এটাই কি খেলার সবচেয়ে সুন্দর ছবি
সিনেমাটা মেয়েদের বেসবল নিয়ে। মুক্তি পেয়েছে ১৯৯২ সালে—‘আ লিগ অব দেয়ার ওউন।’ এভলিন নামের এক খেলোয়াড় মাঠে ভুলের পর ভুল করে ফেরার পর কোচ চরিত্রে অভিনয় করা টম হ্যাংকস তাঁকে চড়া গলায় বকা দেন। ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেন এভলিন। টম হ্যাংকসের মেজাজও সপ্তমে চড়ে বসে। সোজা বলে দেন, ‘বেসবলে কান্নাকাটির কোনো জায়গা নেই।’
খেলাধুলা কান্নাকাটির জায়গা নয়, এই কথাটা যেমন সত্য, তেমনি এই খেলাধুলাই কখনোসখনো ভেজা চোখ ছাড়া পূর্ণতা পায় না। কিংবদন্তিদের বিদায়ের সময় তাঁদের ভেজা চোখগুলো স্মরণ করুন। ওসব দৃশ্য দেখে দু–একজন ভক্ত চোখ না মুছলে খেলাধুলার আর কী মহিমা! তবে এই কথাও উঠতে পারে, এ তো খেলাধুলার চিরায়ত ছবি, যে কারও বিদায়ের সময়ই হতে পারে। কিন্তু কারও বিদায়ে তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে কি কখনো কাঁদতে দেখা গেছে?
এই প্রশ্নের মেয়াদকাল রাতে সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যটার আগপর্যন্ত। কারণ, তারপর অনেকের পৃথিবীই পাল্টে গেছে। সেই পৃথিবী, এই বিশ্বসংসারে জীবনকে বয়ে নেওয়ার মাঝে ক্রীড়াপ্রেমীরা কল্পনায় যে ‘পৃথিবী’ আঁকেন, মনের তুলিতে নিজের পছন্দের খেলোয়াড়দের যে যাঁর মতো করে সাজান—এই পার্থিব জীবনের নানান ঝক্কি–ঝামেলা এড়িয়ে জীবনটাকে আরেকটু উপভোগ করবেন বলে। মনের পটে আঁকা সেই পৃথিবীতে এখন অনেকেই খিল দিয়েছেন। ভেতরে একা বসে। মাছ যেমন জলের, পাখি যেমন আকাশের, রজার ফেদেরারও তেমনি আয়তাকার ওই টেনিস কোর্টের। মনের ভেতর তেমন কোর্ট কাটা পৃথিবী বানিয়ে তাঁকে নিয়ে বসবাস ছিল ভক্তদের। এখন সেখানে ফেদেরার না থাকা মানে তো জলের মাছ ডাঙায়, মুক্ত আকাশের পাখি খাঁচায়...শুধু ভক্তরা একা বসে মিথ্যা করে হলেও তাঁর ফেরার অপেক্ষায়। দমবন্ধ অনুভূতি।
ভক্তদের না হয় এমন হয়, হচ্ছে, হবে। কিন্তু তাঁর ‘চিরশত্রু’র কেন চোখ ভিজে উঠবে? এই বিশ্বসংসারে তো সে নিয়ম নেই। এখানে মানুষ শুধু নিজের জন্য—এই উত্তর–আধুনিক যুগে কথাটা আরও বেশি সত্য। আর দুজনেই এই পৃথিবীরই আলো–বাতাসে বেড়ে উঠেছেন। দৃশ্যটা তাই মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। দেখে মনে হয়, যা দেখছি, তা এই পৃথিবীতে ঘটছে না।
মুহূর্তটা একবার স্মরণ করে দেখুন। চেয়ারে পাশাপাশি বসে দুজন মানুষ। এমন দুজন, ২০০৪ থেকে ২০১৯—এই ১৫ বছরে আগুনে সব দ্বৈরথ উপহার দিয়েছেন। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’—কথাটা আক্ষরিকভাবেই প্রয়োগ করা যায় এই দুজনের ক্ষেত্রে। এই পৃথিবীর মানুষের মতো তাঁদের লড়াইয়ের ধরনও আলাদা। জীবনযুদ্ধে কেউ একটু নরম হলেও কুশলী, কেউ আবার কুশলী হয়েও পাথরের মতো দৃঢ়চেতা—পৃথিবীর সব মানুষই এ দুটি ধারায় বিভক্ত—অর্থাৎ ভেতরে ভেতরে আমরা সবাই ফেদেরার কিংবা নাদালেরই প্রতিরূপ। আর তাই প্রায় সবারই ওই মুহূর্তটা মনে পড়ছে, মন পুড়ছে।
আক্ষরিক অর্থেই প্রায় সবাই! ক্রিকেটের ওয়েবসাইট ক্রিকইনফো থেকে বেসবল, বাস্কেটবল, ফর্মুলা ওয়ান, ফুটবল—প্রায় সব ভুবনেরই সংবাদমাধ্যম থেকে মানুষ ওই মুহূর্তের ছবি শেয়ার করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বাদ যাচ্ছে না গলির কোণে বেড়ে ওঠা একটা সাধারণ মানুষও। এমন যে দেখা যায় না! কী—তা বোঝাতে সেই মুহূর্তটা আবারও মনে করিয়ে দেওয়া যাক।
পাশাপাশি বসে দুজন মানুষ। দুজনই কাঁদছেন। ফেদেরার একটু নরমসরম, আবেগ সামলাতে পারেন না, আগেও কেঁদেছেন—২০০৩ সালে প্রথম উইম্বলডন জয়ের পর। ২০টি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের এই ‘ছবি’র শুরুতে এবং কাল শেষ তুলির আঁচড়েও কাঁদলেন, ফুঁপিয়ে। শুধু এবারের কান্নাটা সবকিছু হারানোর, যেন ভেতরে সর্বনাশা পদ্মার স্রোতের মতো কিছু একটা সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! অশ্রুর সেই স্রোত নাদালকে বুঝতে না দিতে ফেদেরারের সব রকম চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। নাদাল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসায় ফেদেরার তাঁর পাশেই একটু সামনে মুখ করে বসেছিলেন। নাদাল তখন চোখ মুছছেন আর ফেদেরার ফোঁপাচ্ছেন, কিন্তু কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছেন না। হঠাৎ ফেদেরার তাঁর বাঁ হাতটা আলতো করে নাদালের ডান হাতের ওপর রাখলেন। কান্নার দমক ছুটল, চোখের নদীতে বান। তখন কেমন লেগেছে? রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চক্রবর্তী ও মাখনলাল?
এই সমাজে ভাইয়ে ভাইয়ে খুনসুটি হয়, কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয়। আবার ভাইয়ের জন্য ভাই–ই এগিয়ে আসে সবার আগে। ভাইয়ের জন্য ভাই–ই কাঁদে। রবি ঠাকুরের ‘ছুটি’তে ফটিকের সঙ্গে মাখনের বৈরিতার ছবি ছিল, কিন্তু ফটিক ‘ছুটি’ (পড়ুন মৃত্যু) পাওয়ার পর রবি ঠাকুর মাখনের কান্নার ছবি আঁকেননি। গল্প সেখানেই শেষ। তবে যদি কারও জানতে ইচ্ছা হয়, ফটিক সেই কথাটা ‘মা আমার ছুটি হয়েছে, আমি বাড়ি যাচ্ছি’ বলার পর মাখনের কেমন লেগেছিল, তাহলে ফেদেরারের পাশে বসে নাদালের কান্নার ছবিটা দেখে নিতে পারেন। তাঁরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যখন টেনিস থেকে ছুটি নেওয়ার ব্যথায় কাতর, তখন নাদালের অশ্রুজলে লেখা হয়েছে অনুচ্চারিত সেই আহ্বান—‘ভাই, যাস নে! আমি খেলব কার সঙ্গে!’
ফেদেরার–নাদাল সেই মুহূর্তে থরো থরো আবেগের যৌথ প্রযোজনায় যে ছবিটি এঁকেছেন, সেখান থেকে চাইলে শিক্ষাও নেওয়া যায় আর তা শুধু খেলোয়াড়দের জন্য নয়। যে কেউ তা কাজে লাগাতে পারেন। বিশ্বাস না হয় ইতালির ডিফেন্ডার লিওনার্দো বোনুচ্চির ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পড়ুন, ‘এই ছবিটা শুধু খেলাধুলায় নয়, জীবনের জন্যই একটা শিক্ষা। আমাদের এটা প্রতিদিন দেখা উচিত। তোমাদের ধন্যবাদ, কারণ বেঞ্চে পাশাপাশি বসেও তোমরা অনুসরণীয় উদাহরণ তৈরি করো। কারণ, তুমুল দ্বৈরথেও তোমরা একে অন্যের প্রতি বন্ধুত্ব ও সম্মান বজায় রেখেছ, আর তাই কেউ কারও হাত কখনো ছাড়বে না—যা প্রতিটি প্রজন্মকে শেখানো উচিত।’
বিরাট কোহলি ফেদেরার–নাদালের সেরা সময়ের উত্তর–প্রজন্মের কেউ নয়। ছবিটা দেখে তাঁর মতো শক্ত মানসিকতার লোকেরও হৃদয় ভিজেছে, ‘কে ভেবেছে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীরা কখনো একে অপরের প্রতি এমন হতে পারে! এটাই খেলার সৌন্দর্য। আর আমার কাছে এটাই খেলাধুলা নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর ছবি। যখন প্রতিদ্বন্দ্বীরাও আপনার জন্য কাঁদবে, তখন বুঝতে পারবেন ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা আপনি কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছেন। দুজনের জন্য শুধুই সম্মান।’
সে দুজন টেনিসের ফটিক চক্রবর্তী আর মাখনলাল!