২০১৫ সাল থেকে আপনি বিসিবির প্রধান নির্বাচক। গত ৯ বছরের যাত্রাটাকে কীভাবে দেখেন?
মিনহাজুল: শুরুতে কাজটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। ওয়ানডে ছাড়া অন্য দুই সংস্করণের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল এটাকে একটা আদর্শ জায়গায় আনা। সে হিসাব করলে দেখা যাবে আমরা জয়ের হার বাড়াতে পেরেছি। ২০১৩ সালে যখন আমরা যখন দায়িত্ব নিই, তখন টেস্টে জয়ের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় ছিল। সেখান থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫ শতাংশ উন্নতি করতে পেরেছি। টি–টোয়েন্টিতে ১০ শতাংশে গিয়েছি। এই সংস্করণে আমাদের কষ্ট করতে হয়েছে প্রচুর। ওয়ানডেতে আমরা এখন ৩৬ শতাংশে চলে এসেছি। কাজেই কোনো জায়গাতেই কিন্তু গ্রাফ নিচের দিকে ছিল না, প্রক্রিয়াটাই ছিল ওপরের দিকে যাওয়ার। এখন সেটি বেশ থিতু অবস্থায় আছে।
যেটা বললেন, গ্রাফ ওপরের দিকে গেছে; সেটির জন্য আপনাদের কমিটি কি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে?
মিনহাজুল: প্রথমে জোর দিয়েছিলাম প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ওপর। খেলোয়াড়দের ফিটনেসের একটা মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছিলাম। পারফরম্যান্স বিশ্লেষণেও জোর দেই। অন্তত তিনটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছে, এমন ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স বিচার করে প্রথম শ্রেণির চুক্তি করা হয়। যেন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়। দলগুলো আমরা ঠিক করে দিতাম, যেটা আগে পুরোপুরি বিভাগের হাতে ছিল। টুর্নামেন্ট কমিটির তখনকার চেয়ারম্যান গোলাম মুর্ত্তজা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছেন এ ব্যাপারে। আমরাও পেরেছি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটটাকে একটা ভালো অবস্থায় আনতে। উইকেটের ওপর নজর দিয়েছি। ক্রিকেটারদের ৬ মিলিমিটার লম্বা ঘাসের উইকেটে খেলতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেছি।
ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের আলোকে আপনি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের জন্য একটা রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। সেটি কেন বাস্তবায়িত হলো না?
মিনহাজুল: প্রস্তাবটা ছিল হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে করার পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দ্বিতীয় একাদশ তৈরি করা। খেলোয়াড়–সংকটের কারণে আমার প্রস্তাব ছিল যে অঞ্চলগুলোকে নিয়ে বিসিএল হয়, সেই চারটা অঞ্চল ধরে দ্বিতীয় একাদশ করা। এই দ্বিতীয় একাদশগুলো ও হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে খেলবে। ধরুন, খুলনা দল যদি হোমে জাতীয় লিগের ম্যাচ খেলে, একই সময় খুলনা ও বরিশাল মিলিয়ে করা দ্বিতীয় একাদশ অ্যওয়ে ম্যাচ খেলবে অন্য দলের সঙ্গে। সমান্তরালে দুটি টুর্নামেন্ট হলে ক্রিকেটারের সংখ্যাটা বেড়ে যাবে। প্রথম একাদশে যারা ভালো খেলবে না, তারা দ্বিতীয় একাদশে চলে যাবে। দ্বিতীয় একাদশে ভালো করারা প্রথম একাদশে আসবে। খেলোয়াড়দের মধ্যে তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হবে। লেগ স্পিনারদের দিয়েও তখন আমরা প্রচুর বোলিং করাতে পারব, যেটা এখন ঘরোয়া ক্রিকেটে পারি না। যে কারণে আমাদের লেগ স্পিনারও তৈরি হয় না। যেকোনো কারণেই হোক এখনো প্রস্তাবটা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে যদি আমরা একটা থিতু অবস্থায় দেখতে চাই, এটা করতে হবে।
আপনি বললেন, বিভাগীয় দলগুলো আপনারা করে দিচ্ছেন। আমরা জানি দলগুলোতে ভারসাম্য আনতে অনেক সময় আপনারা এক বিভাগের খেলোয়াড়কে অন্য বিভাগের দলে খেলাচ্ছেন। এটা কি আদর্শ–পদ্ধতি?
মিনহাজুল: জাতীয় লিগের সব দলের মান ভালো নয়। খেলোয়াড় সংকট এটার কারণ। যে সংখ্যক খেলোয়াড় আছে, তাতে জাতীয় লিগে ছয়টার বেশি দল হওয়া উচিত নয়। আটটা দল করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, সব দলকে মোটামুটি একই মানের রাখার মতো যথেষ্ট ভালো খেলোয়াড় আমাদের হাতে নেই। ছয়টা দল রেখে দ্বিতীয় একাদশ পদ্ধতিতে গেলেই বরং ভালো হবে। তবু স্থানীয়ভাবে দল নির্বাচনের প্রস্তাব আমরাও দিয়েছি। কিন্তু এটা করতে হলে আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা কার্যকর করতে হবে। আমাদের প্রস্তাব ছিল— প্রতিটা প্রথম শ্রেণির দলের কোচের অধীনে ওই অঞ্চলের দ্বিতীয় একাদশ এবং বয়সভিত্তিক দলগুলোও থাকবে। বিভাগগুলোর জন্য আলাদা নির্বাচক থাকবে, যাদের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচকদের সরাসরি যোগাযোগ থাকবে। এই কাঠামোটা আগে দাঁড় করাতে হবে। এখনো দেখা যায়, লিগ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে বিভাগীয় দলের হেড কোচ ঠিক হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে আমরা এখনো স্থানীয় ট্রেনার, ফিজিও রাখতে পারছি না। অথচ আমাদের মাঠসহ সবই আছে। দলগুলো সব কিছু মেনে চলে না। জাতীয় লিগে একজন করে বিদেশি খেলোয়াড় নেওয়ার নিয়ম আছে। কেউ কিন্তু খেলায় না বিদেশি। বোর্ড অনুশীলনের সব সুযোগ–সুবিধা, টাকা–পয়সা দেওয়ার পরও দলগুলো খেলার আগে কয়দিন অনুশীলন করছে? সবাই বসে থাকে বোর্ড কখন করে দেবে। নিজেদের দিক থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা না হওয়া পর্যন্ত এগুলো ঠিক হবে না।
অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটির সর্বশেষ মেয়াদ গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আপনারা তো এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। এটা কেন?
মিনহাজুল: শুরু থেকে আমাদের কাজ এভাবেই চলত। এমনও হয়েছে, চুক্তি শেষ হওয়ার ছয়–সাত মাস পর নতুন চুক্তি সই করেছি। নতুন একটা প্যানেল ঘোষণার আগ পর্যন্ত কাজ তো চালিয়ে নিতে হবে। যেহেতু আমরা এত দিন ধরে কাজ করছি, এবারও ক্রিকেট অপারেশন্স থেকে আমাদের বলা হয়েছে, ‘তোমরা কাজ চালিয়ে যাও। পরবর্তী বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হবে।’ আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।
শোনা যাচ্ছে, আপনাদের এবার অন্য দায়িত্ব দিয়ে বিসিবি নির্বাচক কমিটি নতুন করে সাজাবে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
মিনহাজুল: দেখুন, বোর্ড যদি আমাদের কাজে সন্তুষ্ট না থাকত, তাহলে এত দিন আমাদের দায়িত্বে রাখত না। বোর্ড আমাকে এতদিন যে সম্মানটা দিয়েছে, বোর্ড যদি আমাকে অনুরোধ করে আরও দায়িত্ব পালন করতে, আমিও অবশ্যই তাদের সম্মান দেখাব। আর আমরা যে প্রক্রিয়ায় কাজ করি অন্য নির্বাচক কমিটি এলেও সেই প্রক্রিয়াতেই কাজ করবে। বিসিবিতে আমি ২০০৫ এ ব্যাটিং কোচ হিসেবে যোগ দেই। ২০১২ পর্যন্ত কোচ হিসেবে কাজ করে এরপরও ক্রিকেটের সঙ্গে আছি। ক্রিকেটের স্বার্থে বোর্ড আমাকে যে কোনো জায়গায় চাইলে আমিও সেই জায়গায় কাজ করব।
কখনো কি মনে হয় নির্বাচক না কোচিং ক্যারিয়ারে থাকলেই ভালো হতো? সেখানে আপনার খেলোয়াড়ি অভিজ্ঞতা আরও বেশি কাজে লাগানো যেত?
মিনহাজুল: কিছু কিছু জায়গায় চাইলেই অনেক কিছু করা যায়। আবার কিছু জায়গা আছে চাইলেও অনেক কিছু করা যায় না। কোচ হিসেবে সৃষ্টিশীল অনেক কাজ করা যায়। অনূর্ধ্ব–১৯ দলের প্রধান কোচ হিসেবে সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আমার সময়ের ১৮ জন খেলোয়াড় পরে বিভিন্ন সময় জাতীয় দলে খেলেছে। এখানে আত্মতৃপ্তি আছে। সে হিসাবে বলতে পারেন কোচিংটা চালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয় স্থানীয় কোচদের যে মানটা দেখি, এর ওপরে যাওয়াটা আমাদের জন্য কঠিন, যদি না আপনি দেশের বাইরে কাজ করেন। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই আমি ট্র্যাক বদলাই। আমার মনে হয়, নির্বাচক হিসেবে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, কোচিংয়ের চেয়ে প্ল্যানিং নিয়ে কাজ করাটাই আমার জন্য বেশি ভালো।
আপনাকে প্রধান নির্বাচক করে দল নির্বাচন প্রক্রিয়াতে বদল আনে বিসিবি। ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান, কোচ এবং টিম ডিরেক্টরও নির্বাচক প্যানেলের অংশ হয়ে গেলেন। এই যে একটা ব্যতিক্রমধর্মী পদ্ধতি, এর সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন?
মিনহাজুল: অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এখনো কিন্তু ওই প্রক্রিয়াটাই আছে। একটা দল করতে গেলে প্রথমে কোচের সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে হয়। প্রথম সভাটা তাঁর সঙ্গেই করতে হয়। কারণ, দলের পরিকল্পনা ও চাহিদা সে ঠিক করে। পরের মিটিংটাই করতে হয় অধিনায়কের সঙ্গে, তারপর আমরা দল নিয়ে ক্রিকেট পরিচালনা প্রধানের সঙ্গে বসি। সব ঠিক হয়ে গেলে বোর্ড সভাপতির অনুমোদন নেই।
দল নির্বাচনের দুই পদ্ধতির মধ্যে কোনটা ভালো মনে হয়েছে আপনার?
মিনহাজুল: পরিস্থিতি অনুযায়ী দুইটাই ভালো। এখন আমরা আনঅফিসয়ালি তাদের মতামত নিচ্ছি, তখন এটা অফিসিয়ালি ছিল।
নির্বাচক ও প্রধান নির্বাচক হিসেবে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় অনেক কোচের সঙ্গেই আপনি কাজ করেছেন। কার সঙ্গে কাজ করা সহজ ছিল এবং কার সঙ্গে কঠিন মনে হয়েছে?
মিনহাজুল: সবার সঙ্গেই ভালো অভিজ্ঞতা আছে। আমরা যখন আসি তখন শেন জার্গেনসেন ছিলেন। এরপর হাথুরুসিংহে এলেন, স্টিভ রোডস এলেন…ডমিঙ্গো এসেছেন, মাঝে স্টুয়ার্ট ল ছিলেন। এখন আবার হাথুরুসিংহে। একেক কোচের পরিকল্পনা একেক রকম থাকলেও উদ্দেশ্য একই—একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া। একবারেই সব পাওয়ার চেয়ে ধাপে ধাপে পাওয়া। আমার মনে হয় পরিকল্পনার দিক দিয়ে সবাই ইতিবাচক ছিলেন এবং আমরাও সেভাবেই কাজ করেছি।
বর্তমান কোচ হাথুরুসিংহে একটু কঠোর, আগের কোচ ডমিঙ্গো ছিলেন তার উল্টো। তা ছাড়া ডমিঙ্গো যেখানে ভবিষ্যতের কথা ভেবে দল গড়তে চাইতেন, হাথুরুসিংহের সেখানে অনেকটাই তাৎক্ষণিক ফল লাভের আশা থাকে। এ নিয়ে কী বলবেন?
মিনহাজুল: এটা ঠিক যে হাথুরুসিংহে তাঁর পরিকল্পনার বাইরে যেতে চান না। তবে ভবিষ্যতের চিন্তা হাথুরুসিংহেও করেন। সব কোচের দর্শনই প্রায় একই আসলে। আমি কোচ থাকলে আমারও একই দর্শন থাকত।
কিন্তু হাথুরুসিংহের সঙ্গে কাজ করা কি একটু কঠিন নয়?
মিনহাজুল: একটুও কঠিন নয়। আমি ওর সঙ্গে খেলেছি। আমরা যেসব আলোচনা করি, সব ইতিবাচকভাবেই হয়। নেতিবাচক কিছু নেই এখানে। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে কোনো সমস্যা নেই আমাদের।
বাংলাদেশে একটা ‘কমন’ অভিযোগ—নির্বাচকদের কাজে বোর্ডের হস্তক্ষেপ থাকে। এ নিয়ে আপনার কোনো অভিযোগ অথবা বক্তব্য?
মিনহাজুল: (হাসি) কে হস্তক্ষেপ করে, আগে সেটা আমাদের জানা দরকার। দল নির্বাচন করে মাননীয় বোর্ড সভাপতির কাছ থেকে আমাদের অনুমোদন নিতে হয়। ওনার তো পূর্ণ অধিকার আছে সব জানার। আমরা একজন খেলোয়াড়ক কেন নিচ্ছি, একজনকে কেন বাদ দিচ্ছি—এসব তো ওনার জানতে হবেই।
এটা তো হলো জানানো। দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে বোর্ড থেকে কখনো কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় কি না, আলোচনা সেটি নিয়ে…
মিনহাজুল: দেখুন আলোচনা সব সময়ই হয়। আমরা যে কোনো দল চূড়ান্ত করার আগে পুরো আলোচনাটা আগে সেরে নিই। তারপর ওনার (বিসিবি সভাপতি) স্বাক্ষর নেই। এমন নয় যে আমরা দল দেওয়ার পর সেটি ছিঁড়ে ফেলে আরেকটা দল করা হয়েছে।
তাহলে কি ব্যাপারটা এ রকম যে, কখনো কখনো বোর্ড যেভাবে চাচ্ছে, আপনারা সেভাবে দল গঠন করে সভাপতির অনুমোদন নিচ্ছেন?
মিনহাজুল: না, ওনারা কী চাইবেন? চাই তো আমরা! টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়া এবং পরিকল্পনা অনুযায়ীই কিন্তু দল তৈরি করা হয়। এর বাইরে কিছু করা হয় না। বাইরে থেকে যারা এসব বলে, না জেনে বলে।
কিন্তু আপনাদের কিছু সিদ্ধান্ত তো বিস্ময় জাগায়ই। এবার যেমন হঠাৎ করে সৌম্য সরকারের দলে আসা নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হলো…
মিনহাজুল: না, সৌম্য হঠাৎ করে দলে আসেনি। ওকে নিউজিল্যান্ড সিরিজে অনেক চিন্তাভাবনা করে পাঠানো হয়েছে। যেহেতু সৌম্যর নিউজিল্যান্ডে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। আমরা এই জায়গাটা নিয়ে অনেক দিন সমস্যায় ছিলাম। তাই মনে হয়েছে বাড়তি একটা ওপেনারকে দেখি। কারণ, নিউজিল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে খেলার অভিজ্ঞতা ছাড়া খেলোয়াড় পাঠানো কঠিন। তা ছাড়া কোচেরও ওর ওপর যথেষ্ট আস্থা ছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই প্রায়ই অনেক ট্রলের শিকার হন আপনি। সেসব দেখেন?
মিনহাজুল: আমাকে নিয়ে যত ট্রল হয়েছে, তার ৮০ ভাগের মতো আমি দেখিইনি। কারণ, আমি ফেসবুক ফলো করি না, আমার ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই। জানি না আমাকেই কেন ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়। নির্বাচক প্যানেলে আরও সদস্য আছে, দল নির্বাচনের সঙ্গে টিম ম্যানেজমেন্ট, ক্রিকেট অপারেশন্সেরও ভূমিকা থাকে। আমি একা তো সিদ্ধান্ত নিই না। বিশ্বকাপে তামিমকে বাদ দেওয়া নিয়েও আমাদের দোষারোপ করা হয়েছে। কিন্তু তামিম তো নিজে থেকেই খেলবে না বলেছে। শেষ মুহূর্তেও আমি চেষ্টা করেছি ওকে ফেরাতে। প্রধান নির্বাচক হিসেবে আমি ওকে বলেছি আমি তাকে দলে চাই। স্পিকার অন করে আমরা তিনজন ওর সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু সে সরাসরি বলেছে তাকে না রাখতে।
তামিম কেন এটা বলেছিলেন?
মিনহাজুল: ও বলেছে ওকে না রাখতে। এর বেশি কিছু আমি আর বলতে চাই না। এখানে অনেক কিছুই আছে যেসব আলোচনায় এখন না যাওয়াই ভালো। ওর সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান জানাই।
এর আগে একটা সিরিজের মধ্যে যখন অধিনায়ক হয়েও তামিম অবসরের ঘোষণা দিলেন (যদিও পরদিনই সিদ্ধান্ত বদলেছেন), প্রধান নির্বাচক হিসেবে সেটি কত বড় ধাক্কা ছিল আপনার জন্য?
মিনহাজুল: অবশ্যই ধাক্কা ছিল। সিরিজের মাঝখানে অধিনায়কের এ রকম সিদ্ধান্ত, যাকে নিয়ে আমরা বিশ্বকাপেরও পরিকল্পনা করেছিলাম…। ওই সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছিলাম আমরা। তবে এটা ওর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এটা নিয়ে কিছু বলার নেই আমার।
আপনাকে নিয়ে অনেক নেতিবাচক সংবাদ হয়েছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও। কিন্তু সেসব নিয়ে আপনাকে কখনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে যায়নি কেন?
মিনহাজুল: বোর্ড থেকে এসব নিয়ে বিবৃতি দেওয়া উচিত ছিল। আমি নির্বাচক প্যানেলে আছি। এখান থেকে সব কিছুর উত্তর দেওয়া যায় না। আর এই যে ট্রল করা হচ্ছে, মিথ্যা কথা বলে মানুষকে খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সবই মিথ্যা। আমাদের অনেক ‘ক্রিকেট বুদ্ধিজীবি’ও টক শোতে অনেক কথা বলেছেন। এই বুদ্ধিজীবিদেরও একটা জবাব দেওয়া উচিত ছিল।
সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ—আপনি প্রধান নির্বাচক থাকার সময়ই তারা তাদের ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছেন। দলে তাদের ভালো অবস্থান তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে কিছু বিভেদও ছড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি আপনাদের কাজকে কতটা প্রভাবিত করেছে?
মিনহাজুল: আমাদের সবার সঙ্গেই তাদের যথেষ্ট ভালো বোঝাপড়া ছিল, আছে। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। এই ৯–১০ বছরে ওদের কারও সঙ্গেই কখনো কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি।
তামিমের সঙ্গে হাথুরুসিংহের একটা দূরত্বের কথা আমরা জানি। এমনও বলা হয়, হাথুরুসিংহের জন্যই তামিমের ক্যারিয়ার দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত?
মিনহাজুল: এটা নিয়ে আমি কোনো কিছু বলতে পারব না। তবে নির্বাচক প্যানেলের সঙ্গে ওর কোনো সমস্যা হয়নি।
হাথুরুসিংহে কি কখনো আপনাদের বলেছেন, তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তামিম নেই?
মিনহাজুল: না, এ রকম কোনো কিছু হাথুরুসিংহে বলেননি।
মাহমুদউল্লাহকে বাদ দেওয়া এবং বিশ্বকাপে তাঁর দারুণভাবে ফিরে আসা, এর আগে টেস্ট থেকে তাঁর আকস্মিক অবসর, সাকিব–তামিমের বেছে বেছে খেলা—এসব নিয়ে কী বলবেন?
মিনহাজুল: লম্বা পথ চলার মধ্যে অনেক কিছুই হোঁচট খায়। সব ম্যানেজ করেই কিন্তু সামনের দিকে এগোতে হয়।
এই ‘ম্যানেজ’টা কীভাবে করছেন, সেটিই জানতে চাচ্ছি…
মিনহাজুল: আপনার হাতে যা আছে তাই নিয়েই চলতে হবে। কে কোন সিরিজ খেলবে, কোনটা খেলবে না; সব মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করতে হয়। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিতে পরাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেভাবেই এগিয়েছি। অনেক সময় বলা হয় খেলোয়াড়েরা আগে থেকে পরিকল্পনা জানাক। এটা কিন্তু কঠিন। একজন খেলোয়াড় তো যেকোনো সময় চোটেও পড়তে পারে। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি নির্দিষ্ট কোনো সিরিজে বা টুর্নামেন্টে খেলতে না চায়, সেটি আগে বললে সব সময়ই সুবিধা।
শোনা যাচ্ছে খেলোয়াড়দের নতুন চুক্তির ক্ষেত্রে আপনারা নিশ্চিত হতে চেয়েছেন, কাদের আগামী এক বছর পাওয়া যাবে, কাদের পাওয়া যাবে না…
মিনহাজুল: ও রকম কিছু নয়। আমরা পারফরম্যান্স দেখছি। দীর্ঘ পরিসর, ওয়ানডে, টি–টোয়েন্টিতে কোন খেলোয়াড় কতটুকু সার্ভিস দিতে পারবে, বা কার কী প্রতিভা—সেসব দেখছি। তবে হ্যাঁ, কিছু খেলোয়াড়কে বার্তা দেওয়ারও ব্যাপার আছে। কেন্দ্রীয় চুক্তি মানে এই নয় যে সবাই সেখানে থাকবে। পারফরম্যান্স ভালো থাকতে হবে।
গত কয়েক বছরে আমরা পেস বোলারদের একটা উত্থান দেখছি। দলে পেসারের সংখ্যা বাড়ছে…
মিনহাজুল: এটার বড় কারণ আমরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৮০ ওভারে নতুন বল নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছি। এটা করা হয়েছে পেসাররা যেন নতুন বলের সুবিধা নিতে পারে, সে জন্য। ১২৫ ওভার পর্যন্ত একই বল বদলানো হয়নি, এ রকম রেকর্ডও আছে আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে।
গত ৯ বছরে দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাড়তি কি যুক্ত করতে পেরেছেন, যেটা ভবিষ্যতেও নির্বাচকদের পথরেখা হবে?
মিনহাজুল: পেস বোলিং ইউনিটটাকে গড়ে তুলতে পেরেছি। একই সঙ্গে আমরা পাইপলাইনে অনেক খেলোয়াড় আনতে পেরেছি। তিন ফরম্যাটের জন্যই এখন অনেক খেলোয়াড় হাতে আছে। স্পেশালিস্ট টেস্ট খেলোয়াড় আছে। টি–টোয়েন্টির জন্যও কিছু খেলোয়াড়কে আমরা আলাদা করতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, টি–টোয়েন্টি দলটা প্রস্তুত করতে সময় লাগছে। এখানে আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছি অন্যদের চেয়ে। যারাই নির্বাচক কমিটিতে আসবে এই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করতে পারবে। আশা করি আগামী তিন–চার বছরের মধ্যে তিন সংস্করণেই ভালো কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে।
কিন্তু তামিমের অনুপস্থিতিতে ওপেনিং জুটিটা তো আবার একটু নড়বড়ে হয়ে গেল…
মিনহাজুল: এ রকম কিছু সময় হয়তো যাবে। কেউ খেলা ছাড়বে, কেউ ফর্মে থাকবে না। তবে একটা সময়ে আবার কেউ না কেউ থিতু হয়ে যাবে। তিন–চারটা সিরিজ সুযোগ না দিলে আসলে কাউকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না। একটু অপেক্ষা করতেই হবে।
সংসদ সদস্য হওয়ার পর খেলার বাইরে সাকিবের ব্যস্ততা আরও বাড়ল। এ অবস্থায় তাঁকে দলে পাওয়া বা তাঁর অধিনায়কত্বের ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
মিনহাজুল: সাকিব কিন্তু খুব ভালো ম্যানেজার, ও সব ম্যানেজ করে চলতে পারে। এটা মানতেই হবে। বাংলাদেশে কারও কাছ থেকে পেশাদারত্ব শেখার কথা যদি বলতে হয়, ওর কাছ থেকে সেটা শেখা যায়। এত কিছুর মধ্যেও সে কিন্তু পারফর্ম করে যায়। তার মধ্যে এই বিশেষ গুণটা আছে। আমি আশা করি, এখনো সে তা পারবে। তবে অধিনায়কত্বের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বোর্ডের সিদ্ধান্ত।
খেলোয়াড়ী জীবন থেকে শুরু করে আপনি তো কয়েক প্রজন্মের ক্রিকেটারই দেখেছেন এই দেশে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত ক্রিকেটারদের চিন্তার বিবর্তন বা মানসিক পরিবর্তনটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মিনহাজুল: আগে ক্রিকেট নিয়ে চিন্তা করার আলাদা সময় হাতে থাকত। খেলার পরও সময় পেত ক্রিকেটাররা। এখন ওই সময়টা ওদের নেই। টানা খেলা থাকে, নয়তো অন্য কিছু থাকে। সময়টা মুহূর্তের মধ্যে চলে যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু করতে হয়। এখন খেলোয়াড়দের জীবন অনেক কঠিন। দীর্ঘ সময় পরিবারের বাইরে থাকা, বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলা, একের পর এক খেলা—এই সবকিছুর পরও তাদের পারফর্ম করতে হয়। সামনে কী হবে জানি না, তবে খেলোয়াড়দের জীবন এখন যেমন, এর চেয়ে কঠিন আর হবে না। আমি মনে করি, সব ম্যানেজ করে চলতে হলে খেলোয়াড়দের সবকিছুতেই আরও ভালো পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত। লক্ষ্য ঠিক করা উচিত পরের ১০ বছরে সে কী করবে।
৫০ ওভারের বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহ নিজেকে দারুনভাবে ফিরে পাওয়ার পর এখন কি টি–টোয়েন্টিতে তাঁকে নিয়ে নতুন করে ভাববেন?
মিনহাজুল: ৫০ ওভারের ক্রিকেট আর টি–টোয়েন্টি এক নয়। তবে মাহমুদউল্লাহর আর টি–টোয়েন্টিতে সুযোগ আছে কি না, সেটি এই মুহূর্তে বলা কঠিন।
প্রধান নির্বাচক হিসেবে আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন কী?
মিনহাজুল: ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টির সাফল্য। ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে ৩–০ তে জয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয়, আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয় এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলা—অর্জন অনেকই আছে।
আর কঠিন সময়?
মিনহাজুল: কঠিন সময় গিয়েছে ২০২১ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। কন্ডিশন, খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স— সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতি ছিল। কোভিডের সময় পার করে অনেক দিন পর আমরা টি–টোয়েন্টি খেলেছি। স্কটল্যান্ডের সঙ্গে হেরে গিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে কঠিন সময় ওটাই।
সামনে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের দল নিয়ে কী ভাবনা?
মিনহাজুল: যেটা বলেছি, গত বছর থেকে আমাদের টি–টোয়েন্টি পারফরম্যান্সের গ্রাফ ওপরের দিকে যাচ্ছে। সিরিজগুলো ভালো খেলছি। খেলোয়াড়দের টি–টোয়েন্টি মানসিকতায় একটা বদল এসেছে। বিশ্বকাপের আগে বিপিএল আছে। এরপর জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দুটি সিরিজ। এসব জায়গায় ভালো খেলে যেতে পারলে আমার মনে হয় বিশ্বকাপে ভালো কিছুর আশা করা যাবে। তবে এবার যুক্তরাষ্ট্রে খেলা, ওখানে আমরা সচরাচর খেলি না। সেটাও মাথায় রাখতে হবে।