দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন মাত্র দুটি। তাতেই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নিয়েছেন তানজিম হাসান। বিশেষ কিছু আছে বলেই ২০ বছর বয়সী এই তরুণ পেসারের ওপর এত আস্থা। তা কী সেই বিশেষত্ব? বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তানজিমই জানিয়েছেন সেটা।
মাত্র দুটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেই বিশ্বকাপে, কেমন লাগছে?
তানজিম হাসান: ওই রকম বিশেষ কিছু মনে হয়নি। কারণ, আমি অভিষেকের আগে যত আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখেছি, একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি যে ক্রিকেট অনেকটাই স্নায়ুর খেলা। আপনি যত আত্মবিশ্বাসী থাকবেন, তত প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে পারবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার আগে আমার এটাই পরিকল্পনা ছিল। আমি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে এত দিন এভাবেই খেলেছি, ঘরোয়া ক্রিকেটেও এভাবে খেলেই নিজেকে তৈরি করেছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে যা করেছি, ঠিক তা–ই করেছি। যাদের বিপক্ষেই খেলি না কেন, সেটা ব্যাপার নয়। যদি আমি আত্মবিশ্বাসী থাকি, তাহলে পারফর্ম করবই। গুড বল ইজ গুড বল ফর এভরিওয়ান—এটাই আমার মাথায় সব সময় কাজ করে। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলব, এরপর যা হওয়ার হবে।
আপনি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু সেই বিশ্বকাপের পরই কাঁধের চোটে প্রায় এক বছর বাইরে ছিলেন। সময়টা কতটা কঠিন ছিল?
তানজিম: কঠিন বলব না। চোটটা আমাকে মানসিকভাবে শক্ত বানিয়েছে। মাঝেমধ্যে আপনাকে ব্যথা নিয়েও খেলতে হবে। এটা আমি ওই চোট থেকে শিখেছি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম উইকেট রোহিত শর্মার। ভেবেছিলেন কখনো এমন সূচনা হবে?
তানজিম: এভাবে চিন্তা করিনি। আমি প্রথম ওভারে মুহূর্তটায় থাকার চেষ্টা করেছি। বেশি দূর চিন্তা করিনি। ম্যাচ শেষে কী হবে, আমার স্পেল শেষে কী হবে, এসব ভাবিনি। প্রতিটি বল সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করছি। আমার ভেতর কোনো দোটানা কাজ করেনি। টপ অব দ্য মার্কে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়নি, এই বলটা বাউন্সার নাকি লেংথ বল, যদি লেংথ বল ভেবে থাকি, তাহলে সেটাই করেছি।
সেই ম্যাচে ডেথ বোলিংয়েও ভালো করেছেন...
তানজিম: আমাকে সাকিব ভাই ডেথ বোলিংয়ের ব্যাপারে একটা কথা বলেছিলে, ‘যেটা করবা সেটা একদম ক্লিয়ারলি করবা। যদি ইয়র্কার হয় তাহলে ইয়র্কার, স্লোয়ার হলে স্লোয়ার।’ আমার ভেতরও এটাই ছিল। এ ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যান যদি আপনার সাইকোলজি বুঝতে পারে, তাহলে সে এগিয়ে যাবে। আমাকেও ব্যাটসম্যানের সাইকোলজি বুঝতে হয়। যদি বুঝতে পারি তাহলে আমি এগিয়ে থাকব।
অনেক বোলার আছেন, যাঁরা ডেথে ব্যাটসম্যানকে পড়ার চেয়ে নিজের দক্ষতায় আস্থা রাখেন। আপনিও কি সে রকম?
তানজিম: কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমিও তা–ই। নিজের দক্ষতার ওপর আমিও আস্থা রাখি। এরপর যদি ব্যাটসম্যান ভালো শট খেলে, তাহলে গুড লাক টু হিম।
মাঝের ওভারের বোলিং নিয়ে কী বলবেন? আপনি বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছেন ইবাদত হোসেনের জায়গায়, যিনি গত এক বছর মাঝের ওভারে বাংলাদেশের সেরা বোলার ছিলেন...
তানজিম: এবার প্রিমিয়ার লিগে মিডল ওভারে অনেক বোলিং করেছি। আবাহনীতে তিন-চারটা ম্যাচ বাদে বাকি সব ম্যাচেই আমি ওয়ান চেঞ্জে বোলিং করেছি। ওয়ানডে ক্রিকেটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সময়। আপনি যদি দুই-তিনটা উইকেট নিতে পারেন এ সময়, তাহলে ম্যাচ ঘুরে যায়। ওই সময় আমি চেষ্টা করি খুব জোরে উইকেটে হিট করার জন্য। বাউন্সার তো অবশ্যই। উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করি। আমি ডোনাল্ডের সঙ্গে কাজ করব মিডল ওভার বোলিং নিয়ে। আপনি যত খেলবেন তত উন্নতি করতে হবে, এটা মাথায় রাখতে হবে।
আপনার অ্যাকশন অনেকটা সাইড ওয়েজ। আউটসুইংটা তাই সহজাত বলা যায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে বল ভেতরেও আনেন...
তানজিম: আমি মূলত আউটসুইং বোলার। আমার যে বোলিং অ্যাকশন, তাতে ব্যাটসম্যানরা ইনসুইং আশা করে না। আউটসুইংয়ের সঙ্গে আমি সিম আপ করানোর চেষ্টা করি। সিম আপ করলে বল মাঝেমধ্যে ভেতরে আসে। ব্যাটসম্যানের মনে একটু সন্দেহ সৃষ্টি করে সেটা। তখন আমার আউটসুইংয়ে উইকেট পেতে সুবিধা হয়। আমি আসলে সেই অর্থে ইনসুইং করানোর চেষ্টা করি না। ইন কাট করানোর চেষ্টা করি। বল পড়ে ভেতরে আসে। বল যখন কিছুটা নতুন থাকে, তখন আমি এটা করতে পারি। উইকেটে অনেক জোরে যখন হিট করি, তখন ইনকাটটা হয়।
ইয়র্কারে আপনি বেশ দক্ষ। এটা কি শুধুই অনুশীলন করে, নাকি সহজাত?
তানজিম: ইয়র্কার পুরোটাই অনুশীলন। যত বেশি প্র্যাকটিস করবেন, তত কার্যকরী হবে। আমার কাছে এটাই ইয়র্কারের একমাত্র মন্ত্র। এটা এমন একটা বল, পৃথিবীর যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য এটা কার্যকরী। জায়গামতো করতে পারলে কেউ মারতে পারবে না। আমি এটা খুব গুরুত্ব দিয়ে প্র্যাকটিস করি। ডেথ ওভারে তো এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইয়র্কারে হালকা রিভার্স সুইং হয়। অ্যাকশনের কারণে?
তানজিম: হ্যাঁ, তবে আমি এটা নিয়ে আরও কাজ করব। এটা আমার উন্নতির তালিকায় আছে। বল একটু পুরোনো হলে রিভার্স সুইং হয়।
টানা কয়টা ইয়র্কার মারতে পারবেন?
তানজিম: আমি এক ওভারে ছয়টা ইয়র্কার মারতে চাইলে ছয়টাই মারব। যদি আমি চিন্তা করি যে ইয়র্কার হবে, তাহলে ইয়র্কারই হবে। প্র্যাকটিসের কারণেই এই আত্মবিশ্বাস এসেছে।
ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটারের আশপাশে বোলিং করছেন। আপনার কি মনে হয়, চাইলে আপনি আরও চার–পাঁচ কিলোমিটার বেশি গতিতে বোলিং করতে পারেন?
তানজিম: অবশ্যই। ফিটনেস নিয়ে কাজ করার সময় পাচ্ছি না। তবে এর ভেতরই কাজ করতে হবে। কোনো অজুহাত নেই। আমি জানি, আমি ধারাবাহিকভাবে ১৪০–এ বল করতে পারব। প্রিমিয়ার লিগেও আমার মনে হয়েছে ওই পর্যায়ে বল করেছি।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলা গতি বাড়াতে কতটা সাহায্য করে?
তানজিম: সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। এনসিএল, বিসিএলে যদি ভালো ছন্দ পেয়ে যাই, তাহলে পুরো মৌসুম আরামসে ভালো জোরে বল করা যায়।
আপনাকে বিশ্বকাপ দলে নেওয়ার আরেকটা কারণ ব্যাটিং। ব্যাটিং নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাসী?
তানজিম: কোচ (চন্ডিকা হাথুরুসিংহে) আমাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘তুমি যদি দলে থাকতে চাও, তাহলে তোমাকে ব্যাটিং করতে হবে।’ আমার খুবই খারাপ লাগে, যখন দেখি আমাদের সাতটা উইকেট পড়ার পর বাকি উইকেটগুলো খুব দ্রুত পড়ে যায়। সাত উইকেট পড়ার পর যে ব্যাটসম্যান থাকে, সে মারতে শুরু করে। কারণ, সে জানে যে বাকিরা বেশিক্ষণ টিকবে না। আমি এটা চাই, যে ব্যাটসম্যান থাকবে সাত নম্বরে, সে যেন আমাকে নিয়ে ইনিংসটা লম্বা করতে পারে। সে যেন আমার ওপর আস্থা রাখতে পারে।
শুনেছি আপনি ডেল স্টেইনের বড় ভক্ত…
তানজিম: ডেল স্টেইনের বোলিং আমার এত ভালো লাগত, দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো ম্যাচ বাদ দিতাম না। বল পড়ে বের হচ্ছে, ভেতরে আসছে…। সেরা সময়ে একদম আনপ্লেয়েবল ছিল। খুবই ভালো লাগত। তখন থেকেই তিনি আমার পছন্দের বোলার। তাঁকে কপি করে বোলিং করার চেষ্টা করতাম।
দুজনের উচ্চতাও তো প্রায় একই...
তানজিম: হ্যাঁ, প্রায় কাছাকাছি। এটা আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছে, যখন আমি পেশাদার ক্রিকেটার হই। আমি প্রায়ই গুগল করতাম, ‘ডেল স্টেইন হাইট’, ৫. ১০ (হাসি)। এটা আমাকে খুব আত্মবিশ্বাস দিত। আমি তাঁর সব মাস্টারক্লাস দেখি। আমি অ্যালানকেও (ডোনাল্ড) জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি তো দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ ছিলেন স্টেইনের সময়। তিনি বলেছেন, ‘হোয়াট আ গাই টু কোচ!’