করোনার মধ্যে ক্রিকেট ফিরেছে আগেই। এবার বাংলাদেশে ফিরতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও। তিন ওয়ানডে ও দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে আজ সকালেই ঢাকায় পৌঁছাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল। আইসিসির এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানেরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন ঘটবে এই সিরিজ দিয়েই।
কাল প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিব কথা বলেছেন প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং দীর্ঘ বিরতির পর নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার প্রস্তুতি নিয়েও।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: প্রথমেই অভিনন্দন। ঘরে নতুন অতিথির আগমন ঘটতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের সবাই ভালো আছে নিশ্চয়ই...
সাকিব আল হাসান: আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিকঠাক আছে। মার্চের দ্বিতীয় ভাগেই আশা করি আমাদের তৃতীয় সন্তানের আগমন ঘটবে। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
প্রশ্ন :
প্রায় ১০ মাস পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে যাচ্ছে। এই সিরিজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরবেন আপনিও। সব মিলিয়ে সিরিজটাকে কীভাবে দেখছেন?
সাকিব: আমার তো মাঠের বাইরে প্রায় দেড় বছরই হয়ে গেল...। খেলায় ফিরতে পারবে সবাই, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। তবে খেলায় ফেরার সঙ্গে প্রত্যাশা থাকে, চাওয়া-পাওয়া থাকে। সে জায়গা থেকে সবাই অবশ্যই চাইবে ভালো করতে। আমার মনে হয় কাজগুলো সহজ হবে না। কে কত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
প্রশ্ন :
করোনা বিরতির পর দুটো আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। অন্যদিকে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ঘরোয়া দুটো টুর্নামেন্ট ছাড়া কিছুই খেলেননি। প্রত্যাবর্তন সিরিজে কোন জায়গাগুলোতে আপনাদের বেশি সমস্যায় পড়তে হতে পারে?
সাকিব: ধৈর্য আর সময়ের খেলা যেহেতু, টেস্টেই সমস্যা বেশি হতে পারে। অবশ্য ওয়ানডে সিরিজ যেহেতু আগে হচ্ছে, সেটা আমাদের সাহায্য করবে। টেস্টের কিছুটা প্রস্তুতি হয়ে যাবে ওয়ানডেতে।
প্রশ্ন :
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের মূল অনেক খেলোয়াড় আসছেন না। বাংলাদেশ দলের জন্য কতটা ভালো হলো এতে?
সাকিব: একটা দলের নিয়মিত খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে যদি কিছু খেলোয়াড় না আসে, সেটা প্রতিপক্ষ দলের জন্য অবশ্যই একটা সুবিধা। তবে সুবিধাটা কাজে লাগানো আমাদের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হবে।
কাউকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। দিন শেষে এটা তো ব্যাট আর বলেরই খেলা, নামের খেলা তো না!
প্রশ্ন :
ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দল দেখে কি ২০০৯ সালের সফরের কথা মনে পড়ে? সেবারও ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিয়মিত অনেক খেলোয়াড় ছিলেন না এবং আপনার নেতৃত্বে টেস্ট, ওয়ানডে দুটো সিরিজই বাংলাদেশ জিতেছিল...
সাকিব: দেুখন, ২০০৯ সালের কথা যদি বলেন, ওই দলের অনেক খেলোয়াড়ই কিন্তু পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে নিয়মিত হয়েছে। কেমার রোচ এখনো খেলছে। ড্যারেন সামি ওদের দু-দুটি বিশ্বকাপ জিতিয়েছে। কাজেই ওই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ একদমই খারাপ দল ছিল, এটা বলা যাবে না। হয়তো ওদের সেরা দলটা ছিল না। তবে যারা খেলেছে, পরে তারা ভালো করেছে। মূল খেলোয়াড়েরা ফিরে আসার পর সেই দলেও তারা খেলেছে। কাউকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। দিন শেষে এটা তো ব্যাট আর বলেরই খেলা, নামের খেলা তো না!
প্রশ্ন :
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আপনিই তো বলেছেন, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের জিততে না পারাটাই হবে হতাশার...
সাকিব: যারা ভালো খেলবে, তারাই জিতবে। এবারও হয়তো দেখবেন ওদের অনেক খেলোয়াড় পারফর্ম করে দলে জায়গা করে নিচ্ছে। আর এমন তো নয় ওদের খেলোয়াড়দের আমরা চিনি না, জানি না। ওদের কেউ কেউ সিপিএলে বা অন্য ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করেছে, জাতীয় দলে খেলেছে। যারা আসছে না, তারা কিন্তু টি-টোয়েন্টির বড় নাম। এমন নয় যে টেস্টের যারা বড় নাম, তারা আসছে না।
প্রশ্ন :
হ্যাঁ, টেস্টে তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল পেসাররা আসছেন। এত দিন পর খেলায় ফিরে ব্যাটিংটা নিশ্চয়ই বেশি কঠিন হবে আপনাদের জন্য...
সাকিব: আমি এভাবে দেখি না। গতবার যখন এল, আমরা তো ওদের সেরা দলকেই খুব ভালোভাবে হারাতে পেরেছি। সেই আত্মবিশ্বাসটা থাকা উচিত।
প্রশ্ন :
নিজের কথা বলুন। এক বছরের বেশি সময় পর আবার আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলবেন। প্রস্তুতি কেমন?
সাকিব: আজ (গতকাল) সারা দিন ব্যাগ, খেলার জিনিসপত্র গোছালাম। কাল (আজ) হোটেলে উঠে যাব। এমনিতে তো সব গোছানোই থাকত। খেলা এলে ছোটখাটো কিছু জিনিস এদিক-সেদিক করা লাগত। কিন্তু এবার মনে হলো সেই প্রথমবার ব্যাগ গোছানোর মতো অবস্থা। নতুন করে সব পরিকল্পনা করতে হচ্ছে।
প্রশ্ন :
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে খেলেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আলাদা ব্যাপার। সিরিজ নিয়ে নিশ্চয়ই খুব রোমাঞ্চিত?
সাকিব: অবশ্যই রোমাঞ্চিত, বলতে পারেন আমি অনেক বেশি রোমাঞ্চিত। রোমাঞ্চের সঙ্গে প্রত্যাশাও আছে অনেক। যতই অনেক দিন পর খেলি, মানুষ তো আশা করবে আমি যেখানে থেমেছিলাম, সেখান থেকেই আবার শুরু করব। তারা তো আমাকে সময় দিতে চাইবে না। প্রত্যাশা, প্রত্যাশার চাপ—এসব থাকবেই।
প্রশ্ন :
এত দিন পর মাঠে ফিরে প্রত্যাশা পূরণ করার ব্যাপারে কতটা আত্মবিশ্বাসী?
সাকিব: একজন পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে আমি সব সময়ই জানি যে এই জিনিসগুলো আছে, থাকবে। তবে আমি কখনো এগুলো নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করি না।
প্রশ্ন :
চিন্তা তো আসার কথা। মাঠে ফিরে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে ভালো খেলতে পারেননি। ভালো খেললে কি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী থাকতেন না?
সাকিব: ওই টুর্নামেন্টের কিছুই আমার মনে নেই। ওখানে ভালো খেললেও আমার কিছু আসত-যেত বলে মনে হয় না। ভালো খেলিনি, সেটাতেও কিছু হবে না। টুর্নামেন্টটা আমি খেলেছি কারণ, আমার মাঠে নেমে খেলার অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনার দরকার ছিল। এই টুর্নামেন্ট নিয়ে আমি আর কিছু ভাবিনি।
প্রশ্ন :
খেলায় ফেরার আগে বিকেএসপিতে অনেক পরিশ্রম করেছেন। সেটা নিশ্চয়ই নিজেকে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই...
সাকিব: মানুষের প্রত্যাশা, নিজের কাছে নিজের প্রত্যাশা... সবকিছু মিলিয়েই বলতে পারেন। আমি যখন খেলতে নামব, স্বাভাবিকভাবেই তো ‘লাস্ট’ হওয়ার জন্য খেলতে নামব না। একটা ছাত্র স্কুলে যতই কম যাক, কম পড়ুক; ও তো ফার্স্ট হওয়ার জন্যই পরীক্ষা দেয়।
প্রশ্ন :
মাঠে ফেরার জন্য যে পরিশ্রমটা করেছেন, ক্যারিয়ারে এত পরিশ্রম আগে কখনো করেছেন?
সাকিব: গত বিশ্বকাপের আগে সম্ভবত এর চেয়ে বেশি অনুশীলন করেছি। অবশ্য এবার বিকেএসপির অনুশীলন অনেকটা ও রকমই ছিল। বিশ্বকাপের আগে একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিলাম। আইপিএলের প্রতিযোগিতার মধ্যে ছিলাম। বিকেএসপিতেও সামনে একটা লক্ষ্য নিয়ে অনুশীলন করেছি। খুব ভালো অনুশীলন হয়েছে। তখনই শ্রীলঙ্কা সিরিজটা হয়ে গেলে আমার জন্য খুব ভালো হতো। ওটা না হওয়ায় আবার আমি ৪৫-৫০ দিনের জন্য আমেরিকায় চলে যাই। আমার জন্য একটা সমস্যাই হয়ে গেছে।
প্রশ্ন :
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে আপনাদের জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকতে হয়েছে। অভিজ্ঞতাটা কেমন?
সাকিব: খুবই কঠিন এটা মেনে চলা। খেলার সময় এমনিতেও আমাদের খুব বেশি বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয় না। কিন্তু সেটা একরকম, আর আপনাকে বলে–কয়ে আটকে রাখাটা আরেক রকম। এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। এখন অবশ্য ভ্যাকসিন এসে যাচ্ছে। ক্রিকেটাররা বা ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো যদি সেটা পেয়ে যায়, আশা করি আমাদের আর জৈব সুরক্ষাবলয়ে থাকতে হবে না।
প্রশ্ন :
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ওয়ানডে দলে মাশরাফিকে রাখা হয়নি। অনেকে বলছেন, এতে হয়তো তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেরই সমাপ্তি ঘটে গেল। আপনার কী মনে হয়?
সাকিব: ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত ভালো খেলতে থাকলে যেকোনো খেলোয়াড়ই আবার ফিরে আসতে পারে। একজন ব্যাটসম্যান যদি টানা চার-পাঁচ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন বা একজন বোলার যদি খুব ভালো বল করেন, তাঁকে কি এড়িয়ে যাওয়া যাবে? অন্তত ‘এ’ দলে তো নিতেই হবে। তবে ফেরার প্রক্রিয়াটা অনেক কঠিন।
প্রশ্ন :
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন, আপনার ক্রিকেট একাডেমি তো প্রায় দাঁড়িয়ে গেল। কী পরিকল্পনা একাডেমি নিয়ে?
সাকিব: মাস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় এটা হচ্ছে। আমি একাডেমিটা নিয়ে খুবই আশাবাদী। হয়তো এ মাসেই উদ্বোধন হয়ে যাবে। চেষ্টা করা হচ্ছে যেন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা খুব ভালোভাবে থাকে। জাতীয় দলের একজন খেলোয়াড় যদি যায়, সেও যেন কোনো কিছুর অভাব বোধ না করে। আমি এটা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশের যেকোনো মাঠের চেয়ে আমাদের একাডেমির মাঠ সুন্দর, ঘাস ভালো। আকারে হয়তো একটু ছোট, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা উন্নতমানেরই থাকবে। বিদেশি খেলোয়াড়েরা বা বিপিএলের কোনো দল যদি সেখানে অনুশীলন করতে যায়, তারা যেন সব রকম সুযোগ-সুবিধা পায়। খেলোয়াড় হিসেবে আমার বিভিন্ন দেশের একাডেমিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমার কিছুটা হলেও ধারণা আছে একটা মানসম্মত একাডেমি কেমন হওয়া উচিত। এসব মাথায় রেখেই এটা করা হচ্ছে।