সাক্ষাৎকারে জুলিয়ান উড
যত বেশি ছক্কা, তত বেশি টাকা
ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের বদলের কারিগর বলা যায় তাঁকে। টি-টোয়েন্টিতে ‘পাওয়ার হিটিং’ কথাটা মূলত তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। বিগ ব্যাশ, পিএসএল ও আইপিএলে কাজ করা জুলিয়ান উড গত বিপিএলে ছিলেন সিলেট সানরাইজার্সের ব্যাটিং কোচ, এবার এসেছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের প্রধান কোচ হিসেবে। কাল চট্টগ্রামের অনুশীলনের ফাঁকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ও পাওয়ার হিটিংয়ের খুঁটিনাটি নিয়ে উড কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে—
প্রশ্ন :
প্রথমবার প্রধান কোচের ভূমিকায় কাজ করছেন। কেমন লাগছে?
জুলিয়ান উড: ভালোই। অভিযোগ করার কিছু নেই। আমি যা করতে উপভোগ করি, সেটা করতে পারছি। প্রধান কোচকে অনেক কিছু দেখাশোনা করতে হয়। মনে হয় সেটা করতে পারছি। টানা দুটি জয় পেলে আরও ভালো লাগত (হাসি)।
প্রশ্ন :
সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম। ৪ ম্যাচে ২টি জয়। নিশ্চয়ই আরও ধারাবাহিক হতে চাইবেন?
উড: তা তো অবশ্যই। তবে যা বুঝলাম, এই দলটার রান তাড়া করে জেতার দক্ষতা বেশি। কারণ, আমাদের শক্তি ব্যাটিং। আফিফ, উসমান, শুভাগত থেকে মৃত্যুঞ্জয় পর্যন্ত লম্বা ব্যাটিং আমাদের। টুর্নামেন্টটা যেহেতু ১২ ম্যাচের, আমাদের সামনে ছন্দটা ধরার সময় আছে। আশা করি, সেটা পারব।
প্রশ্ন :
আপনি হ্যাম্পশায়ারের হয়ে প্রথম শ্রেণি ক্রিকেট খেলেছেন। এরপর এসেছেন কোচিংয়ে। কিন্তু খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে আপনি শুরুতে গ্রহণযোগ্যতা পাননি...
উড: আমি ’৮০-৯০–এর দশকে ইংলিশ ক্রিকেটে খেলেছি। বাঁহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলাম। মেরে খেলতে পছন্দ করতাম। কিন্তু তখন আমার আক্রমণাত্মক খেলা ইংলিশ ক্রিকেট ভালো চোখে নেয়নি। সব সময় নিজেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে ‘বন্দী’ মনে হতো। কারণ, আমি মন খুলে খেলার স্বাধীনতা পাইনি। তখন ইংল্যান্ডে ক্রিকেট খুব ট্র্যাডিশনাল ছিল। এখন যে ধরনের ক্রিকেট হচ্ছে, সেটার সঙ্গে আমি সহজে মানিয়ে নিতে পারতাম। পরে খেলায় টিকে থাকার তাগিদে যখন কোচিংয়ে এলাম, তখনো ‘বন্দী’ মনে হতো। সেই পুরোনো আলাপ, হেড টু দ্য বল, হাই এলবো…এসব একঘেয়ে কোচিং। এরপর টি-টোয়েন্টি আসার পর আমি বুঝেছি খেলাটা কোন দিকে যাচ্ছে, হয়তো অন্যদের চেয়ে আগেই বুঝেছি। তখন থেকেই ব্যাটিং নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবনার শুরু, যা আমাকে এখন পর্যন্ত সাফল্য এনে দিচ্ছে।
প্রশ্ন :
শুনেছি বেসবল আপনার কোচিং–দর্শন পাল্টে দিয়েছে?
উড: ঠিক। ক্রিকেটে হাতের প্রাধান্যটা সব সময় বেশি ছিল। কিন্তু ফরম্যাট যত ছোট হয়েছে, পাওয়ারের প্রয়োজন তত বেড়েছে। খেলার ধরনের কারণেই ব্যাটসম্যানদের এখন বেশি ছক্কা-চার মারতে হচ্ছে। আর এ জায়গায়ই আমি সবার আগে ক্রিকেটারদের সাহায্যে এগিয়ে আসি। বেসবলও প্রায় একই। সেখানেও বলটাকে উড়িয়ে দূরে পাঠানোর চ্যালেঞ্জ থাকে। ক্রিকেটেও সেটা ঢুকেছে।
প্রশ্ন :
২০১৫ সালে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং কোচ গ্রাহাম থর্পের সঙ্গে আপনার সেই সাক্ষাতের বিষয়ে একটু বলুন।
উড: আমি থর্পির সঙ্গে দেখা করেছিলাম পার্কিং লটে। সে আমার গাড়িতে অদ্ভুত কিছু গ্যাজেট দেখতে পেয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ভারী বল, বাঞ্জি আর কিছু জিনিস ছিল সেখানে। এসব ব্যবহার করে অনুশীলন করলে ক্রিকেটটা অন্য রকম মনে হয়, সেটা থর্পি খুব দ্রুতই বুঝতে পারে। তারপর সে আমাকে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করতে বলে। এসব ২০১৫ বিশ্বকাপের আগের ঘটনা। যেখানে ইংল্যান্ড দল বাংলাদেশের কাছে হেরে বিদায় নেয়। তখন ইংল্যান্ড দলে যেমন ক্রিকেটার দরকার, সেটা ছিল না। বদলটা আসে এরপর থেকে। এউইন মরগান ও ট্রেভর বেইলিস এসে সব পাল্টে ফেলে। এখন ইংল্যান্ড বিশ্বের সেরা সাদা বলের দল।
সুরিয়ার হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন অসাধারণ। তাকে দেখে মনে হয় সে যেন দুই বল এগিয়ে আছে। ওর হাত, রাবারের মতো কবজি…এসব ওর বড় শক্তি। হয়তো ভবিষ্যতে পুরোপুরি নতুন ঘরনার ক্রিকেটাররা যেমন হবে, সে তাদেরই প্রতিনিধি!জুলিয়ান উড
প্রশ্ন :
আপনি পাওয়ার হিটিং কোচিং শুরু করেছেন। এখন সেটার বিশাল এক বাজার তৈরি হয়েছে।
উড: এখন এর বাজার অনেক বড়। যে কারণে আমি এখানে আছি। এরপর আমি আমেরিকায় যাব, পাকিস্তানে যাব। আশা করি, আইপিএলেও যাচ্ছি। খেলাটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আপনি শুধু নিজের গণ্ডির মধ্যে থাকলে হয়তো ভালো থাকবেন, কিন্তু উন্নতি হবে না। একটা সময় পর পিছিয়ে পড়বেন।
প্রশ্ন :
ব্যাটসম্যান মারার মুহূর্তে যেভাবে ব্যাট ধরে, সেটাকে আপনি ‘এলিট হ্যান্ডস’ নাম দিয়েছেন। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
উড: ব্যাটসম্যান যখন বল মারার জন্য ব্যাটটাকে ধরে ওপরে তোলে, তখন সামনের হাত, কবজি আর কাঁধের যে সমন্বয়, সেটাকে ‘এলিট হ্যান্ডস’ বলি। বল মারা পর্যন্ত যদি এই সমন্বয়টা ঠিক থাকে, তাহলে বল দূরে যাবে। বেসবলে এটাকে বলে ‘মানি-গ্যাপ’। বেসবলে যারা হাত ওইভাবে ঠিক রাখতে পারে, তাদের বুকের অংশটা ফাঁকা থাকে। যতক্ষণ এই জায়গাটা ফাঁকা থাকবে, বল দূরে যাবে। আর যারা বল দূরে পাঠাতে পারে, তাদের পারিশ্রমিকও বেশি। সে জন্য এটাকে বলা হয় ‘মানি-গ্যাপ’। ক্রিকেটও তো একই রকম। যে যত বেশি ছক্কা মারবে, সে তত বেশি টাকার মালিক (হাসি)।
প্রশ্ন :
এ ধরনের নতুন ধারার চিন্তা শুরুর দিকে কি ক্রিকেটাররা সহজে গ্রহণ করেছেন?
উড: সময় লেগেছে। ক্রিকেটাররা নিরাপদ থাকতে চায়। ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ, এটাই তাদের ক্যারিয়ার। এখন খেলাটা যেহেতু ওই পথেই এগোচ্ছে, ক্রিকেটাররাও গ্রহণ করছে। আমার কাজটাও সহজ হচ্ছে।
টেস্ট থাকবে। তবে অনেক বেশি টি-টোয়েন্টি খেলা হবে। তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য বিশ্বে নানান লিগ থাকবে। ওয়ানডে হয়তো পিছিয়ে পড়বে।জুলিয়ান উড
প্রশ্ন :
৯০ ও ৭০ কেজি ওজনের ব্যাটসম্যানের পাওয়ার হিটিংয়ে কেমন পার্থক্য থাকে?
উড: পেশিবহুল শরীর থাকলে বলটা জোরে মারা যায়, ফোর আর্মের ব্যবহারটা অন্যদের চেয়ে তার ভালো হবে। যদি হাত ও কাঁধ পোক্ত হয় তাহলে বল জোরে মারা যাবে। কারণ, এখান থেকেই ব্যাট সুইংটা হয়। এ ছাড়া ব্যাক লিফট থেকে, গ্রাউন্ড থেকে পাওয়ার তো আছেই আসে। চট্টগ্রাম দলের আফিফের কথাই বলি। তাঁর কিন্তু পেশিবহুল শরীর নেই। কিন্তু নিজের স্কিল, রিদম ও টাইমিং দিয়ে সেও চার-ছক্কা মারতে পারে। সে যদি পেশিশক্তি ব্যবহার করতে চায়, তাহলে ভুল হবে। তার এটা করার দরকার নেই। অন্যদিকে আমাদের দলে ম্যাক্স, উসমান আছে। ওরা ভিন্ন। পাওয়ারফুল। আফিফের মতো নয়। যে যেমন তাঁর পাওয়ারহিটিং কৌশলও ভিন্ন।
প্রশ্ন :
সূর্যকুমার যাদবকে নিয়ে কিছু বলুন। তাঁর এমন অবিশ্বাস্য টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের কোনো ব্যাখ্যা আছে?
উড: সুরিয়ার হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন অসাধারণ। তাকে দেখে মনে হয় সে যেন দুই বল এগিয়ে আছে। সব সময় জানে বোলাররা কী বল করবে। ওর হাত, রাবারের মতো কবজি…এসব ওর বড় শক্তি। হয়তো ভবিষ্যতে পুরোপুরি নতুন ঘরনার ক্রিকেটাররা যেমন হবে, সে তাদেরই প্রতিনিধি!
প্রশ্ন :
বাংলাদেশে দুই বছর কাজ করছেন। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ শুনতে চাই।
উড: তারা স্কিলফুল। টাচ ভালো। পাওয়ারও আছে। অনেক বেশি পাওয়ারের কোনো প্রয়োজন নেই। যথেষ্ট থাকলেই হয়। তবে সেটি কীভাবে ব্যবহার করছেন, তা–ও গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারলে ভালো আউটপুট পাওয়া সম্ভব। আমি এখানে ছয় সপ্তাহের জন্য আছি। ছেলেরা ট্রেনিং উপভোগ করছে। তবে তাদের এটি করে যেতে হবে। ছয় সপ্তাহ করে থেমে গেলে কিছু হবে না। সত্যি করে বললে বিসিবির উচিত আমাকে নিয়োগ দেওয়া। কারণ, তাদের এখন পাওয়ার হিটিং প্রয়োজন। শুধু ইউটিউব ভিডিও দেখলেই সে অভাব পূরণ হবে না।
প্রশ্ন :
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ১০ বছরে কোথায় থাকবে?
উড: টেস্ট থাকবে। তবে অনেক বেশি টি-টোয়েন্টি খেলা হবে। তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য বিশ্বে নানান লিগ থাকবে। ওয়ানডে হয়তো পিছিয়ে পড়বে। অনেক বেশি টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে, যারা শুধু টি-টোয়েন্টিই খেলবে। বোলারদের স্কিলও বাড়বে। তাদের বাড়াতেই হবে। হ্যাঁ, আমি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এগিয়ে যাওয়াই দেখতে পাচ্ছি।
প্রশ্ন :
কোহলি-উইলিয়ামসনদের মতো অ্যাংকর ব্যাটসম্যানের জায়গা কি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে থাকবে?
উড: আমি মনে করি তাদের জায়গা থাকবে। কারণ, মন্থর উইকেটে আপনি সব সময় আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে পারবেন না। সেখানে আপনাকে ইনিংস ধরে রাখার জন্য কাউকে লাগবে। বাকিরা মেরে খেলবে। অন্তত একজন অ্যাংকর লাগবেই।