টি-টেন ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কী
একই দিনে করা দুটি মন্তব্য। একটি ট্যামি বেমন্টের। অন্যটি জেসন হোল্ডারের।
ইংল্যান্ড নারী ক্রিকেট দলের ওপেনার বেমন্টের মন্তব্যটা ওয়ানডে নিয়ে। বেশ কিছুদিন ধরেই ৫০ ওভারের ক্রিকেট আদি সংস্করণ টেস্ট আর জনপ্রিয়তম সংস্করণ টি–টোয়েন্টির মধ্যে ‘স্যান্ডউইচড’ হয়ে আছে। এই সংস্করণ টিকে থাকবে কি না বা পুরোদমে টিকিয়ে রাখার আদতে কোনো দরকার আছে কি না, এ নিয়ে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। গত মাসে শেষ হওয়া বিশ্বকাপের সময় যা নতুন করে গতি পেয়েছে। ‘হু সুইচ’ নামের একটি পডকাস্টে অংশ নেওয়া বেমন্ট নিজের মত তুলে ধরে বলেছেন, ওয়ানডে ক্রিকেটের টিকে থাকা দরকার। এ নিয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনা ও ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
একই দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অলরাউন্ডার হোল্ডারও কথা বলেছেন ‘টিকে থাকা’ নিয়ে। এই টিকে থাকা টি–টেনের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক অধিনায়ক এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে আবুধাবি টি–টেন লিগে খেলছেন। তাঁর মতে দশ ওভারের এই ক্রিকেট ‘টিকে থাকার জন্যই এসেছে।’
একই দিনে করা হোল্ডার ও বেমন্টের মন্তব্য দুটির মূল সুর কিন্তু একে অন্যের বিপরীত। একদিকে ওয়ানডের অস্তিত্ব নিয়ে হতাশা, আরেক দিকে টি–টেন নিয়ে প্রবল আশা। দুটি সংস্করণের মধ্যে মোটাদাগে পার্থক্য হচ্ছে—৫০ ওভারের ক্রিকেট আইসিসি স্বীকৃত তিন সংস্করণের একটি। আর টি–টেন এখনো পায়ের তলায় মাটি খুঁজতে ব্যস্ত। পৃথিবীর নানা প্রান্তে একের পর এক টি–টেন টুর্নামেন্টের আয়োজন এই সংস্করণের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করে তুলছে বলেই ধারণা অনেকের। কিন্তু এমন অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্নও ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্রিকেটের নবতর এই সংস্করণে, যা এর ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে।
আইসিসি কর্তৃক স্বীকৃতি না হলেও টি–টেন নিজেকে আলোচনায় ধরে রেখেছে বিভিন্ন দেশে আয়োজিত লিগের মাধ্যমে। এর প্রথম এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আলোচিত লিগটি আবুধাবির। এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সঙ্গে লিগটির আয়োজনে আছে টি–টেন স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট। ২০১৭ সালে আয়োজিত প্রথম আসরে দল ছিল ৬টি, খেলা হয়েছিল মাত্র ৪ দিন। বেশির ভাগ দলই এক দিনে খেলেছে দুটি করে ম্যাচ। তবে পরের বছরই দল বেড়ে হয় ৮টি, টুর্নামেন্টের ব্যাপ্তি বেড়ে হয় ১০ দিনের।
একই বছর ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আবুধাবি টি–টেন লিগকে আধা–পেশাদার (সেমি–প্রফেশনাল) ক্রিকেট টুর্নামেন্টের মর্যাদা দেয়। এরপর প্রতিবছরই টুর্নামেন্টের আকার বেড়েছে। জনপ্রিয় ও তরুণ ক্রিকেটারের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে আবুধাবি টি-টেন লিগের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা রাজীব খান্না এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁরা প্রতিবছরই দর্শক এবং খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণের আগ্রহ বাড়তে দেখছেন। তাঁর তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে টুর্নামেন্টটিতে খেলার আগ্রহ দেখিয়ে নাম নিবন্ধন করেছিলেন ১ হাজার ৬০০ জন ক্রিকেটার। প্রথম বছরে টেলিভিশন দর্শক ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখ, যা ২০২১–২২ মৌসুমে ডিজিটাল স্ট্রিমিংসহ ৩৪ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হয়।
আবুধাবি টি-টেন লিগ যে আকারে ও জনপ্রিয়তায় সামনে এগিয়েছে, সেটি বোঝা যায় অন্যান্য দেশেও এই টুর্নামেন্টের প্রচলন হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে স্পেনে শুরু হওয়া ইউরোপিয়ান ক্রিকেট লিগ (ইসিএল) এখন ৩০ দলের টুর্নামেন্টে পরিণত হয়েছে। গত বছর সিপিএলের আগে ‘দ্য সিক্সটি’ নামের টুর্নামেন্ট আয়োজন শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ বছরের জুনে জিম্বাবুয়েতে আয়োজিত হয় ‘জিম–আফ্রো টি–টেন’ টুর্নামেন্ট। কাছাকাছি সময়ে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড বছরের শেষ দিকে লঙ্কা টি–টেনের ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও একই পরিকল্পনা শোনা গেছে।
দেশে দেশে বিস্তৃত হতে শুরু করা টি–টেনে খেলতে আগ্রহ বেড়েছে জনপ্রিয় ক্রিকেটারদেরও। এবারের আবুধাবি টি-টেনেই যেমন কুইন্টন ডি কক, ট্রেন্ট বোল্টের মতো ক্রিকেটাররা খেলছেন। হোল্ডারও তাই দশ ওভারের এই সংস্করণের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎই দেখছেন। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক এউইন মরগান তো আগামীর ক্রিকেটে টি–টেনের বড় ভূমিকাই দেখছেন। ২০২০ সালেই মরগান বলেছিলেন, অলিম্পিকে ক্রিকেট সংযোজন করতে টি–টেনই উপযুক্ত সংস্করণ। যে মন্তব্য সমর্থন করেছিলেন বীরেন্দর শেবাগ আর শহীদ আফ্রিদিও।
তবে আপাতত এই জায়গাটিতেই কিছুটা পিছিয়ে গেছে টি-টেন। আইসিসি স্বীকৃত সংস্করণ নয় বলে অলিম্পিকে প্রবেশের সুযোগ পায়নি সেটি। গত অক্টোবরে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ক্রিকেটকে যুক্ত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সেটি টি–টোয়েন্টি সংস্করণ। টি–টেনকে স্বল্প সময় আর দ্রুত সমাপ্তির খেলা হিসেবে এগিয়ে রাখা হলেও আইসিসির অনুমোদন না থাকায় আপাতত অলিম্পিক মঞ্চের বাইরেই থাকতে হচ্ছে।
টি-টেনের জন্য আরেকটি নেতিবাচক দিক পূর্ণ সদস্যদেশগুলোতে এখন পর্যন্ত ব্যাপক প্রচলন না হওয়া। পূর্ণ সদস্যদেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়েতেই এই সংস্করণের টুর্নামেন্ট হয়েছে। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র দক্ষিণ এশিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড এখনো দশ ওভারের ক্রিকেটকে সেভাবে গ্রহণ করেনি (যদিও ইংল্যান্ডে দ্য হান্ড্রেড আছে; তবে সেটি ১০০ বলের)। ক্রিকেট নিয়ে ব্যাপক উন্মাদনা নেই, এমন দেশগুলোতে টি–টেন টুর্নামেন্ট জনপ্রিয় হওয়ার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে—গড়াপেটার সুযোগ।
যেহেতু শীর্ষস্থানীয় বেশির ভাগ ক্রিকেটারের অংশগ্রহণ থাকে না, ‘লো–প্রোফাইল’ অনেকেই সুযোগ পান। আর এখানেই ফিক্সিংয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে আবুধাবি টি-টেন লিগে ফিক্সিংয়ের চেষ্টায় আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের নাসির হোসেনও। এবারের আসরেই চেন্নাই–নর্দার্ন ম্যাচে ভারতের অভিমন্যু মিঠুন নামের এক পেসার বড় একটি নো বল করে ফিক্সিংয়ের সন্দেহ আরও উসকে দিয়েছেন। যে ‘নো বল’ মনে করে দিয়েছে এক যুগের বেশি সময় আগে পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমিরের করার স্পট ফিক্সিংয়ের নো বলকে। এ ছাড়া গত মাসেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ক্রিকেটার মারলন স্যামুয়েলস ২০১৯ টি–টেন লিগে ফিক্সিংয়ের দায়ে ৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধই হয়েছেন।
ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে উঠলেও টি–টেনে একাধিক অভিযোগ ও সন্দেহজনক ঘটনা এই সংস্করণের বিস্তৃতিতে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলছে। তবে এত কিছুর পরও আশাবাদীর সংখ্যাই সম্ভবত বেশি। কম সময়, গতিময় ক্রিকেটের যে উপাদান ‘বিক্রি’ করে টি–টোয়েন্টি দ্রুতই ক্রিকেটের আঙিনায় নিজের অবস্থান শক্ত করে নিয়েছে, সে উপাদান এই টি–টেনে আরও বেশিই আছে বলে মনে করেন অনেকে।
এখন দেখার পালা, টি–টেন সেটা কাজে লাগাতে পারে কি না!