‘অধিনায়ক’ মরগানকে গড়ে তোলার নেপথ্যে আছে বাংলাদেশও
ব্যাটসম্যান এউইন মরগান, অধিনায়ক এউইন মরগান—সর্বোপরি খেলোয়াড় এউইন মরগানের সামর্থ্য ও দক্ষতার সীমা কতটুকু হতে পারে, সে সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পাওয়ার জন্য ইংল্যান্ড চাইলে বাংলাদেশকে একটা ধন্যবাদ দিতেই পারে।
কীভাবে?
স্মৃতির টাইম মেশিনে চড়ে একটু পেছনে ফেরা যাক। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যাক দুটি ম্যাচ। দুটি ম্যাচেই ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ।
২০১০ সালের প্রথম ম্যাচটার মঞ্চ মিরপুর। ২৪ বছর বয়সী মরগান তত দিনে পুরোদমে ‘ইংলিশ’, ভুলেছেন জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডের মায়া। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওই ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডের হয়ে বছরখানেক খেলার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তবে সেদিন সাকিব-রাজ্জাকরা ইংলিশদের যেমন বৈরী পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন, ইংল্যান্ডের হয়ে ‘ছোট্ট’ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মরগান এর আগে অমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। ২৬১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে থাকা ইংল্যান্ড ম্যাচের ৪৬তম ওভারে হারাল অষ্টম উইকেট। সাকিবের বলে বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন গ্রায়েম সোয়ান। রান তখন ২২৯, ততক্ষণে নিজেদের মাটিতে ইংলিশদের হারানোর স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশ। মিরপুরে আসা উত্তাল জনসমুদ্রের গর্জনে কান পাতা দায়।
সেই গর্জন একটুও টলাতে পারল না মরগানকে। ক্রিজে আসা দশম ব্যাটসম্যান জেমস ট্রেডওয়েলকে এক প্রান্তে রেখে একাই ব্যাট চালিয়ে গেলেন। শেষ দুই ওভারে ১৬ রান দরকার, এমন অবস্থায় ৪৯তম ওভারে বল করতে আসা শফিউলের প্রথম দুই বলে ছয় রান নিয়ে করে ফেললেন সেঞ্চুরিও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি! প্রথম সেঞ্চুরি, উদ্যাপনে বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু যেখানে দলের বিপদই কাটেনি, সেখানে সব ভুলে ব্যক্তিগত অর্জনের আনন্দে উদ্বেলিত হবেন, এমন মানুষ যে মরগান নন!
সেঞ্চুরি হলেও দলকে জেতানোর কাজ বাকি ছিল তখনো। তা করতে তিন বলের বেশি নিলেন না। সেদিন বাংলাদেশই ব্যাটসম্যান মরগানের সামর্থ্য বের করে এনেছিল বিশ্বমঞ্চে। ইসিবির কর্তাব্যক্তিরা বুঝেছিলেন, ‘ভিনদেশি’ পিটারসেনের মিডল অর্ডারে হাল ধরার জন্য চলে এসেছেন আরেক ‘ভিনদেশি’, যাঁকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনা যায়।
দ্বিতীয় ম্যাচের মঞ্চ মিরপুর থেকে প্রায় সোয়া আট হাজার কিলোমিটার দূরের শহর অ্যাডিলেড। মঞ্চটা বড়ও বটে, ওয়ানডে বিশ্বকাপের মঞ্চ বলে কথা! তবে প্রতিপক্ষ একই—বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েক মাস আগেই ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন মরগান, দলে তখনো সেভাবে নিজের ছাপ রাখা শুরু করতে পারেননি। ওয়ানডের ইংল্যান্ড তখন ছন্নছাড়া এক দল। মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং আর রুবেলের বোলিংয়ে বাংলাদেশ পায় ১৫ রানের স্মরণীয় এক জয়। ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দিয়ে উঠে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে।
ইংল্যান্ডের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি কাঁপিয়ে দেয় এই পরাজয়। মরগান বুঝতে পারেন, অ্যালিস্টার কুকের দল থেকে এউইন মরগানের দল হয়ে উঠতে চাইলে ইংল্যান্ডকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে হবে। নতুন আসা কোচ ট্রেভর বেলিস আর ক্রিকেট পরিচালক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসও অধিনায়ক মরগানের চিন্তাধারায় আস্থা রাখলেন। জন্ম নিল এক নতুন ইংল্যান্ড।।
প্রমাণ? বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর প্রথম ওয়ানডেতেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম চার শ ছাড়ানো স্কোর। রুট-বাটলার আর মরগানের চার-ছক্কার বৃষ্টিতে ক্রিকেট বিশ্ব অবাক হয়ে এক নতুন ইংল্যান্ডের উত্থান দেখে। ইংল্যান্ডও সবাইকে দেখায়, ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেটের এই যুগে ওয়ানডেটা কীভাবে খেলা দরকার। পাঁচ ম্যাচের দ্বিপক্ষীয় সে সিরিজে মরগান নিজেই ১৬ ছক্কা মেরে বুঝিয়ে দেন, নতুন ইংল্যান্ডকে কীভাবে খেলাতে চান।
নতুন ইংল্যান্ডের আবির্ভাবের ‘কারিগর’ হিসেবে, অধিনায়ক মরগানের চিন্তাচেতনার পূর্ণ বাস্তবায়নের অনুঘটক হিসেবে বাংলাদেশের কি ধন্যবাদ প্রাপ্য নয়? হয়তো!
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শুরু, অধিনায়ক মরগানের প্রাপ্তির খাতার ষোলোকলাও পূর্ণ হয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর মরগান যে বদলে যাওয়া ইংল্যান্ডের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা ওয়ানডে বিশ্বকাপ শিরোপার রূপ ধরে বাস্তবতার জমিনে নেমে এসেছে ২০১৯ বিশ্বকাপে। লর্ডসে অবিশ্বাস্য এক ফাইনালেও প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।
মাঝের চার বছর বিশ্ব দেখেছে সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের দাপট। দেখেছে টপ অর্ডারে বাটলার–রয়-বেয়ারস্টোদের বিধ্বংসী রূপ, দেখেছে মিডল অর্ডারে রুট-স্টোকস-মঈনদের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিং ও কার্যকরী বোলিং, দেখেছে আর্চারদের গতি কিংবা ক্রিস ওকস-লিয়াম প্লাঙ্কেটদের সুইং-জাদু। ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে কেউ রিস্ট স্পিনের ভেলকি দেখাতে পারবেন, সেটাই–বা কে ভেবেছিলেন! আদিল রশিদের কল্যাণে বিশ্ব দেখেছে সেটাও।
ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান যোগ করা যাক। ২০১৩ সালে সাদা বলের ক্রিকেটের বিভিন্ন নিয়মে যখন বদল এল (দুই নতুন বল, ফিল্ডিংয়ে বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা), পরিবর্তনগুলো সাহায্য করেছিল মূলত ব্যাটসম্যানদের। এসব নিয়ম চালু করার পেছনে আইসিসির মূল লক্ষ্য ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটকে আরও বেশি রানপ্রসবা করা। নিয়মের এসব পরিবর্তন মাথায় রেখে অন্যান্য আন্তর্জাতিক দলগুলো যখন ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের দিকে মনোযোগ দিচ্ছিল, সে তুলনায় অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ড বেশ পিছিয়েই ছিল। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ওভারপ্রতি মাত্র ৫.৪৮ রান করে তোলা। যেখানে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া তুলেছিল ওভারপ্রতি ৬.৮২ রান। তখনো মরগানই ইংল্যান্ডের অধিনায়ক, কিন্তু ওই যে নিজের অধিনায়কত্বের ছাপটা তখনো রাখা শুরু করতে পারেননি। ফলে সাবধানী কুকের ছায়া থেকেও বেরোতে পারেনি ইংলিশরা। চার বছর পর ঠিক পরের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ওভারপ্রতি রান? ৬.২৭, যা টুর্নামেন্ট-সর্বোচ্চ!
ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ওয়ানডে প্রতিযোগিতা রয়্যাল লন্ডন কাপের দলগুলো ২০১৫ সালে যেখানে ওভারপ্রতি ৫.৩৮ গড়ে রান তুলেছিল, ২০১৯ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৫.৯৯-এ। উঠতি ক্রিকেটাররা বুঝেছেন, সাবধানী ক্রিকেট খেলে আর যা–ই হোক, জাতীয় দলের দুয়ার খোলা যাবে না।
শুধু জাতীয় দলেই নয়, মরগানের এই অতি-আক্রমণাত্মক চিন্তাধারার প্রভাব পড়েছে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোতেও। ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ওয়ানডে প্রতিযোগিতা রয়্যাল লন্ডন কাপের দলগুলো ২০১৫ সালে যেখানে ওভারপ্রতি ৫.৩৮ গড়ে রান তুলেছিল, ২০১৯ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৫.৯৯-এ। উঠতি ক্রিকেটাররা বুঝেছেন, সাবধানী ক্রিকেট খেলে আর যা–ই হোক, জাতীয় দলের দুয়ার খোলা যাবে না।
আর এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে কুক-পরবর্তী যুগে মরগানের অতি আধুনিক চিন্তাধারার কারণে। ডাবলিনে জন্ম নেওয়া স্থিতধী এই ছেলের মস্তিষ্কের খেলাতেই ঘুচেছে ইংল্যান্ডের চিরন্তন আক্ষেপ, জিতেছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ।
শুধু ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের মধ্যে মরগানের অবদানকে সীমাবদ্ধ রাখলে অবিচার করা হবে। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের যে দলটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতল, সেখানেও ছিল মরগানের সগৌরব উপস্থিতি। ওয়ানডে ইতিহাসে ইংল্যান্ড যতগুলো ম্যাচ জিতেছে, তার মোটামুটি ২০ শতাংশই এসেছে মরগানের অধিনায়কত্বে। সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের যত সাফল্য, সব কটিতেই কোনো না কোনোভাবে আছে মরগানের ছোঁয়া। যে সাড়ে সাত বছর ইংল্যান্ডের দায়িত্বে ছিলেন, ইংল্যান্ড জিতেছে ৮২ ম্যাচ, হেরেছে ৩৭টায়। আগের সাড়ে সাত বছরে যেখানে ইংল্যান্ড ম্যাচ হেরেছিল দ্বিগুণের বেশি (৭৮টি)। আগের অধিনায়ক কুকের অধীনে যেখানে ওয়ানডেতে ৩২৫ রানের বেশি কখনো করতে পারেনি দলটা, মরগানের ইংল্যান্ড ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে তিনবার। যার সর্বশেষটা কয়েক দিন আগেই, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৪৯৮।
ওয়ানডে ইতিহাসে ইংল্যান্ড যতগুলো ম্যাচ জিতেছে, তার মোটামুটি ২০ শতাংশই এসেছে মরগানের অধিনায়কত্বে। সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের যত সাফল্য, সব কটিতেই কোনো না কোনোভাবে আছে মরগানের ছোঁয়া। যে সাড়ে সাত বছর ইংল্যান্ডের দায়িত্বে ছিলেন, ইংল্যান্ড জিতেছে ৮২ ম্যাচ, হেরেছে ৩৭টায়।
শুধু ব্যাটিংই নয়। বোলিং নিয়েও ইংল্যান্ডের সনাতনী চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনেছেন মরগান। গত প্রায় অর্ধযুগ ধরে সাদা বলের ক্রিকেটে রিস্ট স্পিনারদের যে উত্থান, তাতে সুর মিলিয়ে আদিল রশিদের মতো লেগ স্পিনারকে একের পর এক সুযোগ দিয়ে গেছেন। মরগানের আগে কোনো ইংলিশ অধিনায়কের অধীনে কোনো লেগ স্পিনার সাদা বলের ক্রিকেটে ৫ উইকেটের বেশি পাননি। সেখানে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে আদিল রশিদের উইকেট সংখ্যা ২৪৩, যার ২১১টাই এসেছে মরগানের অধীনে! ২০১৫ বিশ্বকাপের পরেই বুঝেছিলেন, ব্রড-অ্যান্ডারসনকে দিয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেট আর হবে না। তাঁদের জায়গায় একে একে পেসার হিসেবে খেলিয়েছেন জফরা আর্চার, ক্রিস ওকস, ডেভিড উইলি, টাইমাল মিলস, স্যাম কুরান, সাকিব মাহমুদ, ওলি রবিনসন, মার্ক উডদের।
পরিসংখ্যানের কচকচানি থেকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। কয়েক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কলকাতা নাইট রাইডার্সের পোস্ট করা এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে মরগান জানিয়েছিলেন, করোনাকালীন বাসায় বসে বসে বিশ্বখ্যাত দাবাড়ু গ্যারি ক্যাসপারভের কাছ থেকে দাবার দীক্ষা নিচ্ছেন তিনি। বেকার সময়ে দাবার কলাকৌশল রপ্ত করার মাধ্যমে মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোকে চাঙা করার চেষ্টা আরকি! মরগানের অধিনায়কত্ব যাঁরা গভীরভাবে লক্ষ করেছেন, তাঁদের কাছে মরগানের এই দাবাপ্রীতি চমক জাগাবে না মোটেও। অধিনায়ক মরগানের প্রতিটা পদক্ষেপই যে পাকা দাবাড়ুদের মতো প্রচণ্ড ‘ক্যালকুলেটিভ’, হিসেবি।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটার কথাই চিন্তা করুন। ফিঞ্চ-ওয়ার্নারের বিপক্ষে ইনিংসের প্রথম ওভারে কাকে বল করতে পাঠাতেন আপনি? হয় ওকস-মিলসদের গতির ওপর ভরসা রাখতেন, অথবা নিদেনপক্ষে মঈন আলীর মতো অফ স্পিনারকে আক্রমণে আনতেন। কিন্তু না। পেস বোলার দিয়ে ইনিংস উদ্বোধন করার মতো বহুলচর্চিত পথে হাঁটেননি মরগান, অফ স্পিনারদের বিপক্ষে ফিঞ্চের দুর্দান্ত রেকর্ডের কারণে মঈনের হাতেও বল তুলে দেননি। ভরসা রেখেছিলেন রিস্ট স্পিনার আদিল রশিদের ওপর। ইনিংসের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া সেদিন সেই যে ধাক্কা খেয়েছিল, তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। হেরেছিল ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আবার আদিল রশিদকে আক্রমণে এনেছিলেন সবার শেষে। মরগান জানতেন, পোলার্ড-রাসেলে সাজানো ক্যারিবীয়দের বিধ্বংসী লোয়ার অর্ডারকে বশ করতে লেগ স্পিনই মন্ত্র হতে পারে। মাত্র ২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মরগানের চিন্তাকে সার্থক করেছিলেন আদিল রশিদ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের টপ অর্ডারে এভিন লুইস, ক্রিস গেইল, শিমরন হেটমায়ার কিংবা নিকোলাস পুরানদের মতো একাধিক বাঁহাতি আছে দেখে মঈন আলীর মতো অফ স্পিনারকে দিয়ে সেদিন আক্রমণের সূচনা করেছিলেন মরগান। বলা বাহুল্য, সে পরিকল্পনাও সফল হয়েছিল। মাত্র ১৭ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়েছিলেন মঈন। যেকোনো গ্র্যান্ডমাস্টার দাবাড়ুর মতো এভাবেই আগে থেকে এক ধাপ বেশি চিন্তা করে রাখতেন মরগান।
এমন হিসাবি মানুষটা নিজের অবসরের জন্য ভিন্ন কারোর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করবেন না, সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টানা দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শূন্য রানে আউট হওয়ার পর মরগানের অবসরের ঘোষণায় বেশির ভাগ মানুষই চমকে গেলেও, যাঁরা মরগানকে চেনেন, তাঁরা চমকাবেন না। মরগান মানুষটাই এমন। সবার আগে নিজেই বুঝবেন, কখন কী করা দরকার। এমনকি নিজের বিদায়-রাগিণীর সুরটাও নিজেই বেঁধে দেবেন, কাউকে বাঁধতে দেবেন না।
গত বছরের শুরু থেকেই ব্যাটটা কথা শুনছিল না। সাদা বলের ক্রিকেটে এই সময়ে ২৪ ম্যাচ খেলে ১৮ ইনিংসে ১৮.৮৬ গড়ে রান তুলেছেন মাত্র ২৮৩। একজন খেলোয়াড় শুধু অধিনায়কত্বের সুবাদেই দিনের পর দিন খেলে যাচ্ছেন, এমন ‘সুবিধা’ মরগান নিজেও চাননি হয়তো। অধিনায়কত্বের ক্ষেত্রেও সাম্প্রতিক সময়ে মরগানের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছিল নেতা হিসেবে স্টোকস-বাটলারদের উত্থান। কুঁচকি বা পিঠের চোটের কারণে যখনই মরগান মাঠের বাইরে থেকেছেন, স্টোকস-বাটলার উদ্ভাবনী নেতৃত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মরগান না থাকলেও সমস্যা নেই, তাঁরা আছেন। মরগান না থাকলেও মরগানের দর্শন সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার কান্ডারি আছে ইংল্যান্ড দলে।
দলে কোন খেলোয়াড়ের উপযোগিতা কখন শেষ হচ্ছে, অধিনায়ক মরগান সেটাও ভালো বুঝতেন। যে কারণে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর সুযোগ পাননি জিমি অ্যান্ডারসন বা ইয়ান বেল, কিছুদিন পর আড়ালে চলে গিয়েছেন স্টুয়ার্ট ব্রডও। সুইং-জাদুতে দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর পরেও বিশ্বকাপের পরপরই ইংল্যান্ড দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন লিয়াম প্লাঙ্কেট। ২০১৫ সাল থেকে দলে যে হার না মানা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন, ওসব খেলোয়াড়দের দলে রেখে সেই সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করতে চাননি মরগান।
সময়ের ফেরে পরিস্থিতি এখন এমনই, নিজে দলে জায়গা আঁকড়ে পড়ে থাকলেই মরগানের হার না মানা, অকুতোভয় দর্শনের প্রতি অবিচার করা হতো—যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন তিনি নিজেই।