প্যারিস অলিম্পিক থেকে উৎপল শুভ্র
লাইলসের এই ব্রোঞ্জও তো আসলে জয়ই
করোনা আক্রান্ত হয়েও ২০০ মিটারে দৌড়েছেন নোয়াহ লাইলস। ১৯.৭০ সেকেন্ড সময় নিয়ে জিতেছেন ব্রোঞ্জ।
দৌড় শেষ করেই চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন ট্র্যাকে। একটু পর কোনোমতে উঠে বসলেন। বসেই থাকলেন। গত তিন বছর যে দূরত্ব তাঁর আগে দৌড়াতে পারেনি কেউ, তাতে তৃতীয় হওয়ার হতাশায়?
উবু হয়ে বসে থাকা নোয়াহ লাইলসকে মিডিয়া ট্রিবিউনের চারতলা উচ্চতা থেকে তখন আর দেখা যাচ্ছে না। আড়াল হয়ে গেছেন তাঁকে ঘিরে ধরা মেডিকেল বিভাগের চার-পাঁচজনে। কিছুক্ষণ এভাবেই কাটল। স্তাদ দে ফ্রান্সের প্রায় ৮০ হাজার দর্শকের মধ্যে একটা বিস্ময়ধ্বনি তুলে ট্র্যাকে ঢুকল হুইলচেয়ার। তাতে বসেই ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে গেলেন নোয়াহ লাইলস। তাহলে কি চোট নিয়েই দৌড়েছেন? এ কারণেই তিন বছর পর ২০০ মিটারে প্রথম পরাজয়?
অলিম্পিকে বিশেষজ্ঞ ভাষ্যকার হিসেবে বিবিসিতে কাজ করছেন ২০০ ও ৪০০ মিটারের কিংবদন্তি মাইকেল জনসন। চোট-টোটের সম্ভাবনা তাৎক্ষণিকভাবেই উড়িয়ে দিয়েছেন এই বলে, চোট নিয়ে কেউ ১৯.৭০ সেকেন্ডে ২০০ মিটার দৌড়াতে পারে না। তাহলে? তাহলে লাইলস হুইলচেয়ারে কেন?
একটু আফসোসই লাগে, ভরা স্টেডিয়ামে অ্যাথলেটিকস দেখার মজাটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে অজানাই থেকে গেল। উৎসবমুখর স্টেডিয়ামে একসঙ্গে চলছে অনেক ইভেন্ট। হয়তো আপনি একটা দৌড় শেষে প্রতিযোগীরা কে কী করছে দেখছেন, হঠাৎই একটা হর্ষধ্বনি উঠল। কী ব্যাপার? উল্টো দিকে লং জাম্পে কেউ হয়তো বড় একটা লাফ দিয়েছেন অথবা পোল ভল্টে বিশ্ব রেকর্ড হয়ে গেছে এই মাত্র। বৃহস্পতিবার রাতেই যেমন মিডিয়া ট্রিবিউন থেকে দূরের প্রান্তে মেয়েদের লং জাম্প হচ্ছে। মাঝখানে চলছে জ্যাভেলিন। যাতে প্রথম থ্রোতে ডিসকোয়ালিফায়েড হওয়ার পর দ্বিতীয় থ্রোতেই অলিম্পিক রেকর্ড ভেঙে সোনার দাবি জানিয়ে ফেলেছেন পাকিস্তানের আরশাদ নাদিম। লড়াই হচ্ছে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতের নীরজ চোপড়ার সঙ্গে।
অলিম্পিকের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে অকল্পনীয় ভারত-পাকিস্তান লড়াই দেখছে স্তাদ দে ফ্রান্স। যাতে একটু বিরতি ছেলেদের ২০০ মিটারের জন্য। সেটি সবাইকে হতবাক করে দেওয়ার পর মেয়েদের ১০০ মিটার আর ছেলেদের ৪০০ মিটার হার্ডলস। যার প্রথমটিতে বিশ্ব রেকর্ডও গড়ে ফেললেন যুক্তরাষ্ট্রের সিডনি ম্যাকলাফলিন-লেভরোন। মেয়েদের ১০০ মিটার হার্ডলসে প্রথম ৫২ ও ৫১ সেকেন্ডের ব্যারিয়ার ভাঙা ম্যাকলাফলিন নিজের বিশ্ব রেকর্ড নিজেই ভেঙে মাথায় মুকুট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বিশ্ব রেকর্ড স্টেডিয়ামের পুরো আবহটাই কেমন যেন বদলে দেয়। বাতাসও যেন বিদ্যুতায়িত। কিন্তু এই রাতে বিশ্ব রেকর্ডও গৌণ, বাকি সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে একটা প্রশ্নই—কী হয়েছে নোয়াহ লাইলসের?
মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের জটলাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। কিন্তু উত্তরটা দেবে কে? মিক্সড জোনের পাশের করিডর দিয়ে লাইলসের হুইলচেয়ার মেডিকেল রুমে গিয়ে ঢুকেছে। সাংবাদিকদের অনেকে সেই করিডরেই দাঁড়িয়ে। ‘কোভিড’, ’কোভিড’ বলে ফিসফিসানিটাও সেখান থেকেই উঠল। পরে যা নিজেই জানাবেন নোয়াহ লাইলস।
প্রথমে আমেরিকান টিভি চ্যানেল এনবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। পরে মিক্সড জোনে এসেও। মুখে থাকবে কালো রঙের মাস্ক। অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ১০০ মিটার জেতার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যা শনাক্ত হয়েছে। অলিম্পিক ভিলেজের পাশের একটা হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্র অলিম্পিক দলের মেডিকেল টিম, কোচ আর মা ছাড়া যা আর কেউ জানতেন না। মা কেইশা কেইন আবার লাইলসের ম্যানেজারও। কাশির দমকে দুই রাত ভালোমতো ঘুমাতেই পারেননি।
তিন বছর আগে টোকিওতে যখন প্রথম অলিম্পিক পদক জিতেছিলেন, কোভিডের থাবায় এই পৃথিবী তখন বিপর্যস্ত। লাইলস যখন নিজেই নিজের গলায় ব্রোঞ্জপদক ঝুলিয়ে দিচ্ছেন, স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তখন খাঁ খাঁ শূন্যতা। টোকিও অলিম্পিকের পর ২০০ মিটারে আর কেউ হারাতে পারেননি তাঁকে। ১০০ মিটার তো শুরু করলেন মাত্রই গত বছর। ২০০ মিটারই তাঁর প্রিয় ইভেন্ট। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে টানা তিন সোনা। টানা সাত বছর র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। না, যাঁর বিশ্ব রেকর্ড ১৬ বছর ধরে অক্ষত, সেই উসাইন বোল্টও সাত বছরের ওই কীর্তিটা করতে পারেননি।
বোল্টের সঙ্গে লাইলসের মিল আছে। দৌড় শুরুর আগে নানা অঙ্গভঙ্গি করে দর্শককে অংশ করে নিতেন বোল্ট। দর্শকের চিৎকারই ছিল তাঁর জ্বালানি। প্রতিযোগীদের কেউ কেউ কখনো কখনো এ নিয়ে অভিযোগও করেছেন। বোল্টের ওসব কর্মকাণ্ড নাকি তাঁদের মনঃসংযোগে সমস্যা করে।
নোয়াহ লাইলসকে দেখার পর কারও মনে হতেই পারে, বোল্ট তো আসলে কিছুই করতেন না! ১০০ মিটারের মতো ২০০ মিটারেও ট্র্যাকে ঢুকেছেন লাফিয়ে লাফিয়ে। অন্য স্প্রিন্টাররা যেখানে নাম ঘোষণার পর একবার হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছেন নিজের লেনে, লাইলস স্টার্টিং ব্লকে ফিরেছেন লাফিয়ে লাফিয়ে ২৫–৩০ মিটার দৌড়ানোর পর। পরে আবারও প্রতিযোগীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় এমন লাফ দিয়েছেন যে পেছনে লেন নম্বর লেখা বোর্ডটা পড়ে গেছে। ‘অগ্রহণযোগ্য আচরণ’-এর জন্য দেখেছেন হলুদ কার্ড।
অলিম্পিকে এসেছিলেন নতুন ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। ১০০, ২০০ মিটার ও ১০০ মিটার রিলেতে সবকিছু ঠিকঠাক চললে ৪০০ মিটার রিলেতেও কি দৌড়ানো যায়? তাহলে অলিম্পিক ইতিহাসে প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে ট্র্যাকে চার সোনার প্রথম কীর্তি হয়ে যায়। যেখানে একটি সোনা আর একটি ব্রোঞ্জেই শেষ লাইলসের অলিম্পিক। সান্ত্বনা তো আছেই, একটু গর্বও। কোনো মানুষের কাছে তো হারেননি। কোভিড নিয়ে দৌড়েও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পাওয়াটাও কি জয় নয়!