‘আমার মনে হয়, এ সুযোগে তুমি গোটা দুনিয়াকে দেখাতে পারবে অস্ট্রেলিয়া কী অসাধারণ এক সুযোগ হারিয়েছে। দেখাতে পারবে তুমিই অস্ট্রেলিয়ার সেরা অধিনায়ক, যে কখনোই অধিনায়ক হতে পারেনি…’
এরপর মনোজ বাদালে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু বলেছিলেন। বলাটা স্বাভাবিক, ওয়ার্নকে অবসর থেকে ফিরিয়ে দলে নেওয়ার জন্য যে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই ভদ্রলোক! রাজি না হওয়া পর্যন্ত মনোজ মুখে লাগাম দেবেন বলে মনে হয় না। নতুন শুরু হতে যাওয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আইপিএলে নিজের দল রাজস্থান রয়্যালসে ওয়ার্নকে নিয়েই ছাড়বেন।
কিন্তু পরের কথাগুলো শেন ওয়ার্নের মাথায় ঢুকল কি না, কে জানে।
অধিনায়কত্ব! নেতৃত্ব!
অ্যালান বোর্ডার, মার্ক টেলরের দেখানো পথ ধরে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন মনে মনে বুনেছেন আজীবন। মাঠের বাইরে তাঁর বেপরোয়া জীবনযাপনের কথা ভেবে খোদ অস্ট্রেলিয়াই যে স্বপ্ন বাস্তব করেনি। ভরসা রেখেছে স্টিভ ওয়াহর ওপর। এরপর রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক এসেছেন অধিনায়কত্বের মসনদে, ওয়ার্নের ভূমিকা হাত ঘুরিয়ে জাদু দেখানোতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। আজ ভিনদেশের এক মানুষ ওয়ার্নের মনের বার্তা বুঝে যেচে তাঁকে নিজেদের ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের অধিনায়কত্ব দিতে চাইছে। বানাতে চাইছে দলের একচ্ছত্র অধিপতি। ওয়ার্নের মাথায় বাকি কথাগুলো ঢুকবেই-বা কী করে?
ততক্ষণে যে ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন এই স্পিন-জাদুকর! রন্ধ্রে রন্ধ্রে আবারও অনুভব করছেন সেই পুরোনো উত্তেজনা, বছর দশেক আগেও যে উত্তেজনায় ঘুম আসত না তাঁর!
অবশ্য অস্ট্রেলিয়া যে ওয়ার্নের এ স্বপ্ন একদমই বাস্তবায়ন করেনি, বলা যাবে না। ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে নতুন দায়িত্ব পাওয়া স্টিভ ওয়াহ যখন চোটে পড়েছিলেন, সহ-অধিনায়ক ওয়ার্নকে ১১ ম্যাচের জন্য ‘প্রমোশন’ দেওয়া হয়। যে পরীক্ষায় পাস করেছিলেন লেটার মার্কস নিয়ে। সেবার ১০ ম্যাচ জিতিয়েও নির্বাচকদের মন জয় করতে পারেননি। স্টিভ দলে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্নের কাছ থেকে অধিনায়কত্বের বাহুবন্ধনী বুঝে নিয়েছেন।
অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে নিয়মিত নেতৃত্ব দেওয়ার যে সুখ, যে গর্ব, সেটি কপালে জোটেনি কখনো। আক্ষেপটা বুকে নিয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন।
ম্যালকম স্পিড তাঁর বই ‘স্টিকি উইকেট’-এ বিষয়টা বেশ ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। পেশায় ব্যারিস্টার এই ভদ্রলোক ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। টেলরের পর অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব কে দেবেন, সেটা খুঁজে বের করার গুরুদায়িত্বটা তাঁরই ছিল। শুরুতে অধিনায়কত্বে ওয়ার্ন এগিয়ে থাকলেও, ওই যে, ছন্নছাড়া জীবনযাত্রাই কাল হলো। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে জন নামের এক বুকির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন, ব্যাপারটা ওয়ার্নের অধিনায়ক হওয়ার স্বপ্নে জোরেশোরে ধাক্কা দিল। তাও ওয়াহ আর ওয়ার্নের মধ্যে কাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নেতা বানানো যায়, সে জন্য দুজনেরই সাক্ষাৎকার নিলেন স্পিড।
দেখলেন, নেতৃত্ব নিয়ে স্টিভের ঝোঁক কতটুকু। কাগজে-কলমে একজন নেতার কী কী গুণ থাকা উচিত, নেতৃত্বের দর্শন কত প্রকার ও কী কী—তত দিনে গুলে খেয়ে ফেলেছেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। শুধু মাঠের ভেতরেই নয়, মাঠের বাইরেও পারলে নেতৃত্বের ব্যাজটা পরে বের হয়ে যান।
ওদিকে নেতৃত্ব নিয়ে ওয়ার্নের জ্ঞান যতটা না কেতাবি, এর চেয়েও বেশি প্রায়োগিক ছিল। ছোটবেলায় কিলডা ক্রিকেট ক্লাব থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মাঠ ও মাঠের বাইরে খেলা নিয়ে যাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, সবার অভিজ্ঞতা জেনে-বুঝে ঋদ্ধ হয়েছেন। স্টিভের মতো ওয়ার্নের মনে হয়নি, নেতৃত্বের তত্ত্বকথা জানা প্রয়োজন। মাঠের বাইরের নানান কীর্তির পাশাপাশি এ কারণটাই পিছিয়ে দিয়েছিল ওয়ার্নকে। বছরখানেক পর ব্রিটিশ এক নার্সকে উল্টোপাল্টা খুদেবার্তা পাঠাতে গিয়ে সহ-অধিনায়কের পদটাও হারান। ওয়ার্নের জায়গায় অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আসেন স্টিভের ডেপুটি হয়ে। অধিনায়ক হওয়া তো দূর, উল্টো জাতীয় দলে এসেছে এক বছরও হয়নি, এমন একজনের কাছে সহ-অধিনায়কত্ব হারাতে হচ্ছে, কেমন লেগেছিল ওয়ার্নের, আপনারাই ভেবে দেখুন!
সেই যে গিলির সঙ্গে সম্পর্কে দাগ পড়ল, বাকি জীবনে সে দাগ পুরোপুরি মুছেছিল কি না, গিলিই ভালো বলতে পারবেন। ওয়ার্ন নিজেই স্বীকার করেছিলেন, দুটি ঘটনার জন্য গিলিকে কখনোই মন থেকে কাছের মানুষ ভাবতে পারেননি। সহ-অধিনায়ক হওয়ার পর একদিন ওয়ার্নকে নিজের কক্ষে ডেকে পাঠান গিলক্রিস্ট। একটু বিরক্তই হয়েছিলেন ওয়ার্ন। গিলক্রিস্টের কথা শুনে বিরক্তিটা বেড়েছিল বৈ কমেনি, ‘বন্ধু, আমি জানি, আমি বছরখানেক হলো দলে এসেছি, এর মধ্যেই তোমার কাছ থেকে সহ-অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়েছি। আমি শুধু এটা জানানোর জন্য তোমাকে ডেকেছি যে তোমার যদি কখনো কোনো পরামর্শ বা সাহায্যের দরকার হয়, আমাকে বলতে পিছপা হয়ো না! সবাইকেই আমি এ কথা বলছি, যার মধ্যে তুমিও পড়ো।’
কথাগুলো গিলক্রিস্টের আট বছর আগে ক্যারিয়ার শুরু করা ওয়ার্নের অহমে লেগেছিল, বলাই বাহুল্য। ২০০৩ বিশ্বকাপের আগের দিন মায়ের দেওয়া এক ওষুধ খেয়ে ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হয়ে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়া ওয়ার্নের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছিলেন এই গিলক্রিস্টই। স্বনামধন্য এক দৈনিকে ওয়ার্ন ও তাঁর মাকে দুষেছিলেন সরাসরি, পরে যে ঘটনার জন্য গিলক্রিস্ট ক্ষমা চাইলেও ওয়ার্ন পুরোপুরি ভুলে যাননি।
আমার মনে হয়, এ সুযোগে তুমি গোটা দুনিয়াকে দেখাতে পারবে অস্ট্রেলিয়া কী অসাধারণ এক সুযোগ হারিয়েছে। দেখাতে পারবে তুমিই অস্ট্রেলিয়ার সেরা অধিনায়ক, যে কখনোই অধিনায়ক হতে পারেনি
স্টিভ ওয়াহ-গিলক্রিস্ট কিংবা পন্টিং-ক্লার্কদের আড়ালে থেকে ওয়ার্ন কী তবে বাইশ গজে নিজের নেতৃত্বগুণ প্রকাশে পিছিয়ে থেকেছেন? অবশ্যই নয়। ধীরলয়ে রানআপ শুরু করার আগে প্রতিটি বলে হাত নেড়ে নেড়ে ফিল্ডিং ঠিক করতেন। ওয়াহ-পন্টিংরা সে স্বাধীনতাটুকু দিয়েছিলেন তাঁকে। মাঠের বাইরে ছন্নছাড়া ওয়ার্ন তখন যেন ঠিক আমির খানের মতো পারফেকশনিস্ট—একটু এদিক-ওদিক হলে পিচে বুনবেন না মায়াবী ইন্দ্রজাল। খেলাটা যত বেশি শারীরিক, তার চেয়ে ঢের বেশি মনস্তাত্ত্বিক—এ কথা বুঝেছিলেন ভালোভাবে। লেগ স্পিন, ফ্লিপার, জুটার, স্লাইডারের পাশাপাশি ব্যাটসম্যানদের মনে ঢুকে যাওয়ার এই অবিশ্বাস্য ক্ষমতাও ওয়ার্নের অস্ত্রভান্ডারকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছিল।
ড্যারিল কালিনানের কপাল খারাপ, ওয়ার্নের কাছে বোকা বনেছেন—এমন খেলোয়াড়দের তালিকায় তাঁর নামটাই আগে আসে, না হয় বিশ্বজুড়ে কম খেলোয়াড়কে ‘কালিনান’ বানিয়েছেন ওয়ার্ন? ওয়ার্নের জাদু বুঝতে না পেরে, তাঁর কাছে বারবার নাকাল হতে হতে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ব্যাটসম্যান একবার সিরিজের আগে মনস্তত্ত্ববিদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কালিনানের গড় তাতে ১২.৭৫-এর চেয়ে বাড়েনি। নিজেকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ফেলা খেলোয়াড়টা তাঁর জন্মদিনেই প্রয়াত হয়েছেন, আজগুবি এই তথ্যও আজীবন কালিনানকে অস্বস্তিতেই রাখবে, নিশ্চিত। হ্যাঁ, সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ওয়ার্ন যে দিনকে বেছে নিলেন, সেদিন কালিনানের জন্মদিন ছিল!
মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে ওয়ার্নের ‘ক্যারিশমা’র কথা উঠলে চলে আসে বাসিত আলীর প্রসঙ্গটাও। ১৯৯৫ সালের সিডনি টেস্টে পাকিস্তানের ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানকে আউট করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছিল ওয়ার্নদের। দিনের শেষ বলটা করার আগে উইকেটকিপার ইয়ান হিলির সঙ্গে পরামর্শ শুরু করলেন। ভাবখানা এমন, বাসিতকে আউট করার জন্য কত পরিকল্পনাই না আঁটছেন! ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, সময়ক্ষেপণ করে বাসিতের মনোযোগ নষ্ট করাই উদ্দেশ্য ছিল ওয়ার্নের। সে মনস্তাত্ত্বিক খেলায় লাভও হয়েছিল। রাউন্ড দ্য উইকেটে বল করতে এসে লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করলেন, বাসিতের নিশ্চল বাঁ পায়ের পেছন দিয়ে উইকেটে আঘাত হানল সেই বল। গ্যাটিং-বল কিংবা স্ট্রাউস-বলের চেয়ে হয়তো কম ঘোরেনি সেটা!
পরে জানা গেল, রাতে কী খাবেন, পিৎজা না স্প্যাগেত্তি, সেটা নিয়েই আলোচনা করছিলেন হিলির সঙ্গে। এভাবে ব্যাটসম্যানদের মনে ঢুকে যাওয়ার সামর্থ্য আছে যার, সে বোলার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবেন না তো কে হবেন?
১৯৯৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ খেলেছিল দুটি। সেই বিখ্যাত সেমিফাইনালটা তো বটেই, তার আগেও সুপার সিক্সের এক ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা তখন সঙিন। প্রথম রাউন্ডে পাকিস্তান আর ইংল্যান্ডের কাছে হারা অস্ট্রেলিয়াকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জিততেই হবে সেমিতে উঠতে হলে। অধিনায়কত্ব নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছিল স্টিভ ওয়াহর। ব্যাটে রান নেই মোটেও। সে ম্যাচে হেরে গেলে নেতৃত্ব চলে যাবে নিশ্চিত। এমন অবস্থায় ম্যাচের পর ম্যাচ বল হাতে দলকে রক্ষা করা ওয়ার্নের অধিনায়কসুলভ মস্তিষ্ক বাঁচিয়ে দিল ওয়াহকে। ম্যাচের আগে সভায় ওয়ার্ন জানালেন, হার্শেল গিবস কখনো ক্যাচ ধরে বেশিক্ষণ বল হাতে রাখতে চান না, তার আগেই উদ্যাপন শুরু করে দেন। আম্পায়াররা সেদিকে খেয়াল না রাখলে, গিবসের এই দুর্বলতার ফায়দা নেওয়া যায়!
ভাগ্যের কী খেল! সেই স্টিভ ওয়াহর ক্যাচই উদ্যাপন করার নেশায় ফেলে দিলেন গিবস, ফলে গেল ওয়ার্নের কথাটা। যা দেখে অতি উৎসাহী মানুষ বলা শুরু করলেন, স্টিভ নাকি সে কাণ্ডের পর গিবসের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি ক্যাচ নয়, বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলে।’ কথাটার মধ্যে যে বিন্দুমাত্রও সত্যতা নেই, সেটা ওয়ার্ন স্বীকার করেছেন নিজের আত্মজীবনীতে। কিন্তু তাতে ওয়ার্নের ক্ষুরধার চিত্তের মহিমা কমছে কোথায়!
শুরুতে রাজস্থান রয়্যালসের কথা বলা হচ্ছিল। আইপিএলের প্রথম আসরে মনোজ বাদালের দেওয়া স্বাধীনতা পেয়ে দলটাকে একদম নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন ওয়ার্ন। অধিনায়ক তো ছিলেনই, সঙ্গে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল কোচের দায়িত্বও। ইউসুফ পাঠান, রবীন্দ্র জাদেজাদের উঠে আসা তো তাঁর হাত ধরেই! আদর্শ অধিনায়কের মতো তরুণ খেলোয়াড় গড়ে তোলার কাজে সাহায্য করেছেন। রবীন্দ্র জাদেজার মধ্যে আগামী দিনের তারকা হওয়ার সব উপাদান সেই ২০০৮ সালেই খুঁজে পেয়েছিলেন ওয়ার্ন, আদর করে ‘রকস্টার’ ডাকতেন। হার্শা ভোগলেকে ডেকে এনে বলেছিলেন, ‘দেখে নিয়ো, একদিন এই ছেলে অনেক বড় হবে।’
প্রিয় গুরু ও সতীর্থের কথা সত্যি প্রমাণ করতেই যেন ওয়ার্নের অকালমৃত্যুর দিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুর্দান্ত শতক হাঁকালেন জাদেজা! বল হাতে নিলেন নয় উইকেট!
দল গঠনের সময় মনোজ বাদালের পছন্দের এক খেলোয়াড়কে স্কোয়াডে রাখেননি। পরে মনোজ হাজার পীড়াপীড়ি করেও সে খেলোয়াড়কে দলে ঢোকানোর জন্য ওয়ার্নকে রাজি করাতে পারেননি। ওয়ার্ন হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া না হলে দলের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবেন। তিনি বুঝেছিলেন, স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দিলে এত দিন ধরে দলের খেলোয়াড়দের সামনে নিজের যে গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলেছেন, সেটা হারিয়ে ফেলবেন। একজন আদর্শ অধিনায়ক সেটা হতে দেবেন কেন?
প্রথম ম্যাচে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের বিপক্ষে নেমেছিলেন ওয়ার্নরা। দিল্লির পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা শুরু থেকেই অফ স্ট্যাম্পের একটু বাইরে বল ফেলবেন, ম্যাকগ্রার সঙ্গে জাতীয় দলের হয়ে বহুদিন ধরে খেলার সুবাদে সেটা জানতেন ওয়ার্ন। ওপেনার তারুয়ার কোহলি অফসাইডে কাভার ড্রাইভটা ভালো মারতে পারতেন দেখে ম্যাকগ্রার পেছনে তারুয়ারকে লেলিয়ে দিলেন।
যোগ্য অধিনায়কের মতো নিজের এমন অনেক অভিজ্ঞতাই বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইউসুফ পাঠান, রবীন্দ্র জাদেজাদের মধ্যে। ডেকান চার্জার্সের ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ইনিংসের প্রথমে স্পিন খেলতে পারবেন না, বুঝেছিলেন। এ জন্য শুরুতেই বল তুলে দিয়েছিলেন ইউসুফ পাঠানের হাতে। ফলাফল? তৃতীয় ওভারে গিলক্রিস্ট আউট!
ম্যাচ হারের পর প্রত্যেক সতীর্থের সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলে সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। আবার ম্যাচ জেতার পরেও খেলোয়াড়দের নিয়ে রাত জেগে ইচ্ছেমতো পার্টি করেছেন, তরুণদের বুঝিয়েছেন লক্ষ্য অর্জিত হলে কীভাবে উদ্যাপন করতে হয়। আইপিএলের মতো বড় মঞ্চে দলের খেলোয়াড়েরা যাতে নিজেকে নিঃসংকোচে তুলে ধরতে পারেন, নিশ্চিত করেছেন। মাস দুয়েক আগে যে খেলোয়াড় অবসর থেকে ফেরার ব্যাপারে চরম উদাসীন ছিলেন, নেতৃত্বের স্বাদ তাঁকে দুই দশক আগের সেই চনমনে তরুণ বানিয়ে দিয়েছিল।
অধিনায়কত্ব নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছিল স্টিভ ওয়াহর। ব্যাটে রান নেই মোটেও। সে ম্যাচে হেরে গেলে নেতৃত্ব চলে যাবে নিশ্চিত। এমন অবস্থায় ম্যাচের পর ম্যাচ বল হাতে দলকে রক্ষা করা ওয়ার্নের অধিনায়কসুলভ মস্তিষ্ক বাঁচিয়ে দিল ওয়াহকে
পেশাদার রেসলিং যাঁরা দেখেন, আন্ডারটেকার, শন মাইকেলস, ট্রিপল এইচ, রেসলম্যানিয়া—নামগুলো পরিচিত লাগবে। এমনই এক রেসলম্যানিয়ায় ট্রিপল এইচকে হারানোর স্বপ্নে বিভোর আন্ডারটেকার একের পর এক বাঁকা কথা বলে চেষ্টা করতে লাগলেন ট্রিপল এইচকে খেপিয়ে তোলার। ট্রিপল এইচ তত দিনে পর্দার পেছনের মানুষ, রিংয়ে লড়ার চেয়ে আগামী দিনের তারকা তৈরির দিকেই তাঁর বেশি নজর।
কিন্তু আন্ডারটেকার সেটা মানবেন কেন? তিনি ভালোই বুঝেছিলেন, স্যুট-কোটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রেসলার ট্রিপল এইচকে রেসলম্যানিয়ার ময়দানে নামানোর মোক্ষম পথ কোনটা। সুন্দরমতো বলে দিলেন, আন্ডারটেকারের সঙ্গে রেসলম্যানিয়ায় ট্রিপল এইচ লড়তে চাইছেন না, কারণ ট্রিপল এইচের প্রিয় বন্ধু শন মাইকেলস রেসলম্যানিয়ায় আন্ডারটেকারকে হারাতে পারেননি। আর বাইরে বাইরে যত যা-ই বলুন না কেন, ট্রিপল এইচ নিজেও জানেন, শন মাইকেলসের চেয়ে ভালো রেসলার তিনি নন।
আজীবন রেসলার শন মাইকেলসের আলোয় আড়ালে থাকা ট্রিপল এইচকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য ওই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল। ঠিক যেমন রাজস্থানের মালিক মনোজ বাদালে ওয়ার্নকে তাতিয়ে দিয়েছিলেন অধিনায়কত্বের প্রসঙ্গ তুলে!
কলকাতা-বেঙ্গালুরুর আলোয় টুর্নামেন্টের শুরুতে আড়ালে পড়ে থাকা রাজস্থানের হয়ে ওয়ার্নের কীর্তি দেখে ম্যালকম স্পিডের কি কখনো মনে হয়েছিল, বছর দশেক আগে চাইলে ওয়ার্নকে অধিনায়ক করলেও করতে পারতেন? হয়তো!
শুধু ৭০৮ উইকেট দিয়ে ওয়ার্নের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা, পরিসংখ্যানের মাপকাঠিতে ওয়ার্নকে বোঝার চেষ্টা করা বৃথা। কাজী নজরুল ইসলাম জীবনে কয়টা শব্দ লিখেছেন, সেটা দিয়ে তাঁর মহিমা, ব্যাপ্তি যেমন বোঝা যায় না, ওয়ার্নের ব্যাপারটাও তা–ই
বাইশ গজে স্লেজিং আর মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে পাগল বানিয়ে ফেললেও সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কেউ যদি ওয়ার্নের সঙ্গে সমানে-সমান টক্কর দিতে পারতেন, তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দিতে ভুলতেন না। যে কারণে কেভিন পিটারসেন, মাইকেল ভন, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের মতো খেলোয়াড়েরা ওয়ার্নের সম্মান পেয়ে গেছেন আজীবন। নিজের বই ‘দ্য ইয়ার ইন দ্য সান’-এ ভন বলেছেন, ‘ওয়ার্নের বিপক্ষে খেলার ব্যাপারটা সব সময় উপভোগ্য ছিল, কারণ সে সম্মান করতে জানত। আপনি ওর বিপক্ষে ভালো খেললে ও আপনাকে অসম্মান করবে না। ইনিংস শেষে সবার আগে ও-ই এসে বলবে, “ওয়েল প্লেড”!’
নাক উঁচু ছিল, এমন অভিযোগ ওয়ার্নের ঘোরতর শত্রুও করবে না। অকাতরে ভালোবাসা বিলাতে পারতেন, বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা প্রত্যাশাও করতেন। মুগ্ধ দর্শকের চোখেমুখে খুঁজতেন অর্জনের স্বীকৃতি, প্রশংসা। দ্য এজ ও সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের ক্রিকেট প্রতিবেদক মার্টিন ব্লেকের সঙ্গে ছিল গলায়-গলায় খাতির। ২০০২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্টে স্পিনের মায়াজাল বিছিয়ে গুনে গুনে ১৬টি উইকেট নিয়েছিল, যার ১১টাই ছিল এলবিডব্লুর মাধ্যমে। তত দিনে নিজের ভান্ডারে যুক্ত হয়েছে নতুন এক অস্ত্র—স্লাইডার; যেভাবে হাত ঘোরালে বল ডানে-বাঁয়ে না ঘুরে সোজাসুজি ব্যাটসম্যানের ব্যাটে বা প্যাডে আঘাত করে।
ওয়ার্নের স্লাইডারে বিভ্রান্ত পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা একের পর এক এলবিডব্লু হচ্ছিলেন। সিরিজ শেষে হোটেল লবিতে ব্লেকের কাছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কী, কেমন দেখলে?’
যেন ব্লেকের মতামতের ওপর ওয়ার্নের ক্যারিয়ারের কত কিছু নির্ভর করছে!
২০০৫ সালের সেই বিখ্যাত অ্যাশেজ সিরিজের সময় ব্যক্তিগত জীবনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওয়ার্নের। স্ত্রী সিমোন কালাহানের সঙ্গে বিচ্ছেদ প্রায় চূড়ান্ত। একদিকে রাতের পর রাত জেগে ফোনে স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ক্ষতবিক্ষত হৃদয় থেকে রক্ত ঝরছে, অন্যদিকে সকালে উঠেই ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের সামনে স্পিনের জাল বিছিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।
ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে এমনই এক ঝঞ্ঝামুখর রাত্রি শেষে ঘুমহীন ওয়ার্ন ব্যাট করতে নেমে সাইমন জোন্সের বলটা দেখতেই পেলেন না। ইয়ান বেলের হাতে ক্যাচ দিলেন প্রথম বলে। ইংল্যান্ডের ৪৭৭ রানের জবাবে প্রথম ইনিংসে ২১৮ রানে গুটিয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া তখন ভনের দিকে তাকিয়ে। ভন কী ফলোঅন করাবেন?
ইংলিশ অধিনায়ক যেন আবারও অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে পাঠান, ওয়ার্ন অন্তত সেটাই চাইছিলেন। আর কিছু নয়, পন্টিং-ক্লার্করা যতক্ষণ ব্যাট করবেন, ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে আরকি! শেষ ইনিংসে ১২৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ড ওয়ার্নের স্পিনে কাবু হলো বলের পর বল। লাভ হলো না, ওয়ার্নের আফসোস বাড়িয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে তিন উইকেটে ম্যাচটা জিতে নিল ইংল্যান্ডই। ইনিংসের শুরুতে ব্রেট লি বা মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ নয়, তাঁর হাতে যেন বল তুলে দেওয়া হয়, এ জন্য পন্টিংয়ের কাছে মিনতি করেছিলেন ওয়ার্ন। পন্টিং কথা শোনেননি। ওয়ার্নের ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞার প্রতি আস্থা রেখে যে কাজটা করলে হয়তো অ্যাশেজটাই হারতে হতো না অস্ট্রেলিয়াকে!
বল হাতে নিজের খেলা আট অ্যাশেজের মধ্যে সেবারই সবচেয়ে সফল সময় কাটালেন, কিন্তু লাভ হলো না। ১৯ বছর পর ভস্মাধারটার অধিকার পেলেন ভন-পিটারসেনরা, ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে লেখা থাকল পাঁচ টেস্টে ৪০ উইকেট নেওয়া ওয়ার্নের নাম।
ওল্ড ট্রাফোর্ডের তৃতীয় টেস্টে ড্র করার পর কোচ জন বুকানন খোলাখুলি দুষেছিলেন খেলোয়াড়দের। বলেছিলেন, খেলোয়াড়েরা নিজেদের সবটুকু দিচ্ছেন না। ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পরার যোগ্য নন ওয়ার্ন-পন্টিংরা। রুষ্ট কোচের বাক্যবাণে বিদ্ধ অধিনায়ক পন্টিং চুপ থাকলেও সেদিন ওয়ার্নের অধিনায়কসত্তা তাঁকে চুপ থাকতে দেয়নি। এমনিতেই বুকাননকে সহ্য করতে পারতেন না, সেবার সোজাসুজি বলে দিলেন, ‘খবরদার আর কখনো এমন কথা বলবে না বাক (বুকাননের ডাকনাম)। জানি, আমি এই ক্যাপ অর্জন করার জন্য কী কষ্ট করেছি, আমার সতীর্থরা কী কষ্ট করেছে। তাই নিজের মতামত নিজের কাছেই রাখো।’ আনুষ্ঠানিকভাবে নেতার তকমা না পাওয়া ওয়ার্ন এভাবেই বারবার বুঝিয়েছেন, নেতৃত্বগুণটা তাঁর সহজাতই।
শুধু ৭০৮ উইকেট দিয়ে ওয়ার্নের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা, পরিসংখ্যানের মাপকাঠিতে ওয়ার্নকে বোঝার চেষ্টা করা বৃথা। কাজী নজরুল ইসলাম জীবনে কয়টা শব্দ লিখেছেন, সেটা দিয়ে তাঁর মহিমা, ব্যাপ্তি যেমন বোঝা যায় না, ওয়ার্নের ব্যাপারটাও তা–ই। দুজনই খামখেয়ালি ছিলেন, ছিলেন আপন সৃষ্টির আনন্দে বিভোর। জীবন-বাস্তবতার আঘাতে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, তবু নিজ নিজ ক্যানভাসে বারংবার সৃষ্টিশীলতার আঁচড় বোলাতে ভোলেননি বিন্দুমাত্র।
আজীবন অগণিত ব্যাটসম্যানকে ঘূর্ণিফাঁদে বোকা বানানো ওয়ার্ন নিজের অনন্তযাত্রাতেও সবাইকে বোকাই বানালেন। এবার শুধু ব্যাটিং প্রান্তে গ্যাটিং, স্ট্রাউস বা অ্যালেক স্টুয়ার্টের জায়গায় বিশ্বের কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থক ছিলেন, এই যা!