বিশ্বকাপে কোনো দলকেই খাটো করে দেখা উচিত নয়৷ কারণ, ফুটবলে দলগুলোর ব্যবধান এখন অনেক কম এবং ক্রমেই আরও কমছে। কিন্তু কখনো কখনো অতি সমীহ করাও ঠিক নয়। প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনা এই ভুলটিই করেছিল।
আলেসান্দ্রো সাবেলা ৫-৩-২ ফর্মেশন বেছে নেওয়ায় আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এর চেয়ে অতি সতর্ক সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না। এ জন্যই প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। বসনিয়ার প্রতি প্রাপ্য সম্মান রেখেই বলছি, অভিষিক্ত একটি দলের বিপেক্ষ এমন রক্ষণাত্মক ফর্মেশন বেছে নেওয়া কখনোই উচিত হয়নি। বসনিয়া আরও শারীরিক খেললে আর্জেন্টিনাকে বিপদে ফেলতে পারত। তবে আমার সবচেয়ে বেশি আপত্তি অন্য কারণে, সাবেলার ফর্মেশন মেসিকে পুরো িনষ্ক্রিয় করে রেখেছিল।
২০১০ িবশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনা যদিও শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে যে মেসি অন্য কোনো ফুটবলারের মতো নয়, কিন্তু ওর সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগানোর কথা মনে পড়ছে না। দেশের হয়ে ও সবচেয়ে ভয়ংকর যখন দুই স্ট্রাইকের পেছনে খেলে, নিচ থেকে বল টেনে নিয়ে আসে। আক্রমণকে এক সুতোয় গাঁথতে এবং জায়গা বের করতে ওর আশপাশে দুজন স্ট্রাইকার থাকতেই হবে। কিন্তু বসনিয়ার বিপক্ষে প্রথম ৪৫ মিনিটে কেবল সার্জিও আগুয়েরোই ছিল বলে মেসি কার্যকর কিছু করতে পারেনি। আর্জেন্টিনা অবশ্য ভাগ্য পক্ষে পেয়েছিল, আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে যাওয়ায় ওরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েনি। কোচও দ্বিতীয়ার্ধে ভুল বুঝতে পেরে ফর্মেশন বদলেছেন, এতে খেলার চেহারাই বদলে গেছে। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে হিগুয়েইন ও আগুয়েরোকে পাশে পেয়েছে মেসি, এমনকি অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়াকেও মাঠে অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা দিয়েছে।
ছক বদলানোয় রাতারাতি মেসির খেলা বদলে গেছে। প্রথমার্ধে সে ছিল একাকী, বেশ কজন বসনিয়ান ফুটবলার ওকে ঘিরে রাখতে পেরেছে। এ জন্যই গোলে একটি শটও নিতে পারেনি। ম্যাক্সি রদ্রিগেজের স্কিল আর সৃষ্টিশীলতার ঘাটতিও মেসিকে ভুগিয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনা ছিল সাহসী, সেটারই পুরস্কার মেসির অসাধারণ গোল। মেসিকে এক দঙ্গল ডিফেন্ডারের সামনে ছুড়ে না দিয়ে ওর শক্তির জায়গাগুলো কাজে লাগানোর ছক বেছে নিতে দিলে ওর কাজটাও সহজ হয়ে যায়।
ওই ম্যাচের আগে বিশ্বকাপে আট ম্যাচে মেসির গোল ছিল একটি। তবে পরিসংখ্যান আমার কাছে সব সময়ই আপেক্ষিক। ওয়েইন রুনি বিশ্বকাপে কখনোই গোল করতে পারেনি, তার মানে এই নয় যে সে ভালো ফুটবলার নয়! গোল করার মতো গোল বানিয়ে দিতেও বরাবরই দুর্দান্ত মেসি এবং হয়তো দেশের হয়ে এই ভূমিকাতেই ও বেশি ভালো করবে। ভুলে যাবেন না, আর্জেন্টিনার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা সে। তা ছাড়া ইদানীং ওর খেলা নিয়েই প্রতিপক্ষ কাটাছেঁড়া করে সবচেয়ে বেশি। এই মৌসুমে চোটে মাঠের বাইরেও ছিল অনেক দিন। আমার মতে, আর্জেন্টিনা এখনো বিশ্বকাপের হট ফেবারিট। তবে কোচ সবকিছু গুলিয়ে না ফেললেই হয়!
মেসি আর্জেন্টিনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার, তবে সে একাই দলের ভার বইতে পারবে না। ওর কাছে লোকের প্রত্যাশা দেখে আমার ২০০৬ বিশ্বকাপের রোনালদিনহোর কথা মনে পড়ে। ব্রাজিলিয়ানরা তখন চেয়েছিল বার্সেলোনার ফর্মটাই জাতীয় দলে বয়ে এনে সে দেশকে বিশ্বকাপ জেতাবে। অথচ ওই ব্রাজিল দলটিতে ছিল অনেক সমস্যা। তা ছাড়া রোনালদিনহোকে খেলানোও হয়েছিল পছন্দের পিজশনের বাইরে। এবার নেইমারের কাছ থেকেও অমন কিছুর প্রত্যাশা করা হচ্ছে। প্রথম ম্যাচের দুই গোলের পর তো পরিস্থিতি আরও খারাপ! প্রথম ম্যাচে ব্রাজিল খুব উদ্ভাসিত ছিল না, তবে নানা কারণেই ম্যাচটি ছিল খুব চাপের। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, উপলক্ষে চাপ তাদের ভালোই পেয়ে বসেছে। প্রথম দিকে এ জন্যই হয়তো এলোমেলো মনে হয়েছে ওদের।
শুরুতেই একটি আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ওদের ফিরতে দেখাটাও ছিল দারুণ। তবে সমস্যা যা চোখে পড়েছে, তা আমি আগেই বলেছিলাম এই কলামে। ব্রাজিলের ফুল ব্যাকরা আক্রমণে উঠে গেলে দুই সেন্টার ব্যাক যথেষ্ট কাভার দেয় না। ক্রোয়েশিয়ার গোলটি ছিল এটারই একটি প্রমাণ। দানি আলভেজের ওপরে উঠে যাওয়ার সুযোগটা কাজে লাগিয়ে দারুণ এক ক্রস করেছে ইভিকা ওলিচ৷ কারণ, থিয়াগো সিলভা সময়মতো ফিরে আসতে পারেনি। সত্যি বলতে, ওই পাশ থেকে অনেকগুলো ক্রস করেছে ক্রোয়েশিয়া। এ জন্যই ডেভিড লুইজকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি খাটতে হবে। পরের ম্যাচেই এটা শোধরাতে হবে।
দ্বিতীয়ার্ধেও ব্রাজিল খুব ভালো খেলতে পারেনি, ক্রোয়েশিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ জন্যই পেনাল্টির সিদ্ধান্তটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রেডকে কি টেনে ধরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল? মোটেও না। হ্যঁা, দেয়ান লোভরেন ওকে ধরেছিল, রেফারির মনে সংশয় জাগানোর যথেষ্ট ছিল ওটুকুই। রেফারি ভীষণ চাপেও ছিলেন। লোভরেন ফ্রেডকে ধরেছিল, আর অভিজ্ঞ ফ্রেড সময়মতোই পড়ে গেছে।
সুযোগটা লোভরেনই করে দিয়েছে। এমন কিছু করলে ডিফেন্ডাররা বিপদে পড়ে প্রায়ই। স্পেন-হল্যান্ড ম্যাচে ডিয়েগো কস্তার পেনাল্টির ক্ষেত্রেও এটি সত্যি। ডাচ ডিফেন্ডার যখন ওকে আটকাতে বক্সে স্লাইড করেছে, তখনই পেনাল্টির ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে। রেফারিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় মুহূর্তের মধ্যে। কখনো কখনো তাই ভুল হতেই পারে। কিন্তু ডিফেন্ডারদের দায়ও কম নয়।