'টেস্ট ক্রিকেট ওপেনারদের জন্য দুঃস্বপ্ন'
>
টেস্ট ক্রিকেটে ১০ হাজার রানের স্বপ্ন দেখেন না। তবে কল্পনায় দেখেন, তাঁর রেখে যাওয়া রেকর্ডগুলো অটুট থাকবে অনেক দিন। মানুষের প্রশংসায় ভাসার ইচ্ছে নেই। শুধু আরজি, দুঃসময়ে যেন তাঁর কীর্তিগুলোকে কেউ ভুলে না যায়। প্রত্যাশার চাপে নুয়ে নয়, স্বাধীনভাবে মাথা তুলে খেলতে চান তামিম ইকবাল
* আট বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। সব মিলিয়ে কেমন গেল সময়টা?
তামিম ইকবাল: অনেক কিছু শিখেছি। ক্রিকেটার হিসেবে, ব্যক্তিগত জীবনেও। ভালো কিংবা খারাপ সময়ে কেমন থাকা উচিত। ক্রিকেট আসলে অনেক কিছু শেখায়। আমি কিছুটা হলেও শিখতে পেরেছি। তবে যতটুকু অর্জন করতে চেয়েছিলাম, মনে হয় না ততটুকু পেরেছি। যদি আরও আট বছর খেলতে পারি, সেটা হবে আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। ২৮ থেকে ৩২ বছর বয়সের মধ্যেই একজন ব্যাটসম্যান সবচেয়ে পরিণত থাকে, এটা তার সবচেয়ে ভালো খেলার সময়।
* এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো ও খারাপ সময় কোনগুলো?
তামিম: সবচেয়ে বাজে সময় গেছে এই বিশ্বকাপে। আগেও এক-দুবার খারাপ সময় গেছে। তবে বিশ্বকাপে সব দিক দিয়েই বেশি খারাপ গেছে। অতিরিক্ত বাজে হয়তো খেলিনি, ছয় ম্যাচে একটা ইনিংস ভালো খেলেছি। তারপরও এই সময়টা আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য সব দিক দিয়েই খারাপ কেটেছে। ভালো সময় বলতে এবারের পাকিস্তান সিরিজের কথা বলতে পারেন বা ২০০৯-১০ সালের কথাও আসতে পারে।
* বাংলাদেশের হয়ে তিন সংস্করণের ক্রিকেটেই সর্বোচ্চ রান আপনার। এখান থেকে ভবিষ্যতের জন্য কী করণীয় দেখছেন?
তামিম: আমাদের আগে যাঁরা বাংলাদেশের হয়ে বিভিন্ন রেকর্ড করেছেন, তাঁরা আমাদের মতো এত বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। তাঁদের তুলনায় বেশি ম্যাচ খেলছি বলেই রেকর্ডগুলো আমরা সহজে ভাঙতে পারছি। কিন্তু আমি চাই, আমার রেকর্ডগুলো যেন কেউ সহজে ভাঙতে না পারে। এসব রেকর্ড একদিন না একদিন কেউ ভাঙবেই। কিন্তু তাকে যেন কষ্ট করে ভাঙতে হয়। যত বেশি সময় সম্ভব রেকর্ডগুলো যেন আমার থাকে।
* ক্যারিয়ার শেষে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
তামিম: সবাই চায় টেস্টে ১০ হাজার রান করতে। তবে খুব বেশি টেস্ট খেলি না বলে আমাদের জন্য কাজটা কঠিন। হ্যাঁ, গত এক বছরে যে পরিমাণ ম্যাচ খেলেছি, এ রকম খেললে হয়তো ১০ হাজার রানের টার্গেট করতে পারি। তা না হলে ক্যারিয়ার শেষে সর্বোচ্চ সাত-আট হাজার রান হতে পারে। ৪৫ থেকে ৫০ গড় রেখে এটা হলেই আমি খুশি। ওয়ানডেতে দেড় শ ম্যাচ খেলে সাড়ে ৪ হাজারের মতো রান করেছি। আরও দেড় শ ম্যাচ খেলে গড়ে ৫০ করে করলে ৮-৯ হাজার রানের সম্ভাবনা আছে। এক-দুই মৌসুম খুব ভালো গেলে ১০ হাজারও হতে পারে। সবকিছু নির্ভর করবে ফর্ম আর ফিটনেসের ওপর।
* শুরুর দিকে খুব আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতেন। এখনো যে করেন না, তা নয়। তবে এখনকার ব্যাটিং অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত। পরিবর্তনটা কীভাবে এল?
তামিম: আসলে প্রথম ২০-৩০ ম্যাচে আমার প্রতি মানুষের অত প্রত্যাশা ছিল না। কীভাবে, কেন আউট হচ্ছি—এসব নিয়ে আলোচনা হতো না। আমি আমার মতো খেলতাম। কিন্তু যখনই মানুষের প্রত্যাশা বাড়ল, আমিও নিজের চরিত্র থেকে সরে অন্যভাবে খেলা শুরু করলাম। আমার মনে হচ্ছিল রান না করলে সমস্যা হবে। এটা আমার জন্য ভালো হয়নি। সেঞ্চুরি করেছি, বেশ কয়েকটা ফিফটিও করেছি। কিন্তু একটা ইনিংসও উপভোগ করিনি। নিজের খেলাটাই তো খেলতে পারছিলাম না! এমন না যে টিম ম্যানেজমেন্ট আমাকে খেলা বদলাতে বলেছে। সমস্যা ছিল একটাই—আমার আত্মবিশ্বাস ছিল না। তবে এ বছর পাকিস্তান সিরিজ থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি ইনিংস উপভোগ করেছি। এখনো আমি আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করি, তবে অনেক নিয়ন্ত্রিত।
* এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কার খেলা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?
তামিম: সবচেয়ে ভালো লাগে আমাদের মুমিনুলের খেলা। টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই খেলার সুযোগ পেলে ও বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিতে পারবে। দুই ফরম্যাটে খেলার সামর্থ্যও ওর আছে। সৌম্যর ব্যাটিংও দারুণ লাগে। তবে একটা সময় আসবে যখন চার-ছয় ওর ব্যাটে লাগবে না। তখন যেন মানুষ না বলে, কেন মারতে গিয়ে আউট হলো? এ রকম হলে ওর খেলাও বদলে যাবে। এটা আমি চাই না। সৌম্য যেভাবে খেলে, এটাই তার কোয়ালিটি। এই কোয়ালিটিটা যেন থাকে।
* আর কোনো ব্যাটসম্যান কি আছে; শট সিলেকশন, ব্যাটিংয়ের মানসিকতা—সব মিলিয়েই যাকে আদর্শ মনে হয়?
তামিম: এবি ডি ভিলিয়ার্স। পুল, কাট, ড্রাইভ, ফ্লিক—বিশ্বে সম্ভবত এই একজনই আছে, সবই যার নিখুঁত।
* ব্যাটসম্যান হিসেবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে কার বোলিং?
তামিম: মরনে মরকেল। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য ভয়ংকর বোলার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেরোম টেলরও একই রকম। অ্যান্ডারসনের কথাও বলতে হয়। স্পিনারদের মধ্যে অশ্বিন। অ্যাকশন বদলানোর আগে আজমলকে খেলাও কষ্টকর ছিল।
* বিশেষ কোনো স্পেল বা ওভারের কথা কি মনে পড়ে, যেটাতে বোলারের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এবং তাতে আপনি জিতেছেন?
তামিম: দুটি ঘটনা আছে। একটা হলো ওল্ড ট্রাফোর্ডে স্টিভেন ফিনের সঙ্গে। আগের টেস্টে ১০৩ করে পুল করতে গিয়ে আউট হয়েছিলাম। সে জন্য ওই টেস্টে প্রচুর শর্ট বল করছিল ওরা। আমি তাদের পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য করি। এ ছাড়া ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংসে ওহাব রিয়াজের ৩-৪ ওভারের ছোট একটা স্পেল ছিল। ভালো রিভার্স সুইং হচ্ছিল, যেটা খেলতে আমরা খুব অভ্যস্ত নই।
* শুরুর দিকে আপনার হাতে খুব বেশি শট ছিল না। এখন তো মোটামুটি সবই খেলেন। সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান কোন শটটা খেলে?
তামিম: ওই সময়ের তুলনায় এখন আমার অন্তত ৫০-৬০ ভাগ শট বেড়েছে। ফ্লিক করে চার মারলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। এ ছাড়া কাভার ড্রাইভ আর পুল শটে চার পেলেও মজা লাগে। এই তিনটি শটের কোনো একটা মারতে পারলেই আমি তেতে উঠি।
* কোনো কারণে ওপেনার না হলে কোন জায়গায় ব্যাট করতে চাইতেন?
তামিম: (হাসি) জীবনে কখনো ওপেনিং ছাড়া তিন নম্বরেও ব্যাটিং করেছি কিনা সন্দেহ। ওয়ানডেতে আমি ওপেনই করতে চাইব। তবে টেস্ট ক্রিকেটে সুযোগ পেলে হয়তো চার-পাঁচ নম্বরে ব্যাটিং করতে চাইতাম।
* কেন?
তামিম: কারণ টেস্ট ক্রিকেট ওপেনারদের জন্য দুঃস্বপ্ন। অনেক সময় দিনের শেষে তিন ওভারের জন্যও মাঠে নামতে হয়। তিন ওভারে আপনি কী করবেন! একটাই উপায়—বাঁচো। আবার প্রতিপক্ষ হয়তো বেশি রান করে দিন শেষ হওয়ার ১০ ওভার আগে ইনিংস ছেড়ে দিল। ওপেনার হলে সারা দিন ফিল্ডিং করেও ওই সময় আপনাকে ব্যাট হাতে নামতে হবে। চার-পাঁচে হলে তাও একটু বিশ্রাম পাওয়া যায়। বলটাও পুরোনো হয়। যেকোনো উইকেটে নতুন বলে খেলাটাই টেস্টে সবচেয়ে কঠিন কাজ। অবশ্য এখন বললেও চার-পাঁচে খেলতে পারব না। জানিই না ওখানে নেমে কী করতে হয়।
* ওয়ানডে ও টেস্টে সেরা ইনিংস?
তামিম: টেস্টে ওল্ড ট্রাফোর্ডের সেঞ্চুরি। অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল ওটা। ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২৫ রানের ইনিংস।
* তামিম ইকবালের ভালো ইনিংসগুলো মানুষ খুব কম সময় মনে রাখে। তাই দু-একটি ইনিংস খারাপ গেলেই সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। আপনার মনে এটা কী রকম প্রভাব ফেলে?
তামিম: মানুষ কেন আমার ভালো সময়টা মনে রাখে না, এর উত্তর আমিও খুঁজছি। এভাবে আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাকেই কঠিন করে দেওয়া হয়। কেন যেন মনে হয়, অনেক বড় বড় ব্যক্তি থেকে শুরু করে দর্শকেরাও ভাবে, চাপ দিলেই বুঝি তামিম ভালো খেলবে। আল্লাহর রহমত আছে বলেই হয়তো যখনই কথা উঠে, আমি ভালো খেলে ফেলি। তবে ওই মুহূর্তগুলোতে আমার ওপর দিয়ে কী যায় সেটা আমিই জানি। এই মানসিকতা বদলানো উচিত। চাপ দিয়ে কারও কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্স আশা করা উচিত না।