি খুব উপভোগ্য, বিশেষ করে রিওতে স্পেনকে হারানোর পর (কনফেডারেশনস কাপে)৷ দলটিকে খুব ভালো সামলাচ্ছেন ‘বিগ ফিল’৷ বিশ্বকাপের দল নির্বাচন নিয়ে সব সময়ই বিতর্ক হয়৷ যে কেউ নিজের মতো করে তালিকা করে অন্যের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারে৷ কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের সব সম্ভাবনাই এই দলের আছে৷ শেষ পর্যন্ত পারবে কি না, সেটা অন্য ব্যাপার৷
আমার ধারণা, গ্রুপটা ব্রাজিলের জন্য খারাপ হয়নি৷ মেক্সিকো ও ক্রোয়েশিয়া প্লে-অফ খেলে বিশ্বকাপে এসেছে, ক্যামেরুনও এখন আগের মতো বড় হুমকি নেই৷ ক্রোয়েশিয়া আবার ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলবে মারিও মানজুকিচকে ছাড়া (এক ম্যাচে নিষিদ্ধ)৷ আর একটু হলে পানামার হাতেই বিদায় হতে যাচ্ছিল মেক্সিকোর৷ সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, ব্রাজিল সহজেই গ্রুপ শীর্ষে থাকার মতো অবস্থায় আছে৷ সেটি পারলে নকআউট পর্বের আগে ছেলেদের আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যাবে৷
ব্রাজিল দলকে নিয়ে আমার শঙ্কা একটি জায়গাতেই৷ বেশির ভাগেরই বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতা নেই৷ এমনিতে সব সময়ই প্রত্যাশার চাপ থাকে ব্রাজিলের ওপর৷ তবে এবার ব্যাপারটা পুরোই ভিন্ন স্বাগতিক বলে৷ ব্রাজিলে সর্বশেষ আয়োজিত ১৯৫০ বিশ্বকাপে তীরে এসে তরি ডুবেছিল বলে প্রত্যাশা থাকবে আরও বেশি৷ এ কারণেই আমি চাই, উরুগুয়ের মুখোমুখি যেন না হতে হয় আমাদের৷ সাম্প্রতিক অতীতেও এই দলটি আমাদের অনেক ঘাম ঝরিয়েছে৷ কনফেডারেশনস কাপেই ব্রাজিলকে স্বাভাবিক খেলা খেলতে দেয়নি উরুগুয়ে, ভীষণ চাপে ফেলে দিয়েছিল৷ ওই টুর্নামেন্টের আগেই আমি বলেছিলাম, মনস্তাত্ত্বিকভাবেই উরুগুয়ে আমাদের নাড়িয়ে দিতে পারে এবং সেটাই হয়েছিল৷
ব্রাজিলে বিশ্বকাপ বলেই আবার উরুগুয়ের মুখোমুখি হলে ৬৪ বছর আগের স্মৃতি লোকে বারবার তুলে আনবে৷ এটা মোটেও আমাদের জন্য ভালো কিছু হবে না৷ আমি তাই সততার সঙ্গেই বলছি, উরুগুয়ের হয়তো দারুণ কিছু ফুটবলার আছে, কিন্তু আমি চাই ওরা যেন বিশ্বকাপে খুব বেশি দূর না যায়৷ গ্রুপপর্ব পেরোতে না পারলেই সবচেয়ে ভালো!
তবে এটাও ঠিক, বিশ্বকাপ জিততে হলে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই৷ সবার বিপক্ষেই জয়ের মানসিকতা থাকতে হবে৷ এই দলটার ভেতর আমি যা দেখেছি, ওরা ব্রাজিলিয়ান জনতা ও এই টুর্নামেন্টের গুরুত্বটা বোঝে৷ পুরো গ্যালারিকে পাশে নিয়ে ব্রাজিল হয়ে উঠতে পারে অদম্য৷
ব্রাজিলের বেশির ভাগ ফুটবলার চ্যাম্পিয়নস লিগে ভালো করেনি বলে অনেকে চিন্তিত৷ আমার মতে এটা বাড়তি সুবিধা৷ জাতীয় দলের হয়ে ওরা আরও তরতাজা ও চনমনে থাকবে৷ এখন কেউ কোনো চোট-টোট না বাঁধালেই হয়৷ আশা করি, সেই দুর্ভাগ্য ব্রাজিলের হবে না৷
আগামীকাল জিকোর কলাম আর্জেন্টিনাকে নিয়ে